ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নেপাল ট্র্যাজেডির লোমহর্ষক বর্ণনা

ভয়ঙ্কর সেই মুহূর্তটি ভুলতে পারছেন না বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৫ মার্চ ২০১৮

ভয়ঙ্কর সেই মুহূর্তটি ভুলতে পারছেন না বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ নেপালে একটি দুর্ঘটনার বার্তায় শোকে মুহ্যমান সারাদেশ। ঘোষণা হয়েছে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোকও। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের লাশ শনাক্তের প্রক্রিয়া চলছে। একই সঙ্গে নেপালের হাসপাতালগুলোতে চলছে আহতদের সুস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা। অধিকাংশই মারা গেলেও যারা বেঁচে আছেন তারা হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও ভুলতে পারছেন না ভয়ঙ্কর মুহূর্তটি। বার বার দুর্ঘটনার কথা মনে করে শিউরে উঠছেন বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো যারা এখনও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৬৭ জন যাত্রীও ৪ জন ক্রুসহ নেপালের উদ্দেশ্যে উড়েছিল ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি। এর কয়েক ঘণ্টা পরই কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হওয়ার খবর আসে। যেখানে ৫০ জন নিহত হয়েছেন। এমন মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরে আসতে পেরেছেন কয়েকজন মাত্র। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি এএফপিসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন বেঁচে যাওয়া কয়েকজন সৌভাগ্যবান যাত্রী। যারা বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। বিধ্বস্ত বিমান থেকে বেঁচে ফেরা শাহরীন আহমেদ (২৯)। যিনি বর্তমানে কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজ টিচিং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তিনি। বেড়ানোর উদ্দেশে নেপাল যাচ্ছিলেন তার এক বন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু দুর্ঘটনার হাত থেকে তিনি বেঁচে ফিরলেও তার বন্ধু নিহত হন। বিবিসিকে শাহরীন আহমেদ বলেন, দুপুর আড়াইটার দিকে কাঠমান্ডু পৌঁছে পাইলট প্রথমে ল্যান্ড করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেননি। পরে আকাশে কিছুক্ষণ ঘোরার পর যখন দ্বিতীয়বার ল্যান্ড করার চেষ্টা করেন, তখন বিমানের একপাশ উঁচু হয়ে যায়। তখনই আমি বললাম, বাঁ দিকটা উঁচু হলো কেন! আর তখনই ক্রাশ হয়ে গেল। এরপরই বাইরে হঠাৎ ভয়াবহ আগুন দেখতে পেলাম। আর আমাদের কেবিন ধোঁয়ায় ভরে গেল এবং বিকট শব্দে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটল। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর সাহায্য আসে। সে পর্যন্ত বিমানের ভেতরেই ছিলাম। প্রচ- ভয় লাগছিল আর ‘হেল্প হেল্প’ বলে চিৎকার করছিলাম। শাহরীন আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেন, বিমানে থাকা মানুষগুলো পুড়ে যাচ্ছিল। তারা চিৎকার করছিল এবং বিমান থেকে পড়ে যাচ্ছিল। আমি জ্বলন্ত বিমান থেকে তিনজনকে লাফ দিতে দেখেছি। এটা ভীষণ ভয়ানক পরিস্থিতি ছিল। এরপর সৌভাগ্যবশত কেউ আমাকে সেখান থেকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যান। ইউএস-বাংলার ফ্লাইটে স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির পরিবারের ৫ সদস্য মিলে কাঠমান্ডু ঘুরতে গিয়েছিলেন সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা। সঙ্গে ছিলেন স্বামী মেহেদি হাসান, স্বামীর বড় ভাই ফারুক আহমেদ, ফারুকের স্ত্রী আলমুন নাহার এ্যানি ও সন্তান তামাররা প্রিয়ক। মেহেদি হাসান ও ফারুক সম্পর্কে মামাত ফুফাত ভাই। দুর্ঘটনায় ফারুক ও তার সন্তান তামাররা প্রিয়ক মারা গেছেন। আর হাসপাতালের বিছানায় বাকি তিনজন। সাভারের গণস্বাস্থ্য মেডিক্যাল থেকে কয়েক দিন আগে এমবিবিএস পাস করেছেন কামরুন্নাহার স্বর্ণা। বুধবার সকালে সাংবাদিকদের স্বেচ্ছায় তিনি কিছু বর্ণনা দেন সেই দুর্ঘটনার সময়টার। ঘটনার বর্ণনায় স্বর্ণা জানিয়েছেন, আমরা ১৪ নম্বর সিটে বসেছিলাম। পাঁচজন পাঁচটি সিটে ছিলাম। ১৪-এ এবং ১৪-সি’তে আমি আর আমার স্বামী, ১৪-ডি এবং ১৪-এফ সিটে আমার ভাইয়া ও ভাবি বসেছিলেন। ভাবি জানালার পাশে ছিলেন। প্রথমে আমি জানালার কাছে বসলেও ল্যান্ডিংয়ের সময় আমার স্বামী জানালার কাছে বসে। অবতরণের সময় প্লেনটা একটু ঝাঁকি খেয়েছে। কেবিন ক্রুরা ল্যান্ডিংয়ের ঘোষণা ছাড়া কোন ঘোষণা দেয়নি, কোন সতর্ক-সঙ্কেত দেয়নি। বুঝতে পারছিলাম আমাদের প্লেনটা বাঁকা হয়েছিল। প্লেনটা কাঁপছিল, সঙ্গে সঙ্গে সামনের চার-পাঁচটা গ্লাস ভেঙ্গে গেল, সামনের যাত্রীরা বলছিল ‘ব্লাস্ট ব্লাস্ট’। তখন প্লেনটি পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। আমার পায়ের নিচে আগুন ধরে গিয়েছিল। আমার স্বামী তখন কেডস পরা অবস্থায় পা দিয়ে জানালা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিলেন। প্লেনের সামনের অংশটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। আমাদের কাছাকাছি চার-পাঁচটি সিটও ভেঙ্গে গিয়েছিল, সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, সেই জায়গা থেকে আলো আসছিল। তখন আমার স্বামী কোন মতে ওইদিক দিয়ে বের হয়েছে। তারপর উনি (স্বামী) আমাকে ডাকলেন, ‘তুমি আস।’ অনেক মানুষের মাথা দেখতে পাচ্ছিলাম। তারা বের হওয়ার চেষ্টা করছিল অথবা বের হতে পারছিল না। কারণ তারা শরীর নাড়াতে পারছিল না। ভাইয়া (ভাসুর) যেখানে ছিল সেখান থেকে আগুন জ্বলছিল, ধোঁয়া এসে আমার নাকে লাগছিল। আমার হাসব্যান্ড যতটুকু গিয়েছিল ততটুকু আবার ফেরত এসেছে তারপর আমার হাত ধরে টেনে বের করেছে। তা না হলে আমি বের হতে পারতাম না, কারণ আমার শরীরে কোন শক্তি ছিল না। বের হওয়ার পর ঘাসের উপর পড়েছিলাম। আমার পর আরও দুই-তিনজন মানুষ বের হয়েছিল। আমরা বের হওয়ার ২ মিনিটের মাথায় বড় একটা ‘ব্লাস্ট’ হয়। চোখের সামনে বিধ্বস্ত প্লেনের আগুন জ্বলতে দেখছিলাম। ফায়ার সার্ভিসের যারা উদ্ধারের জন্য এসেছিল, তাদের আমার অভিজ্ঞ মনে হলো না। তারা আগুন কন্ট্রোলে আনতে পারছিল না। দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশী মেহেদি হাসান বলেন, আমার সিটটি পেছনে ছিল। আমি আগুন দেখে পরিবারকে খুঁজতে শুরু করলাম। আমরা জানালা ভেঙ্গে ফেলার অনেক চেষ্টা করেও পারিনি। তবুও আল্লাহর রহমতে বেঁচে ফিরলেও আত্মীয় মারা গেছে। বসন্ত বহরা নামে আরেক যাত্রী বিমান বিধ্বস্তের সময়কার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, হঠাৎ করেই বিমানটি প্রচ- রকম কাঁপতে শুরু করে এবং মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। আমি জানালার কাছে ছিলাম। সেটি ভাঙ্গতে পারায় আমি প্রাণে রক্ষা পাই। তারপর আর কিছু মনে নেই। কেশব পান্ডে নামের এক নেপালী যাত্রী বলেন, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর আমি বের হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমার হাত ও পা আটকে যাওয়াতে বের হতে পারছিলাম না। আমার সিট ছিল জরুরী নির্গমন দরজার পাশেই। সম্ভবত সেখান দিয়েই উদ্ধারকর্মীরা আমাকে বের করেছেন। এর বেশি কিছু মনে নেই। আশীষ রণজিৎ নামের এক যাত্রী এএফপিকে বলেন, আমি এয়ার হোস্টেসকে জিজ্ঞাসা করি, কী হচ্ছে, সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো? তিনি আমাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বোঝান সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, তার চেহারার মধ্যে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। সনম শাকিয়া নামে আরেক বিমান যাত্রী বলেন, বিমানটি একবার ওপরে, একবার নিচে, একবার ডানে, একবার বাঁয়ে পাক খাচ্ছিল। প্রথমে আমি ভাবলাম, বিমান নামার সময় মনে হয় এমনটাই ঘটে থাকে। পরে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি সোমবার স্থানীয় সময় বেলা ২টা ২০ মিনিটে অবতরণের কথা ছিল। নামার আগেই এটি বিধ্বস্ত হয়ে বিমানবন্দরের পাশের একটি খেলার মাঠে পড়ে যায়। উড়োজাহাজটিতে ৪ জন ক্রু ও ৬৭ জন যাত্রী ছিলেন। উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানসহ ৫০ জন নিহত হয়েছেন। যেখানে ২৬ বাংলাদেশীও রয়েছেন। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন সরকার। এদিকে বুধবার কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস জানিয়েছেন, দুর্ঘটনায় নিহতদের সবার মরদেহ শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে আরও কয়েক দিন সময় লাগতে পারে। আর দেশে অপেক্ষায় স্বজনরা।
×