
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। বাবার প্রতি ভালোবাসা জানাতে সারা বিশ্বেই পালিত হবে দিনটি। প্রতিটি মানুষের জীবনে তাদের মা-বাবাই সবচেয়ে আপনজন। তাদের ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে সন্তানরা।
আজ আমি নিজেও একজন বাবা হয়েছি।
সংসারের চাপে যখন দুশ্চিন্তায় থাকি, তথন কাজের ফাঁকে ফোন করে বাবাকেই বলতে ইচ্ছা করে ‘আর পারছি না বাবা। আমার বিপদ - আপদের সময় আর কাউকে পাশে না পেলেও বাবা মা কে পাশে পাই সব সময়।
রক্তের বন্ধন সবচেয়ে শক্তিশালী।
মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায় কতটা।
মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে একটি আদর্শ সম্পর্ক। এমন অনেকে আছেন যাঁরা এখনো কেবল কোনো উৎসব আয়োজনে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করেন।
আমার বাবা মো. হযরত আলী গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। এক সময় ব্যবসা করতেন। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সন্তান। ৮ ভাই বোনের মধ্যে আমি ছিলাম তৃতীয়। একটু জেদি ও রাগী প্রকৃতির লোক আমি। বাবা দিবস এলেই আমার বাবার অতীতের নানা স্মৃতিময় ঘটনা মনে পড়ে যায়।
আমি যখন ছোট বেলায় গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়ি তখন বাবার চেয়ে দাদাই বেশি আদর করতেন। আমার দাদা সব সময় চাইতেন আমি যেন জীবনে অনেক বেশি লেখাপড়া করে অনেক উচ্চ স্থানে কিছু একটা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমি এসএসসি দেওয়ার আগের বছর ১৯৯৮ সালে দাদা মারা যায়।
তারপর থেকে বাবার স্বপ্ন পুরনের জন্য বড় হয়ে লেখাপড়া করতে থাকি। এখন আমি তিন কন্যা সন্তানের পিতা। মাঝে মাঝে অনুভব করি বাবা হওয়া এতো সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রে মা–বাবা তাঁদের পছন্দ–অপছন্দ অবলীলায় চাপিয়ে দেন সন্তানের ওপর। যা একেবারেই কাম্য নয়।
মা-বাবার সঙ্গে কি কখনো সম্পর্ক ছিন্ন করা যায়? মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের বিচ্ছিন্নতা কি সম্ভব?
প্রতি বছর বিশ্বের ১১১ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বিশ্ব বাবা দিবস। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই দিবসটি পালন করা শুরু হয়।
জীবনের প্রথম ‘সুপার হিরো’ হিসেবে বেশিরভাগ মানুষই নিজের বাবার কথা উল্লেখ করেন। বাবা-র কথা বলতে গিয়ে অনেকেই বলেন, বাবা হলেন সেই বটবৃক্ষ, যা রোদ, বৃষ্টি কিংবা ঝড়ে সন্তানকে আগলে রাখে অতি মমতায়। পৃথিবীর সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও বাবা পাশে থাকবে। কোনো দিন বাবার জন্য সেভাবে কিছু করতে পারি না। বাবা দিবসের এই দিনে সব বাবার জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীতে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, উত্তর সব সময় একটাই মা-বাবাকে। যত অভিমান, চাওয়া-পাওয়া যেন বাবাকে ঘিরেই আমার। বাবাও আমার এমন একজন, কোনো দিন মনে পড়ে না কোনো চাওয়া অপূর্ণ রেখেছেন। শত কষ্টের মাঝে ও বাবা সকল চাওয়া পাওয়া পূরন করতে চেষ্টা করেন।
আধুনিক সমাজে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, যৌথ পরিবারগুলো একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। এখন পরিবার বলতে আমরা শুধু মা-বাবা, ভাই-বোনকে বুঝি। একক পরিবারেও কখনো কখনো বিচ্ছিন্নতা দেখা যাচ্ছে।
মা-বাবার কাছে সবকিছুর জন্য ঋণী। সেটা আক্ষরিক, দার্শনিক বা অস্তিত্বমূলক, যে অর্থেই বিবেচনা করা হোক। তবে স্পষ্টতই, যদি আমি মা-বাবার ভয়াবহ নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বড় হই, তবে ধরেই নেওয়া যায় যে আমার আর কোনো অতিরিক্ত দায়িত্ব নেই।’
এভাবে ভাবতে পারলে ভবিষ্যতে আমরাও যদি মা-বাবা হই, তাহলে সেই চাপের কিছুটা হয়তো আমাদের কাঁধ থেকে নেমে যাবে।
১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার পশ্চিম ভার্জেনিয়ার মোনোনগাহ্য় কয়লা খনিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ৩৬২ জন পুরুষ। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন সন্তানের বাবা। ফলে প্রায় ১ হাজার শিশু পিতৃহারা হয়ে পড়ে। পরের বছর ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। নিহতদের সম্মান জানাতে সন্তানরা মিলে এই প্রার্থনাসভার আয়োজন করে। এটি ছিল বাবাকে সম্মান জানাতে ইতিহাসের প্রথম আয়োজন।
বাবা দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে সনোরা স্মার্ট ডড নামে এক নারীর। ১৯০৯ সালের আগে ওয়াশিংটনে বাবা দিবস বলে কোনও বিশেষ দিন ছিল না। সে সময় স্থানীয় গির্জায় ডড মা দিবস পালনের কথা শোনেন। মা দিবস পালনের রীতি রয়েছে কিন্তু বাবা দিবস পালনের রীতি নেই জেনে তিনি ভীষণ অবাক হন। তারপর তিনি বাবা দিবসের স্বীকৃতির জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ডড তার বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। মা ছিল না তার। মায়ের মৃত্যুর পর শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও তাদের সাত ভাইবোনকে বড় করে তুলেছিলেন তাদের সিঙ্গেল বাবা। বাবার এই ত্যাগ দেখে ডডের মনে হলো, মা দিবসের এত আয়োজন হলে বাবা দিবস কেন বাদ থাকবে। বাবাকে সম্মান জানানোর জন্যও একটা দিন থাকা দরকার।
১৯১০ সালের ১৯ জুন বিশ্বে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বাবা দিবস।
ওয়াশিংটন থেকে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এ দিবস পালনের কথা। আস্তে আস্তে মা দিবসের পাশাপাশি বাবা দিবসের প্রতিও সচেতন হতে থাকেন সন্তানরা। এরপর ১৯২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলি বাবা দিবসে সম্মতি দেন।
তারপর ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন জুন মাসের তৃতীয় রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস উদযাপনের কথা ঘোষণা করেন এবং সবশেষে ১৯৭২ সালে তখনকার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন একটি আইনে স্বাক্ষর করে বাবা দিবসকে জাতীয় মর্যাদা দেন। তারপর থেকে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার সারা বিশ্বে বাবা দিবস পালন হয়ে আসছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করা হয়। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাবা দিবস পালন করা হয় জুন মাসের তৃতীয় রবিবার। দক্ষিণ আমেরিকায় দিবসটি পালিত হয় ১৯ মার্চ। আর অস্ট্রেলিয়া ও ফিজিতে পালন করা হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রবিবার।
বাবা দিবসে পৃথিবীর সকল বাবাদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। ভালো থাকুক সুখে থাকুক পৃথিবীর সকল বাবারা। আর কোনো বাবাকে যেন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বা থাকতে না হয়।
মুমু