ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কুকুর লেলিয়ে হিমু হত্যা মামলার রায়

চট্টগ্রামে পিতাপুত্রসহ পাঁচজনের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৫ আগস্ট ২০১৬

চট্টগ্রামে পিতাপুত্রসহ পাঁচজনের  ফাঁসি

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে কুকুর লেলিয়ে ভবনের ছাদ থেকে ফেলে হিমাদ্রি মজুমদার হিমু হত্যা মামলার রায়ে ব্যবসায়ী পিতা ও তার পুত্রসহ ৫ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছে আদালত। চট্টগ্রাম মহানগর চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ নুরুল ইসলাম রবিবার চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। দ-াদেশপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে তিনজন কারাগারে, দু’জন পলাতক। রায়ের সত্যায়িত কপি পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপীল করতে পারবেন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে দু’দফায় মামলার রায় প্রদানের ধার্য তারিখ পিছিয়ে রবিবার বহুল আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম নগরীর সামারফিল্ড স্কুল এ্যান্ড কলেজের এ লেভেলের মেধাবী শিক্ষার্থী হিমাদ্রি মজুমদার হিমু হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে রবিবার আদালত ভবনের সংশ্লিষ্ট এজলাস ও আশপাশে ছিল উৎসুক আইনজীবী, সংবাদ কর্মী ও সাধারণ মানুষের ভিড়। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে বিচারক রায় ঘোষণার পর সন্তোষ প্রকাশ করেন হিমুর বাবা সিএ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী প্রবীর মজুমদার ও মামলার বাদী হিমুর মামা প্রকাশ দাশ অসিত। অপরদিকে, ভাবলেশহীন দেখা যায় আদালতে উপস্থিত তিন আসামি ব্যবসায়ী শাহ সেলিম টিপু, শাহাদাত হোসেন সাজু ও মাহবুব আলী ড্যানিকে। দ-াদেশ পাওয়া পলাতক বাকি দুই আসামি হলেন ব্যবসায়ী টিপুর পুত্র জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ ও জাহিদুল ইসলাম শাওন। আদালতের রায়ে বলা হয়, দণ্ডবিধির ৩০২/৩২ ধারায় ৫ আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলো। রায়ে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়। তবে একই রায়ে সাত দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপীলের নির্দেশনাও দেয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অনুপম চক্রবর্তী বলেন, কুকুর লেলিয়ে কাউকে হত্যা করার কোন নজির নেই। অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় আদালত আসামিদের প্রত্যেককে মৃত্যুদ- দিয়েছেন। যেহেতু এ ধরনের ঘটনা অতীতে কখনও ঘটেনি সেহেতু এ রায়ও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি জানান, মেধাবী শিক্ষার্থী হিমাদ্রি মজুমদার হিমু এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আর সে কারণেই রোষানলে পড়ে তাকে এমন নৃসংশভাবে প্রাণ দিতে হয়, যা প্রসিউকিশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। মামলার বিবরণ এবং হিমুর বাবা ও বাদী এবং আসামি পক্ষের কৌঁসুলিদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, হিমাদ্রি মজুমদার হিমু ‘শিকড়’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সংগঠনটি মাদক ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। ঘটনার কিছুদিন আগে মাদক ব্যবসা ও মাদক সেবনের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় একটি জিডিও করা হয়েছিল শিকড়ের পক্ষ থেকে। এতে শাহাদাত হোসেন সাজুর নামও ছিল অভিযুক্ত হিসেবে। এই সাজু রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারক শাহ সেলিম টিপুর শ্যালিকার পুত্র। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনায় ব্যবসায়ী টিপু হিমুকে দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়েছিল। এর কিছুদিন পরই ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল হিমুকে অপহরণ করে চট্টগ্রাম নগরীর ১নম্বর সড়কের ‘ফরহাদ ম্যানশন’ নামের পাঁচতলা একটি বাড়ির ছাদে নিয়ে জার্মান ডোবারম্যান কুকুর লেলিয়ে দেয়া হয়। আত্মরক্ষার চেষ্টায় ব্যর্থ হিমু একপর্যায়ে ছাদ থেকে নিচে পড়ে যান। তাকে প্রথমে চট্টগ্রামে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হয়। ২৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ওই বছরের ২৩ মে তিনি মারা যান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হিমুর বাবা জানান, হত্যাকারীরা হিমুর বন্ধু ছিল না। তারা ছিল বয়সে অনেক বড়। হিমাদ্রি মজুমদার হিমুর মৃত্যুর ঘটনায় তার মামা প্রকাশ দাশ অসিত বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে আসামি করা হয় ৫ জনকে। তারা হলেন-ব্যবসায়ী শাহ সেলিম টিপু, তার পুত্র জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ এবং রিয়াদের তিনবন্ধু শাহাদাত হোসেন সাজু, মাহবুব আলী খান ড্যানি ও জাহিদুল ইসলাম শাওন। এরমধ্যে আসামি রিয়াদ শুরু থেকে এবং শাওন জামিনে মুক্ত হয়ে পলাতক রয়েছেন। পুলিশের তদন্ত শেষে আদালতে চাঞ্চল্যকর এ মামলার চার্জশীট দেয়া হয় ২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর ১৮ অক্টোবর পলাতক দুই আসামিকে গ্রেফতার করতে আদালতের পক্ষ থেকে পরোয়ানা জারি হয়। ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ এসএম মজিবুর রহমানের আদালতে ৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। আদালতে এ মামলায় মোট ২০ জন সাক্ষ্যপ্রদান করেন। সাক্ষ্য ও আসামি পক্ষের কৌঁসুলিদের যুক্তিতর্কে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। মামলার বাদী হিমুর মামা শ্রী প্রকাশ দাশ অসিত রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি। যত দ্রুত সম্ভব সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রায় কার্যকর হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। হিমুর বাবা প্রবীর মজুমদার বলেন, আমরা চাই উচ্চ আদালতে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি হোক। কারণ, বিলম্ব হলে বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আসামি পক্ষের অন্যতম কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট জুয়েল দাশ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমরা ন্যায্য বিচার পাইনি। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বেশকিছু অসঙ্গতি রয়েছে। তাছাড়া সকল আসামির অপরাধ সমান নয়। তাই ৫ আসামির সকলেই মৃত্যুদ- পেতে পারেন না। উচ্চ আদালতে আপীলের মাধ্যমে আসামিরা সুবিচার পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। হিংস্র প্রাণী দিয়ে হত্যার প্রথম রায় চট্টগ্রামে ॥ মাকসুদ আহমদ জানান, হিংস্র প্রাণী লেলিয়ে নির্যাতনের পর মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে অবশেষে ছাদ থেকে ফেলে মেধাবী ছাত্র হিমাদ্রি মজুমদার হিমু হত্যার ঘটনার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিচার হলো চট্টগ্রাম আদালতে। রবিবার এই রায় ঘোষণার আগে ২টি তারিখ পার হয়েছে শুধু বিচারক ছুটিতে থাকা ও আইনজীবীদের ফুল কোর্ট রেফারেন্সের কারণে। কিন্তু এ হত্যা মামলার রায় শুনতে উদগ্রীব ছিল চট্টগ্রামের মানুষ। এর কারণ, দেশে এই প্রথম কোন হিংস্র প্রাণীর মাধ্যমে মানুষ হত্যার ঘটনার রায় প্রকাশ হলো। তবে এ রায় কার্যকর হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে হিমুর জন্মদাতা মা-বাবার। মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক নূরুল ইসলাম চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় দিয়েছেন জনাকীর্ণ আদালতে।
×