ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

গুলশান হামলার পূর্বাপর

গুলি ও গলাকেটে হত্যার পরও জিম্মিদের নৃশংসভাবে কোপায় জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ জুলাই ২০১৬

গুলি ও গলাকেটে হত্যার পরও জিম্মিদের নৃশংসভাবে কোপায় জঙ্গীরা

শংকর কুমার দে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি হত্যার ৩ দিন আগেই রেকি করে গেছেন ৩ জঙ্গী নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ ও মীর সামিহ মোবাশ্বের। জিম্মিদদের ওপর গুলি ছুড়েছে এই তিন জঙ্গীই। আর জঙ্গী খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে। একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছে জঙ্গীরা। জঙ্গীরা ২০ জিম্মিকে হত্যার আগে ৭ জনকে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করেছে। হত্যাকা-ের পর ২ জন ছাড়া ১৮ জনেরই গলা কেটেছে তারা। জিম্মিদের গুলি করে হত্যা ছাড়াও মৃতদেহগুলো এলোপাতাড়ি কুপিয়ে নৃশংস ও বিভৎস দৃশ্য তৈরি করেছে জঙ্গীরা। জিম্মিদের রাত ১২টার আগেই হত্যা করা হয়েছে এবং জঙ্গীদের মৃত্যু ঘটেছে সকাল ৭টার পরে। নিহত সব জঙ্গীর শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। নিহত জঙ্গীদের সহযোগী অপর পলাতক জঙ্গীদের হাতে এখনও ১৮টি ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। জঙ্গী সন্দেহভাজন নিখোঁজ হওয়া ১০ যুবকের ২ জনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, পুলিশ ও ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের বরাত দিয়ে হাসপাতাল সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গুলশান পুলিশের তত্ত্বাবধানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিহতদের ময়নাতদন্ত করার পর গুলশান হত্যাকা-ের ধরনের বর্ণনা সম্বলিত তথ্যের কথা গণমাধ্যমের কাছে উল্লেখ করেছেন ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গীরা ২০ জন জিম্মিকে হত্যা করে। এদের মধ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অবিন্তা কবীরকে ভারি অস্ত্রের আঘাতে এবং ৭ জনকে হত্যার আগে গুলি করা হয়। নিহত অবিন্তা কবীরসহ দুজন ব্যতীত আর সকলের গলা কাটা ছিল। হলি আর্টিজানের ২০ জিম্মির মধ্যে ৭ জনের দেহে ৮টি গুলি পাওয়া গেছে। তবে নিহত অবিন্তা কবীরসহ অপর এক জিম্মির মৃত্যু হয়েছে ভারি অস্ত্রের আঘাতে। তাদের গলা কাটা হয়নি। নিহত সব জঙ্গীর শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর ৩ জনের শরীরে বোমার স্পিøন্টারের আঘাত পাওয়া গেছে। বোমার কারণে কয়েক জঙ্গীর হাত ও পা উড়ে গেছে। নিহত ২৬ জনের মাসল টিস্যু ও চুল থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেয়া যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার। গুলশান ট্র্যাজেডির ঘটনায় নিহত ৬ জঙ্গী ও ২০ জিম্মির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। ড্রাগস ও ডিএনএ পরীক্ষা ॥ গুলশানের রেস্তরাঁয় থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেডের সেইফটি পিন, ছোরা, চাপাতিসহ ৭৪ রকমের আলামত ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করেছে পুলিশ। এসব আলামত ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হচ্ছে। গুলশানে ২০ জিম্মি হত্যাকা-ের সময়ে ৬ জঙ্গী হত্যাকা- ঘটানোর পূর্বে তারা শক্তিবর্ধক কোন ড্রাগস নিয়েছে কি না জানতে আদালতের নির্দেশে তাদের ভিসেরাও সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ৬ জঙ্গীর ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অস্থি, মজ্জা, জামা কাপড়সহ আলামত পরীক্ষা করার আবেদন মঞ্জুর করেছে আদালত। গত ১ জুলাই দিবাগত রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা দেশী-বিদেশী নাগরিকদের জিম্মি করে। এরপর রাতের মধ্যেই তিন বাংলাদেশীসহ ২০ জিম্মিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে তারা। পরের দিন শনিবার সকালে বিশেষ অভিযানে ৬ জঙ্গী নিহত হয়। হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জিম্মিদের উদ্ধারে অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গীদের গ্রেনেড হামলায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান মারা যান। ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ অভিযানে মারা যায় সন্ত্রাস চালানো জঙ্গীরা। যারা যেতেন হলি আর্টিজানে ॥ গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে সবচেয়ে বেশি যেতেন ইতালীয়রা। ইতালীয়দের পরই যারা যেতেন তাদের মধ্যে আছেন স্প্যানিশ, জাপান ও ফ্রান্সের নাগরিক। যে নয় ইতালীয় নিহত হন, তারা সবাই ওই রেস্তরাঁয় প্রায়ই যেতেন। ঘটনার দিন তারা আগেই বুকিং দিয়ে ওকিচেনে যান। একই মালিকের আরেকটি রেস্তরাঁয় নিয়মিত অতিথি ছিলেন নিহত সাত জাপানী। গুলশানের ১১৯ নম্বর সড়কে ইজমি নামের ওই জাপানী খাবারের রেস্টুরেন্টের অবস্থান। তবে স্প্যানিশ খাবারের স্বাদ নিতে ১ জুলাই ওকিচেনে যান আগে থেকে বুকিং দিয়ে তারাও। রেস্তরাঁটিতে অনেক দেশের নাগরিকই যেতেন। ঘটনাক্রমে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন নিহতরা। ইতালি, জাপানীসহ সুনির্দিষ্ট কোন দেশের নাগরিক জঙ্গীদের টার্গেট ছিল না। তাদের টার্গেট ছিল ইসলামের পরিবর্তে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বিদেশীরা। তারপরও ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদেরও নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করেছে জঙ্গীরা। গুলি ছোড়ে তিন জনে, কোপায় দুই জনে ॥ গোয়েন্দা সূত্র জানান, জঙ্গীরা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় তিন জঙ্গী হামলা করার ঘটনার আগে ঘটনাস্থল রেকি করেছে তিন বার। রেকি করেছে নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ ও মোবাশ্বের। ওই রেস্তরাঁয় আগেও গেছে তারা। সেখানে বিদেশীদের পাওয়া যাবে এমন তথ্য নিশ্চিত ছিল তারা। তদন্তকারী সংস্থা উদ্ধারকৃতদের তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ থেকে জানতে পেরেছে, ঘটনার দিন রেস্তরাঁয় পাঁচ জঙ্গীই ঢুকেছিল। তাদের মধ্যে নিবরাস, রোহান ও মীর সামিহ মোবাশ্বের গুলি ছোড়ে আর খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে। রেস্তরাঁর শেফ সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও নর্থ সাউথের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিমের হাতেও অস্ত্র তুলে দেয় জঙ্গীরা। ঘটনাস্থল থেকে অন্তত ৩০টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ফোন সেটের মধ্যে জঙ্গীদের কোন মোবাইল ফোন আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। জঙ্গীরা জিম্মিদের মোবাইল কেড়ে নিয়ে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড নিয়ে হত্যার ছবি পাঠানোর অভিযোগের তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। হলি আর্টিজান বেকারির প্রবেশমুখে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। তবে অভিযানের সময় ওই ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানকার ফুটেজ মেলেনি। পাশের চারটি বাড়ির সামনের সিসিটিভি ফুটেজে কিছু দৃশ্য ধরা পড়ে। হামলার সময় বাইরে অপেক্ষমাণ ছিল আরও পাঁচ-ছয়জনের একটি দল। তাদের তিনজনকে ফুটেজে দেখা গেছে, সহযোগীসহ হামলাকারীরা মাইক্রোবাসে করে ঘটনাস্থলে আসে। এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত ফুটেজ বিশ্লেষণ করা অব্যাহত আছে। টেনিস ব্যাগে অস্ত্র ॥ তদন্তসূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর বাইরের অর্ধশতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণে করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, জঙ্গীরা টেনিস ব্যাটের ব্যাগে ভরে রাইফেলসহ অস্ত্র নিয়ে রেস্তরাঁয় ঢোকে। নিচ তলায় বাধার মুখে পড়েই আল্লাহু আকবার বলে গুলি চালায় তারা। জঙ্গীরা সেখানে নিজস্ব মোবাইল ফোন নিয়ে যায়নি। তারা রেস্তরাঁর কর্মীদের কাছ থেকে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড জেনে জিম্মিদের ফোন ব্যবহার করে হত্যার ছবি পাঠায়। তারা বাংলা ও ইংরেজীতে কথা বলে হত্যার খবর বাইরে জানায়। জঙ্গী হামলার সময় বাইরে অপেক্ষমাণ ছিল আরো পাঁচ-ছয়জনের একটি দল। তাদের তিনজনকে ফুটেজে দেখা গেছে। হামলাকারীরা বনানীর একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল বলে তথ্য পাওয়ার পর সেখানে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি বিদেশ ভ্রমণ করে আসা এবং নিখোঁজ থাকা যুবকদের তথ্য সংগ্রহ করে হামলাকারী চক্রটিকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা আলামতগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ সহায়তা নেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হচ্ছে। ১৮ ভয়ঙ্কর অস্ত্র জঙ্গীদের হাতে ॥ জঙ্গীদের হাতে এখনও কমপক্ষে ১৮টি ভয়ঙ্কর অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ভবিষ্যতে আরও হামলা চালানোর পরিকল্পনায় ব্যবহার হতে পারে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে এই ধরনের ভয়ঙ্কর অস্ত্র থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। জঙ্গীদের হাতে দু’ডজনের বেশি ভয়ঙ্কর অস্ত্র এসেছে যার মধ্যে একটি চট্টগ্রামের জঙ্গী আস্তানা এবং অন্য দুটি রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন থেকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে থেকে জব্দ করা জঙ্গীদের অস্ত্রের সঙ্গে কমলাপুর ও চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রের মিল পাওয়া গেছে এবং একই চক্র এসব কাজ করছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সেই হিসাবে কমপক্ষে আরও ১৮টি অস্ত্র এখনও জঙ্গীদের হাতে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। জঙ্গী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ॥ গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই মূলত সামনে আসে বিভিন্ন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রদের জঙ্গী কানেকশনের কথা। এরপর গোয়েন্দাদের তথ্যে উঠে আসে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জঙ্গী প্রশিক্ষণের তথ্য। ঢাকা শহরে ওই স্কুলটির তিনটি শাখা (মোহাম্মদপুর, গুলশান ও উত্তরায়) রয়েছে। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা একজন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি হিযবুত তাহ্রীর একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তার স্ত্রী ওই স্কুলটি পরিচালনা করতেন। যে ১০ জঙ্গীর ছবিসহ প্রকাশিত তালিকায় নাম রয়েছে ওই স্কুলের একজন শিক্ষক জুবায়ের রহিমের। তার পাসপোর্টের ঠিকানা অনুযায়ী ধানম-ির বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ঠিকানাটি সঠিক নয়। তিনি পাসপোর্টে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। তার বাবার নাম বজলুর রহিম। এছাড়াও রাজধানীর সব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কার্যক্রমের তদন্ত চলছে। রাজধানীর বাইরের সব পুলিশ সুপারদের (এসপি) জেলায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উত্তর বঙ্গের কয়েকটি জেলার চরাঞ্চলেও জঙ্গী প্রশিক্ষণ হয়েছে বলে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের দেয়া জবানবন্দীতে উল্লেখ করা হয়েছে। ১০ নিখোঁজের মধ্যে পরিবারও নিখোঁজ ॥ নিখোঁজ ইব্রাহিম হাসান খান ও জুনায়েদ খানের বাসা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। আর আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম পান্থপথের একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। এই দুই বাসায় পরিবারগুলোর কাউকে পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা কোথায় আছেন সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তাদের খোঁজ নেয়া হচ্ছে তারা কি দেশেই আছে নাকি বিদেশে চলে গেছে কিংবা আত্মগোপন করেছে কিনা? এর মধ্যে ইব্রাহিম হাসান খান ও জুনায়েদ খান আপন দুই ভাই বলে তথ্য পাওয়া গেছে। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ জঙ্গী কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন বলে তাদের পরিবারের ভাষ্য। বেশ কিছুদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন এমন ১০ যুবকের নাম ও ছবি প্রকাশ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুরের এ টি এম তাজউদ্দিন কাউসার অস্ট্রেলিয়ায় থাকতেন বলে তার পরিবার জানিয়েছে। আর ধর্মান্তরিত মুসলিম মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি জাপান প্রবাসী ছিলেন বলে তার পরিচিতরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, সিলেট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র সুজিত দেবনাথ ২০০১ সালে জাপান যাওয়ার পর সেখানে স্থায়ী হন এবং সেখানেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ওই নাম নেন বলে জানা গেছে। নথ সাউথের ছাত্র ॥ জুন্নুদ নামের আরেকজন আছেন নিখোঁজের তালিকায়। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। জুন্নুন ষষ্ঠ সেমিস্টার পর্যন্ত সেখানে পড়েছে। ২০১৪ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে গ্রেফতার হয়ে তিনি এক বছর কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়েছিলেন তিনি। বাসা রাজধানীর জিগাতলায়। প্রায় আট মাস আগে বাসা থেকে বেরিয়ে যান জুন্নুন। কয়েকদিন পরে ফোনে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা জানিয়েছিল। তারপর থেকে তার সঙ্গে পরিবারের আর কোন যোগাযোগ নেই বলে জানায় তার পরিবার। আরেক নিখোঁজ হচ্ছে, বাসারুজ্জামান রাজশাহীর তানোর উপজেলার লালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজ উদ্দিনের ছেলে। সিরাজ উদ্দিন তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ২০০৭ সালে বাসারুজ্জামান নর্থ সাউথের ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকে বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। বছর দুই আগে ঢাকায় বিয়ে করার পর তার সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। গণমাধ্যমে ছবিসহ সংবাদ প্রকাশের পর বাবার বাড়ির লোকজন বাসারুজ্জামানের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি জানতে পারেন বলে তার পরিবারের ভাষ্য। গত ১ জুলাই গুলশানে হামলাকারী যুবকদের সবাই বেশ কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন, যাদের মধ্যে নিবরাজ ইসলাম ছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এক সপ্তাহের মাথায় শোলাকিয়ায় হামলা চালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত আবীর রহমানও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনিও চার মাস আগে নিখোঁজ হন বলে পরিবারের ভাষ্য। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানরা বাড়ি পালিয়ে জঙ্গীবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার তথ্য আসতে থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে অভিভাবকদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়। খুলে দেয়া হবে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গী হামলায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই আশপাশে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না এখনও। তদন্তের স্বার্থে রেস্টুরেন্ট ও এর পাশের লেকভিউ ক্লিনিকটি এখন পুলিশের নিরাপত্তা বলয়ের ভেতরে আছে। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। তারা সেখান থেকে বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে স্পটটি এখনও একই রকম রয়েছে। ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রইম (সিটি) ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, গুলশানের আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গী হামলার ঘটনায় স্পটটিকে এখনও পুলিশের নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে। তবে ঘটনাস্থল থেকে পর্যাপ্ত আলামত সংগ্রহের পর তা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গুলশানের ঘটনা তদন্তে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সিঙ্গাপুর থেকে প্রযুক্তি সহায়তা নেয়া হতে পারে। বিদেশী সংস্থাগুলোর যদি কেনে আলামতের প্রয়োজন হয় তাই এখনও আর্টিজানে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কারণ সেখানে আলামত আছে। তদন্ত কর্মকর্তারা যখন বলবেন তখনই আমরা খুলে দেব।
×