ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা

পুনর্পাঠ ॥ নিরপেক্ষতার প্রশ্নে

প্রকাশিত: ২৩:৫৮, ২৭ নভেম্বর ২০২০

পুনর্পাঠ ॥ নিরপেক্ষতার প্রশ্নে

পৃথিবীর সবচেয়ে নিবিড়তম অনুভূতির নাম বোধ হয় কবিতা। যে কারণে তা দ্রুত এক থেকে অন্যতে কমিউনিকেট করে। কবিতা এবং ভালবাসা শব্দ দুটিকে একজন কবি এবং একজন কবিতার নিগূঢ় পাঠক যতোটা সাবলীলভাবে কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারেন অন্য কেউ বোধহয় ততটা নয়। কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে বাদানুবাদ লেগেই আছে, এমনকি ভাললাগা-মন্দলাগা নিয়েও। একজন কবির কবিতা কারও কাছে ভাল লাগল তো অন্যকেউ তার ঘোর বিরোধী হয়ে দাঁড়াল। একজন বললেন, আহা বেশ বেশ। অন্যজন হয়ত বইটি সরিয়ে রেখে বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘যাচ্ছে তাই’। এই বিপরীত উচ্চারণের ভেতরেও কোন কোন কবিতা সকল মহলের কাছ থেকে প্রায় কাছাকাছি রকম সমাদর লাভ করে থাকে, এই সকল কবিতার কবিরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান আর সেই ভাগ্যবানদের একজন রেজাউদ্দিন স্টালিন। আজ আমি তার সাম্প্রতিক কোন গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করব না তার ব্যাপক উচ্চারিত গ্রন্থ ‘নিরপেক্ষতার প্রশ্নে’ আজ আমার পাঠকক্ষে। যদিও আমার আলোচনাকে আমি এই বইয়ের ব্যাপ্তিকে ছাড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই আরও কিছুটা দূরে। আশির দশক। বাংলা কবিতার বাক বদলের একটি উজ্জ্বল দশক। এ দশকেই সত্তরের স্লোগান নির্ভর কবিতার বিপরীতে একটি শান্তস্থির অথচ চিত্রল শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় কান্তিময় তনুশ্রী একটি কবিতা-অবয়ব। স্নিগ্ধ সে নদীতে ডেকে ওঠা শব্দের বান মানুষকে ভাবায়, ভাসায়, তাড়িত করে। এ দশকের কবিরা যতটা না রাজনীতি নিয়ে সোচ্চার তার চেয়ে অনেক বেশি প্রেম, প্রকৃতি, ঈশ্বর, নারী ইত্যাদিতে। ব্যতিক্রম যে দু’একজন তাদেরই একজন রেজাউদ্দিন স্টালিন। স্টালিন সাধারণ প্রেমকে অতিক্রম করেন তার সুবিস্তৃত কাব্য এবং চিন্তা স্বভাব দিয়ে। তার দৃষ্টিতে প্রেম শুধু নারীতে নয় তা বর্ণময় হয়ে ওঠে মানবিকতায়, এমনকি কখনও কখনও ঈশ্বরেও। তিনি মানবতা ও সাম্যবাদের পূজারি এবং পারিপার্শ্বিকতা আর সমাজের অন্যায় অবিচার অসঙ্গতি তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে- পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই সাম্যের কবির কত সহজ উচ্চারণ- ‘জন্মাবধি কোন কিছু উদ্বৃত্ত দেখিনি শস্য বস্ত্র ভূমি নৌকা প্রকৃতি পানীয় সবই অপ্রতুল অল্প আর প্রান্তিকেরও নিচে উদ্বৃত্ত দেখেছি দুঃখ অনিঃশেষ জীবনযন্ত্রণা এই বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর কোনোদেশে রপ্তানিযোগ্য কিছুই নেই দুঃখ বেদনাভরা প্রপিতামহের প্যাল্ডোরা বাক্স খানা ছাড়া’। (রপ্তানিশর্ত) রেজাউদ্দিন স্টালিনের কাব্যজীবন সুরভিত। ব্যক্তি জীবনে অভাব তাকে স্পর্শ করেনি তবুও এক মহান অনুভব তাকে নিয়ে গেছে মানুষের কাছাকাছি। মানুষের অভাব দুঃখ যন্ত্রণা তাকে স্পর্শ করেছে নিবিড়ভাবে তাই তো তার কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে আশা নিরাশা প্রাপ্তি অপ্রাপিপ্তর সেই অমোঘ বাণী- ‘যার আশা আছে সে কিছু হারায় যার স্বপ্ন আছে তার কিছু ভাঙ্গে যার আশা নেই স্বপ্ন নেই তার মন নেই সে নিরপেক্ষ অথবা মৃত’ (নিরপেক্ষতার প্রশ্নে) আশ্চর্য জীবন বোধ সম্পন্ন কবি রেজাউদ্দিন স্টলিনের এই উচ্চারণ যেন সমগ্র আশাহীন মানুষের-একান্ত কোরাস। কবিতো সমাজের বিবেক, জনতার স্বপ্নের প্রতিনিধি। সামাজিক শোষণ অসঙ্গতি তাই তো তাকে বেদনার্ত করে তোলে, বিক্ষুব্ধতায় করে তোলে শাণিত ও সোচ্চার- ‘এই দুঃসহ বেদনার বীণা আমিই বাজাতে পারি আর পেরেছিল নীরো একবার অগ্নিদগ্ধ রোমে’ (এমন বেদনা আমাকে দিয়েছ) রেজাউদ্দিন স্টালিন এতোকাল কবিতা দিয়ে জয় করে এসেছেন বাংলা ভাষাভাষী কবিতাপ্রেমিকদের অন্তর। ইদানীং তার কবিতা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। প্রায় তিরিশটি ভাষায় ইতোমধ্যে অনুদিত হয়েছে তার কবিতা। পৃথিবী সেরা প্রকাশনা সংস্থা ‘এ্যামাজান’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতার ইংরেজী অনুবাদ গ্রন্থ। অল্প বয়সে বাংলা একাডেমি লাভ করা এ কবির কবিতা যেন একটি নতুন দর্শন, যা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে সঠিকভাবে পথ চলতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং স্বপ্ন জোগায় একটি শোষণমুক্ত বঞ্চনাহীন সমতার রাষ্ট্র নির্মাণে।
×