
.
‘আমিও তো তোমাদেরই মতো প্রতিবাদে বলেছি তখন, /‘প্রেমাংশুর বুকের রক্ত চাই, হন্তার সঙ্গে আপোস কখনো নাই।’ /বুকের বোতাম খুলে প্রেমাংশুকে বলিনি কি ‘দেখো,/আমার সাহসগুলো কেমন সতেজ বৃক্ষ,/বাড়ির পাশের রোগা নদীটির নীল জল থেকে/প্রতিদিন তুলে আনে লাল বিস্ফোরণ?”
প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ কাব্যগ্রন্থটি কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কবিতার বই। বইটি কবিকে দিয়েছে দেশব্যাপী পরিচিতি। তবে অনেক বিষয়ে করেছে বিতর্কিত। বহুল জনপ্রিয় বইটি আজও পাঠককে প্রকাশকালের মতোই সমানভাবে আপ্লুত করে চলেছে।
নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশীর রক্ত চাই’ কাব্যগ্রন্থে নি¤œলিখিত ৩১টি কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। কবিতাগুলো হলোÑ হুলিয়া, অশোক গাছের নিচে, মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক, সবুজ কাক, জনাকীর্ণ মাঠে জিন্দাবাদ, চুক্তি, ভালোবাসার টাকা, জলের সংসার, অসভ্য শয়ন, যানবাহন নেই, প্রেমাংশুর রক্ত চাই, জালনোট, একটি গৃহিণী গ্রাম, গ্রামবাসী, উন্নত হাত, এক-একটি মানুষ, অসমাপ্ত কবিতা, কংক্রিটের কোকিল, ভালোবাসার পুরনো বর্গায়, দৃশ্যে-গন্ধে-স্পর্শে-রক্তে-গানে, নির্জন হীরা জ্বাললে, শ্বেতাঙ্গের শরে বিদ্ধ, প্রতিদ্বন্দ্বী, স্বদেশের মুখ শেফালি পাতায়, কলম, হিমাংশুর স্ত্রীকে, যুদ্ধ, অর্জুনের রাজ্য, মানুষ, লজ্জা, ইনসমনিয়া, পুনরুদ্ধার।
‘ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:
-আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
-আইয়ুব খান এখন কোথায়?
-শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?
-আমার নামে কতদিন আর এ রকম হুলিয়া ঝুলবে?’ (হুলিয়া— নির্মলেন্দু গুণ- প্রেমাংশুর রক্ত চাই)। সময়টা ১৯৭০ সাল। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। মুক্তির আকাক্সক্ষায় উত্তাল পূর্ব বাংলা। জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভের ফলে ‘বাংলাদেশ’ ভূখন্ডে নতুন স্বপ্ন’। তরুণরা নতুন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে স্বপ্নের ঘর আর বারান্দা তৈরি করছে। চলছে মিছিল। মিটিং। গোপন বৈঠক। প্রকাশ্য সভা। ওদিকে পাক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের ওপর চালাচ্ছে জুলুম, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এক সদ্য যুবক হুলিয়া বুকে নিয়ে ঘরছাড়া। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বাড়ি ফিরছে সে। মফস্বল শহর নেত্রকোনায় তার বাড়ি। ঢাকার রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে তখন সবার চোখ। কি ঘটছে ঢাাকয়? শেখ মুজিবের খবর কি? সাত কোটি বাঙালি তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে। সবার আশা আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ রকম প্রেক্ষাপটে রচিত কবি নির্মলেন্দু গুণ রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতা-ই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর প্রথম কবিতা হুলিয়া।
এক সাক্ষাৎকারে কবি ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ সম্পর্কে বলেন ‘আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের জন্য নওরোজ কিতাবিস্তান, মাওলা ব্রাদার্স ও বইঘরের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও ব্যর্থ হই। তখন কোনো প্রকাশকই আমার বই প্রকাশ করতে চাননি। আসল সত্য হলো তখন আধুনিক কবিতা বইয়ের বাজার একদম কম ছিল। সেই সময়ে আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ কবি সাহিত্যিকদের যৌথ উদ্যোগে কপোতাক্ষ প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল, শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছিল তার বন্ধুর টাকায়, আবদুল মান্নান সৈয়দ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ প্রকাশ করেছিলেন নিজের গাটের টাকায়। কিন্তু খান ব্রাদার্স আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ নিজ থেকে প্রকাশ করতে আগ্রহী হওয়ায় আমি পুলক অনুভব করি। এই সৌভাগ্য তরুণ কবিসমাজে আমি প্রথম পেয়েছিলাম।
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের এই গল্পটি আরো চমকপ্রদ। ২১ জুলাই, ১৯৭০ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তরুণ কবিদের নিয়ে একটি কবিতাপাঠের আসর করেছিল। সেই কবিতাপাঠের আসরে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, সানাউল হক খান, দাউদ হায়দার, হুমায়ুন কবির প্রমুখ কবিরা কবিতা পাঠ করেছিলেন। ওই আসরে সম্ভবত আলোচক অথবা সভাপতি ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। সেখানে আমি ‘হুলিয়া’ কবিতাটি পাঠ করি। এই কবিতা শুনে আবদুল গাফফার চৌধুরী তার জনপ্রিয় কলাম ‘তৃতীয় মত’-এ ‘হুলিয়া’র বিষয়বস্তু নিয়ে বড় ধরনের মন্তব্য করেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘তৃতীয় মত’ কলামটি তখন খুব জনপ্রিয় হওয়ার কারণে আমার ‘হুলিয়া’ কবিতাটি অনেকে খোঁজ করা শুরু করেন। এই কলামটি আমার কাব্যভাগ্য আরও প্রসারিত করে। তখন আমার ‘হুলিয়া’ কবিতাপাঠ করে খান ব্রাদার্সের মালিক মোসলেম খান তাদের ছেলেদের ‘হুলিয়া’র কবিকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। তাছাড়া আমার গুণ পদবিটির প্রতি তার এক ধরনের দুর্বলতা ছিল, কারণ তিনি ছাত্রজীবনে মণীন্দ্র গুণের ছাত্র ছিলেন। একদিন বিউটি বোর্ডিংয়ে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলে তিনি ‘হুলিয়া’ কবিতার প্রশংসাপূর্বক আমার কাব্যগ্রন্থ তৈরি করতে বলেন। ওই প্রকাশনী থেকে জীবনানন্দ দাশেরও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছিল।
এসডি সুব্রত