ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বনন্দিত চিত্রশিল্পী হোকুসাই

প্রবীর বিকাশ সরকার

প্রকাশিত: ০১:১৮, ৭ অক্টোবর ২০২২

বিশ্বনন্দিত চিত্রশিল্পী হোকুসাই

আজকের নয়নাভিরাম জাপানের রাজধানী টোকিওর মধ্যযুগীয় নাম ‘এদো’

আজকের নয়নাভিরাম জাপানের রাজধানী টোকিওর মধ্যযুগীয় নাম ‘এদো’, তখন রাষ্ট্রের নাম ছিল নিপ্পন। পর্তুগিজরা নাম দিয়েছিল জাঁপন। জাঁপন থেকে ইংরেজী জাপান। এদো নামেই একটি যুগ ছিল ১৬০৩ থেকে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। জাপান তথা সমগ্র প্রাচ্যের ইতিহাসে ব্যতিক্রম একটি যুগ। স্বতন্ত্র শিল্পকলা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাত। স্বাতন্ত্রিক চিত্রকলা যাকে জাপানী ভাষায় ‘উকিয়োএ’ বলা হয়, বাংলায় যা কাঠখোদাই চিত্র অর্থাৎ উড ব্লক প্রিন্টের জন্য এদো যুগ আজও অন্য এক মাত্রায় উদ্ভাসিত।

লাস্যময়, চিত্তহরা রঙিন এই চিত্রগুলোকে ভাসমান চিত্রকর্ম হিসেবেও গণ্য করা হতো। হাজার হাজার এই চিত্র এদো যুগ তথা মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের সূচনালগ্নের ফটোগ্রাফি বা আলোকচিত্র হিসেবে দেখতেন সেই যুগের জাপানী নাগরিকরা। অধিকাংশ শিল্পী এবং ঘরানার চিত্রগুরুরা এদো মহানগরে বসবাস করতেন। এই চিত্রকলার উৎস মধ্যযুগের পার্শ্ববর্তী রাজ্য চীন হলেও বিষয়, আঙ্গিক, রঙ, রেখা এবং নান্দনিক উৎকর্ষের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে জাপানে।

এই ‘উকিয়োএ’ ধারার চিত্রশিল্পীদের মধ্যে কাৎসুশিকা হোকুসাই অন্যতম প্রধান এবং বিশ্বখ্যাত। অন্যান্য উকিয়োএ-মাস্টারদের মতো তাঁর চিত্রও পাশ্চাত্যের বিখ্যাত সব চিত্রশিল্পীদের প্রভাবিত করেছিল। যেমন, এডগার ডেগাস, এডওয়ার্ড মনে, ক্লাউডি মনে, ভিসসেন্ট ভ্যাগ গগ, হেনরি মারি রেইমন্ড, মেরি কাসেট প্রমুখকে। উনিশ শতকের শেষদিকে ইউরোপে এদের চিত্র জাপানিজম বা জাপানিত্ব চিন্তাবাদের জন্ম দিয়েছিল।
সেই কালজয়ী শিল্পীদের শীর্ষ স্থানীয় হচ্ছেন কাৎসুশিকা হোকুসাই। তিনি ১৭৬০ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে গবেষকরা মনে করেন। যদিও তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অসাধারণ মেধাবী এই শিল্পী মাত্র ৬ বছর বয়স থেকে চিত্রকলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন পিতাকে অনুসরণ করে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এদো মহানগরের বিখ্যাত সুমিদা নদীর তীরবর্তী শহরে। বহু শহর ও গ্রাম নিয়ে এদো মহানগর গঠিত ছিল।

বর্তমানেও বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি হচ্ছে টোকিও। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেইজি মহাসংস্কারের সময় ‘এদো’র পরিবর্তে ‘তাওকিয়োও’বা ‘টাকিও’ নাম প্রচলন করা হয়। বর্তমানে মূল টোকিও মহানগর ২৩টি ওয়ার্ড বা শহর নিয়ে গঠিত। তার মধ্যে সুমিদা ওয়ার্ড অন্যতম। এখানেই রয়েছে শিল্পী হোকুসাই এর বিশাল এবং নান্দনিক স্মারক জাদুঘর। তাঁর সব চিত্র এখানে সংরক্ষণ না থাকলেও জানা যায় জীবদ্দশায় ৩০ হাজারের বেশি চিত্র এঁকেছিলেন।

তাঁর চমকপ্রদ জীবন এবং ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বৈচিত্র্যময় চিত্রকর্ম আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি স্বীকৃতি লাভ করছে। এমনকি, তাঁর মৃত্যুর ১৭২ বছর পরেও! আজ তিনি বিশ্বের অন্যতম প্রশংসিত শিল্পী এবং শিল্পবোদ্ধাদের বিস্ময় হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছেন।
হোকুসাই সুমিদা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও বলা হয় যে তিনি তার ৯০ বছরের জীবনে ৯০ বারের বেশি গৃহস্থান বদল করেছেন। তবে হোকুসাই তার জীবনের বেশিরভাগ সময় সুমিদা শহরেই কাটিয়েছেন।

সুমিদাকেন্দ্রিক অনেক চিত্রকর্ম রেখে গেছেন, যার মধ্যে বেশিরভাগই সুমিদার প্রাকৃতিক দৃশ্য, রিয়োগোকু কাঠের সেতু, মিমেগুরি শিন্তোও মন্দির, উশিজিমা শিন্তোও মন্দির উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া বিশ্বমাপের চিত্রকর্ম ‘থার্টি সিক্স ভিউজ অব মাউন্ট ফুজি’ বা ‘ফুজি পর্বতের ৩৬ দৃশ্য’, ‘হানড্রেড ভিউজ অব মাউন্ট ফুজি’ অথবা ‘ফুজি পর্বতের শত দৃশ্য’ এবং ‘দি গ্রেট ওয়েভ অব কানাগাওয়া’ বা ‘কানাগাওয়ার মহাতরঙ্গ’ দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন এগুলো হোকুসাইয়ের অঙ্কিত অতিপরিচিত প্রসিদ্ধ চিত্রকর্ম।  
হোকুসাই প্রায় সাত দশক ধরে বিভিন্ন শৈলী বা পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কন করেছেন। ১৯ বছর বয়সে, হোকুসাই উকিয়োএ শিল্পী কাৎসুকাওয়া শুনশুও এর শিষ্য হন এবং পরবর্তীকালে তাকে ‘শুনরোও’ পদবিতে ভূষিত করা হয়। যে সময়ের মধ্যে তিনি এই নামে কাজ করেছিলেন, তার শেষের দিকে অন্যান্য শিল্প শৈলী নিয়েও অধ্যয়ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন।

কাৎসুকাওয়া ঘরানা ছাড়ার পর, হোকুসাই ‘সোওরি’ ঘরানার অধীনে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন শৈলীতে অধ্যয়ন করতে যান, যা চিত্রকলার ‘রিনপা‘ ঘরানার শৈলী থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। সেখানে তিনি পদবি নিয়েছিলেন ‘তাওয়ারায়া সোওরি’ নামে। হোকুসাই শেষ পর্যন্ত সোওরি স্কুলও ছেড়ে দেন এবং প্রকৃতি ও মহাবিশ্বকে তাঁর সত্যিকারের আদর্শ বলে মনে করেন। পরবর্তীকালে তার চিত্রকর্মে সেসবের প্রতিফলনও ঘটেছিল। বছরের পর বছর ধরে তার যে সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল তা হোকুসাইয়ের বৈচিত্র্যময় শৈলীর উৎস হিসেবেই বিবেচিত।
প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা তার অনেক রচনায় চিত্রিত হয়েছে। যেমন তোওকাইদোও মহাসড়ক এবং কিসোকাইদোও মহাসড়কশীর্ষক চিত্রকর্ম। রঙের ঔজ্জ্বল্য, উচ্চতা এবং সূক্ষ্ম রেখাদি চোখে বিপুল বিস্ময় জাগায়।
তিনি অঙ্কন শৈলীতে অন্যদের অগ্রদূত হয়েছিলেন। ম্যানুয়াল বইয়ের জন্য অঙ্কন করার সময়, তিনি সেগুলো অন্যান্য কারিগরের জন্য ব্যবহারিক করে তুলেছিলেন যা প্রচলিত ছবি থেকে অনেক আলাদা বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
হোকুসাই লিথোগ্রাফিতে মুদ্রিত কয়েক পৃষ্ঠার ওপর একটি লম্বা টাওয়ার আঁকতেন। সেখান থেকে পৃষ্ঠাগুলোকে এ্যানিমেশনের মতো ধারাবাহিক গল্পে রূপান্তরিত করে সীমিত পৃষ্ঠার জায়গায় অভিব্যক্তির নতুন সম্ভাবনার রূপ প্রকাশ করতেন। যেমন একটি দৃশ্যে দেখি, বাঁদিকের পৃষ্ঠায় একটি কামান ছোঁড়া হচ্ছে এবং পরবর্তী পৃষ্ঠায় সেটা লক্ষ্যস্থিতিতে আঘাত করছে।

প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং মানুষের জীবনের সহজ-সাবলীল অবস্থা আঁকার পরিবর্তে, নিশিকি শিল্পকর্ম (বুটিদার সিল্ক কাপড়ে অঙ্কনচিত্র) যা তিনি তার পরবর্তী বছরগুলোতে সৃষ্টি করেছিলেন, যেমন মাস্টারপিস, ‘থার্টি সিক্স ভিউজ অফ মাউন্ট ফুজি’ সিরিজ। কোন্ বস্তুর মধ্যে কতগুলো দৃশ্যভঙ্গিমা বিদ্যমান এবং কিভাবে তারা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় তার চিত্রকর্মে তা দৃশ্যমান।
জীবদ্দশায় হোকুসাইয়ের চিত্রকর্ম জাপানের বাইরেও স্বীকৃতি পেয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিপ ফ্রাঞ্জ ভন সিবোল্ড (১৭৯৬-১৮৬৬), এদো যুগের নাগাসাকিতে অবস্থিত ওলন্দাজ বাণিজ্য কুঠির একজন অতিথি চিকিৎসক, তার রচিত ‘নিপ্পন’ গ্রন্থে ‘হোকুসাই মানগা’ (হোকুসাই স্কেচবুক বা কার্টুন)  চিত্ররচনাগুলো তুলে ধরেছেন, যা ১৮৩২ থেকে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ‘জাপোনিজমে’র জনপ্রিয়তা শুরু হওয়ার পরেই তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল।  এই বিশ্ব মেলায় তার বেশ কয়েকটি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। চিত্রগুলোতে গতিশীল এবং উজ্জ্বল রঙের নিখুঁত ব্যবহার পাশ্চাত্য শিল্প জগতে বৈপ্লবিক সাড়া জাগিয়েছিল। ফলে ইউরোপীয় শিল্পীদের ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলে এবং প্রকাশবাদের জন্ম দেয়।
শীর্ষস্থানীয় শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগ এবং এডগার দেগাসের মতো শিল্পীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তার চিত্র। গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তারা। শিল্পী হেনরি রিভিয়ার অনুপ্রাণিত হয়ে, ‘থার্টি সিক্স ভিউজ অব আইফেল টাওয়ার’ নামে লিথোগ্রাফের একটি সিরিজই তৈরি করে ফেলেছিলেন! যা হোকুসাইয়ের ‘থার্টি সিক্স ভিউজ অফ মাউন্ট ফুজি’র আধুনিক রূপ।
আর্ট নুওয়াউ আন্দোলনের একজন বিখ্যাত কাচ শিল্পী এমিলি গ্যালি হোকুসাই-এর মানগা বা স্কেচবুক থেকে নকশা গ্রহণ করে একটি ফুলদানি তৈরি করেছিলেন। সুরকার ক্লাউডি ডেবুসি ‘দ্য গ্রেট ওয়েভ অফ কানাগাওয়া’ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে, ‘থার্টি সিক্স ভিউজ অব মাউন্ট ফুজি’ সিরিজের একটি ছবি দেখে তার সিম্ফোনিক কবিতা ‘লা মের’ সৃষ্টি করেন।

১৯৬০ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব শান্তি পরিষদের কংগ্রেসে বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতির উন্নয়নে তার চিত্রকর্মের অবদানস্বরূপ তাকে বিশেষভাবে মরণোত্তর সম্মানে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৮ সালে তিনিই একমাত্র জাপানী ব্যক্তি যাকে ঞযব ১০০ গড়ংঃ ওসঢ়ড়ৎঃধহঃ ঊাবহঃং ধহফ চবড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব চধংঃ ১,০০০ ণবধৎং” রহ “ঞঐঊ খওঋঊ গওখখঊঘঘওটগ.” উপাধিতে সম্মানিত করা হয়, যা নিয়ে জাপানীরা অহংকার করতেই পারেন।  
২০২১ সালে হোকুসাইয়ের একটি বিশেষ প্রদর্শনী টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রায়শ তার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে জাপানের বিভিন্ন প্রদেশে। এবার অধিকাংশ চিত্রই ছিল মানগা বা কমিক্স সিরিজের। মানগা ম্যাগাজিনে তিনি শত শত চিত্র অঙ্কন করেছেন সুমি বা কালো রঙে। যার পরিমাণ অবিশ্বাস্য রকম বিস্ময় জাগিয়েছে।

এদো মহানগরের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাপন যে কী রকম শিল্পমনস্ক, আনন্দ বিনোদনে বৈচিত্র্যময় ছিল তা প্রকাশনা জগতের পরিধি দেখলেই বোঝা যায়। এই প্রদর্শনীতে হোকুসাইয়ের রঙিন চিত্রমালার কিছু প্রদর্শিত হয়েছিল, তবে অধিকাংশই সাদাকালো। কী সূক্ষ্ম রেখায় তিনি চিত্র এঁকেছেন এবং মুদ্রণেও পরিস্ফুট হয়েছে তা মনোযোগ সহকারে না দেখলে দৃষ্টিগোচর হয় না। কী শক্তিমান এবং মেধাবী শিল্পী ছিলেন কাৎসুশিকা হোকুসাই তা আজকের যুগেও ধারণার বাইরে বলে প্রতীয়মান হয়।

×