ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

ইকোপয়েট্রি ॥ পরিবেশ সচেতন কবিতা

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

ইকোপয়েট্রি ॥ পরিবেশ সচেতন কবিতা

ঊপড়-poetry বা ইকো-কবিতা ইংরেজী কবিতার চর্চায় একটি সাম্প্রতিক ও জনপ্রিয় ধারা সংযোজন করেছে। ইকো-কবিতায় পরিবেশ সচেতনতা প্রবলভাবে এসেছে। ‘ইকোপয়েট্রি’ সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে সাহিত্য ও বহির্প্রকৃতির মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করে। ‘ইকোপয়েট্রি’ পরিবেশ, প্রকৃতি, পশু-পাখি ও মানুষের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া সম্পর্কে বিশেষ বার্তা বহন করে। রোমান্টিক কবিতার মতো এর কেন্দ্রবিন্দু প্রকৃতি হলেও রোমান্টিক কবিতার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো ইকো-কবিতায় প্রকৃতিকে শুধু নান্দনিকভাবে বা সুন্দরের মাধ্যম হিসেবে দেখা নয় এতে প্রকৃতিকে রক্ষার তাগিদ সচেতনভাবে এসেছে। আর একটি পার্থক্য হলো ইকো-কবিতায় প্রকৃতি থাকে কেন্দ্রে কিন্তু রোমান্টিক কবিতার মূল সুর মানবপ্রেম। ইকো-কবিতাতেও রোমান্টিক কবিতার মতো প্রকৃতির প্রেম, নস্টালজিয়া, অতীতমুখিতা আছে কিন্তু প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার প্রচেষ্টাটাই বেশি। ইকো-কবিতার যাত্রা, বলা যায় আনুষ্ঠানিকভাবেই শুরু হয় আমেরিকাতে ১৯৮০’র দশকে ও ইংল্যান্ডে ১৯৯০-এর দশকে। ইকো-কবিদের কবিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহারের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি এবং এখন আমরা প্রকৃতির মৌলিক জীবনীশক্তি অপব্যবহারের দিকে ধাবিত হচ্ছি। কিন্তু ইকো-সমালোচকরা বলেন, প্রকৃতির সঙ্গেও আমাদের নৈতিক আচরণ করতে হবে। এটাকে বলা যায় সাহিত্যের নান্দনিক দিক নিয়ে প্রকৃতিকে না দেখে চরমভাবে সচেতনতা ফুটে উঠেছে ইকো-কবিতায়। কারণ প্রকৃতিকে শুধু নান্দনিকভাবে বা সুন্দরের উৎসভূমি হিসেবে দেখার দিন শেষ হয়ে এসেছে। ইকো-কবিতা জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে আমেরিকাতে দুজন ব্যক্তির নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এরা হলেনÑ চেরিল গ্লোটফেলটি (Cheryl Glotfelty) ও হ্যারল্ড ফ্রম (Harold Fromm) তাদের বই ‘ইকো ক্রিটিসিজম রিডার দ্য ল্যান্ড মার্ক ইন লিটারেরি ইকোলজি’ (১৯৯৬) এটি পরিবেশবিষয়ক লেখার গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। নব্বইয়ের দশকে আমেরিকাতে ইকো-কবিতার জাগরণ লক্ষ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিভিন্ন জার্নালে, সভা এবং বিভিন্ন ধরনের বইতে ইকো-সমালোচনা গুরুত্ব পেতে থাকে। অনেকে এই কবিতাকে কবিতার একটি নতুন ও সচেতন ধারা হিসেবে বিবেচনা করতে চায়। নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গ্লোটফেলটি বলেছেন ‘ইকো কবিতা সাহিত্য ও পরিবেশের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে’, তাই ইকো কবিতাকে আমরা সাহিত্যের নতুন একটি ধারা হিসেবে ধরে নিতে পারি যা রোমান্টিক কবিতার নবতর ধারা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে; যেখানে প্রকৃতিকে রক্ষার তাগিদ আছে। ইকো কবিরা বলেন, বস্তুগত পৃথিবীকে জানতে লেখকরা তাদের লেখনীতে বস্তুগত জগত সম্বন্ধে যা লিখেছে তা বের করে আনতে হবে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে ইকো-কবিতা প্রসারে অগ্রগণ্য নাম জোনাথন বেইট (১৯৫৮-) তার লেখা ‘রোমান্টিক ইকোলজি’ (১৯৯১) ও ‘সং অব দ্য আর্থ’ (২০০০) বইগুলো ইংরেজী বিখ্যাত রোমান্টিক কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডওয়ার্থ, জন কীটস, পিবিশেলী, ব্লেকের কবিতাতে আধুনিক ইকো -কবিতার বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান করেন। বই দুটো ইকো-কবিতা চর্চায় নতুন জাগরণ সৃষ্টি করে। তবে ইকো-সমালোচনা একটা ধারণা ও ‘ইকো’ সমালোচনা হিসেবে প্রথম ব্যবহার করা হয়, যা প্রথম প্রকাশ পায়, আরও আগে আমেরিকায়, সত্তরের দশকে যখন মাইকেল পি ব্রাঞ্চ, (গরপযধবষ চ. ইৎধহপয) উইলিয়াম রুয়েকার্টের (ডরষষধস জঁবপশবৎঃ) সাহিত্য ও ইকো তন্ত্র ইকো-সমালোচনা বিষয়ক একটি গবেষণা’ (১৯৭৮) এর উপরে ছোট্ট একটা পত্র পরিবেশনা করেন। আমেরিকার ইকো-সমালোচক কার্ল ক্রোয়েবারের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে তার রচনা হোম এট গ্রাস মিয়া : ইকোলজিক্যাল হলিনেস’ (১৯৭৪) বেশ ভাল ভূমিকা রাখে। উইলিয়াম রুয়েকার্ট সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৯৭৮ সালে ইকো-ক্রিটিসিজম (ঊপড়-ঈৎরঃরপরংস) কথাটি উল্লেখ করেছিলেন। তার প্রকাশিত বই ‘লিটারেচার এ্যান্ড ইকোলজি এন এক্সপেরিমেন্ট ইন ইকোলজি’ বইটিতে তার ইচ্ছে ছিল ইকোতান্ত্রিক ধারণাকে কীভাবে সাহিত্যের আওতায় আনা যায়। তিনি এতে সফল হন কারণ এরপর থেকেই আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকো-ক্রিটিসিজম পড়ানো শুরু হয়। এরপরে ‘ইকো-ক্রিটিসিজম’ সূচনায় দুটি যুগসৃষ্টিকারী রচনার নাম করা যায় যার দুটোরই সূচনা নব্বইএর দশকে এগুলো হলো চেরিল গ্লোটফেলটির ‘দ্য ইকোক্রিটিসিজম রিডার’ (১৯৯৬), ও লরেন্স বুয়েলের ‘দ্য ইনভিরনমেন্টাল ইমাজিনেশান’ (১৯৯৬)। ইকো-কবিতা প্রকৃতির সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত যেখানে দায়িত্ব ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। এই দায়িত্ব সচেতন মানুষকেই পালন করতে হবে কারণ প্রকৃতির যে রক্তাক্ত পরিণতি তার জন্য আমরা কেউই দায়মুক্ত হতে পারি না। রোমান্টিক কবিদের মতো প্রকৃতি, পরিবেশ, পাখ-পাখালী, প্রাণী, নদী, ফুল-ফসল, জলধারা ইত্যাদি বিষয়গুলো অবশ্যই ইকো-কবিতার বৈশিষ্ট্য; যেখানে এই প্রকৃতির মনোহর সৌন্দর্য হারিয়ে যাবার বেদনা ও এগুলো রক্ষার আহ্বান এসেছে বহুরূপী কাব্যিক ব্যঞ্জনায়। ইকো-কবিতাকে বর্তমান জটিল সময়ের অনিবার্য উপজাত হিসেবে ধরা যেতে পারে। যখন প্রতিদিন কোন না কোন পাহাড় কাটা পড়ছে, খাল, বিল, নদী ভরাট হচ্ছে, চামড়া, দাঁত, মাংসের জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার পশু-পাখি নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তখন এই ধরনের স্পর্শকাতর-লেখনীর উদ্ভব হওয়া সময়ের স্বাভাবিক দাবি। এছাড়াও বড় বড় পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাদ কাঠামোর উপর ও অর্থনৈতিক মুনাফার উপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করে দ্রুত সম্পদশালী ও তথাকথিত ক্ষমতাবান হওয়ার অন্ধ পাঁয়তারা তো আছেই। বর্তমান বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলছে প্রকৃতির সর্বশেষ শক্তি, সম্পদের যথেচ্ছ অপব্যবহারের লধহধশধহঃযধ; এমন কোনস্থান নেই যেখানে সভ্যতা তার শিরা উপশিরা বিস্তার করেনি; তার প্রযুক্তি যায়নি; এবং এর বিষাক্ত উপজাত নেই। পরিবেশগত হস্তক্ষেপ বেশি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক। তাই প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ নিয়ে প্রকৃতি কবিতা লেখার মতো কিছু নেই যা আছে এর ধ্বংসযজ্ঞ আর আসন্ন মৃত্য নিয়ে লেখা। মানুষের স্বর্ণালি সভ্যতা যেখানে দাঁড়িয়ে তার নিচেই রয়েছে মরে যাওয়া প্রাকৃতিক মন ও এর ধ্বংসস্তূপ। প্রকৃতিকে বাঁচাতেই আসলে ‘ইকো-ক্রিটিসিজম’ এর জন্ম তাই ‘ইকো-ক্রিটিসিজম’ কে ইকো-কবিতার সহোদরও বলা যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মুনাফা, চোরাচালান ও পুঁজিবাদিতার আসক্তি প্রকৃতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। ‘ইকো-পয়েট্রি’ কবিতার ধারণা আসে গ্রিক শব্দ ড়রশড়ং থেকে আর ড়রশড়ং মানে বাড়ি আর কবিতাগুলোর বৈশিষ্ট্য হবে প্রকতিৃ ও বন নির্মাণ এই কথাটিই ঞযড়ৎবধ বলে গেছেন অনেক আগেই যার কবিতাতেও ইকো-কবিতার কিছু চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়; তার ভাষায় প্রতিধ্বনিত ‘প্রতিটি ভাল জিনিস বন্য ও স্বাধীন’। ইকো-কবিতার জগতে আর একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে নেইল এ্যাসলে (১৯৫৩-) সম্পাদিত ‘আর্থ স্যাটারিং ইকো পয়েমস’ (২০০৭) এই বিরাট কবিতার সংগ্রহ শালায় পরিবেশবাদী কবিতা থেকে শুরু করে প্রকৃতিবিষয়ক পরিশুদ্ধ কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো পরিবেশগত ধ্বংস এবং ইকোতান্ত্রিক ভারসাম্যের কথা বলে। তাছাড়াও কবিতাগুলো উষ্ণায়ন, আবহাওয়ার পরিরর্তন, প্রজাতির বিলুপ্তি ও আসন্ন পরিবেশগত আশঙ্কারও কথা বলে; কবিতাগুলোতে এই বিষয়গুলোর উপর সতর্কবার্তা আছে। দ্রুত ধ্বংস-প্রায় পৃথিবীর প্রতি আশঙ্কা থাকলেও কবিতাগুলোতে নতুন করে চিন্তা করার ও আশার বাণীও আছে। বইটির আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এখানে হাল-আমলের লেখক যেমন রবিনসন জেফারস (১৮৮৭-১৯৬২), চার্লটে মিউ (১৮৬৯-১৯২৮), ওয়েনডেল ব্যারি (১৯৩৪), ডব্লিউএস মারউয়িন (১৯২৭-), গ্যারি স্নাইডার (১৯৩০-) ইত্যাদি আধুনিক প্রকৃতি বা ইকো-কবিদের সঙ্গে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, জন কীটস, হপকিনসকে অন্তর্ভুক্ত করা। প্রথাগত প্রকৃতিবিষয়ক কবিতা থেকে ইকো-কবিতা ভিন্ন ধরনের। এখানে প্রকৃতি মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কথা বলা হয় এবং পৃথিবীকে পোষ মানানো ও যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে বলা হয়; এমন একটি পৃথিবীর কথা বলা হয় যা প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন, প্রযুক্তি শাসিত, স্বেচ্ছাচারিতাপূর্ণ ও অর্থনৈতিক শক্তির পূজারি। ‘আর্থ স্যাটারিং ইকো পয়েমস’-এর উল্লেখ যোগ্য একটি কবিতা ‘লাইফ ফ্রম লাইফলেস’ এ রবিনসন জেফারস বেদানাসক্ত মনে প্রকৃতির অবক্ষয় দেখেন- ‘ফুল মরে যায়, বিবর্ণ ঘাস, অবসন্ন গাছ বন জ্বলছে শুধু বেঁচে যায় পাথরগুলো’ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধবংসাত্মাক শক্তিগুলো যেগুলো ধীরে ধীরে খুব নিয়মিত হয়ে উঠছে তা ইকো- কবিতার একটি জরুরী অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতি আসক্তি, পৃথিবীর বুকচিরে তেল, কয়লা তুলে শস্য ক্ষতি করে বায়োগ্যাস উৎপাদন ও অত্যাধুনিক গাড়ি চালনা ধরিত্রীকে করে তুলছে শুষ্ক, নিষ্ফলা আর অনুর্বর। শুধু কবিদের সচেতনতা এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে কতখানি টেকসই হতে পারে তা দেখার বিষয়। তবু কবিরা আশাবাদী তাদের কবিতা পাঠকদের মাঝে গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এক্ষেত্রে মারিও পেটুরেজ্জি (১৯৫৮-) রচিত কবিতাগুলো পেট্রলিয়াম তেলের যথেচ্ছ ব্যবহার, তেল যুগের আসন্ন অবসান, উষ্ণায়নের মতো ব্যাপারগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে জেমস এনগেলহার্ডেট ইকো-কবিতার নীতিগত দিকটির কথাই তুলে ধরেছেন কারণ তার মতে “ঊপড়ঢ়ড়বঃৎু রং ংঁৎৎড়ঁহফবফ নু য়ঁবংঃরড়হং ড়ভ বঃযরপং. রবিনসন জেফারস একজন খাঁটি ও শক্তিশালী ইকো-কবি এবং ইকো-কবিদের মধ্যে তাকে প্রধানতম একজন ভাবা হয়। তিনি তার কবিতায় প্রকৃতি, গাছ, পশু-পাখি তথা পরিবেশ ও প্রতিবেশকে মানুষের সঙ্গে সমান সম্মান দেন। তার ‘হার্ট হোক’ কবিতায় একটি মৃতপ্রায় বাজপাখির মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বলেনÑ ‘আমি বরং একজন মানুষকে মেরে ফেলবো পাখিটির বিনিময়ে’। এজন্য অবশ্য তাকে সমালোচনার শিকার হতে হয়। গ্যারি স্নাইডারকে (এধৎু ঝহুফবৎ) গভীর ইকো জগতের রাজ কবি বলা হয়। কবিতায় তিনি পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত। ¯œাইডারের মাঝে প্রকটভাবে প্রাচ্য ভাবধারা আর ধর্মের প্রভাব পড়েছিল; হয়ত প্রাচ্য জীবনধারাতে তিনি জীবনের সহজ সরল আর গভীর তাৎপর্য লক্ষ্য করেছিলেন। তেমনিভাবে তার কবিতার ভাষাও সহজ সরল নমনীয়। তার কবিতায় প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার, আধ্যাত্যবাদ, অধিবিদ্যা এক হয়ে গেছে। ¯œাইডার রোমান্টিক কবিদের মতো প্রকৃতির মাঝে মহত্তমের খোঁজ করেছেন। ¯œাইডার তার ‘মাদার আর্থ : হার হোয়েলস’ কবিতায় জাপান ব্রাজিল ,আমেরিকা , চিনের মতো ধনী রাষ্ট্রগুলোর নির্বিচার শিল্পায়নের উপজাতে ক্ষতবিক্ষত জীববৈচিত্র্যের বিভীষিকাময় অস্তিত্ব বর্ণনা। কবিতার এক অংশে জাপান ও চীনকে নিন্দা করা হচ্ছে- ‘এক সময়ের মহৎ বৌদ্ধ দেশ চুইয়ে দেয় মিথাইল বিষ সমুদ্র যেন গণোরিয়ায় আক্রান্ত আহা চীন, তোমার বাঘগুলো কই, বন্য শুকোর বানরেরা’? ’ ‘সিলভিয়া প্লাথ’ (১৯৩২-১৯৬৩) তার কবিতায় বন্য প্রাণী ধ্বংসের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তুলে ধরেন। প্রতিবছর আমেরিকায় বিলিয়ন বিলিয়ন পাখি মেরে ফেলা হয় শুধু খেলার ছলে। তার এমনি একটি কবিতা ‘স্পারো’ এই কবিতায় পাখিটিকে হত্যা না করার প্রতি তার আর্তি ফুটে ওঠে: ‘তুমি বলেছো আজ সকালে ওকে মেরে ফেলবে। ওকে মেরোনা আজও ও আমাকে চমকায় তুমি মেরো না কালো মাথা নিয়ে ও আরো উড়বে।’ ইকো-কবিরা এই গ্রহের জন্য দায়িত্বের কথা বলে। কারণ সকলের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্কই নিয়ে আসতে পারে সার্বিক কল্যাণ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। আরেক কানাডিয়ান নারী কবি টি ডি. ব্রানডান্ট (১৯৫২- )। তার “নাউ ইউ কেয়ার ২০০৩ কবিতাগ্রন্থে নারীবাদী উষ্ণতা ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আছে। তার কবিতা বসুন্ধরার প্রতি আন্তরিকতাপূর্ণ ও পুরোপুরি প্রকৃতি-নিবদ্ধ। দূষণ, ব্রেস্ট ক্যান্সার, ব্যস্ততার পাগলামী তার কবিতার শাসালো দিক। পুরুষের অন্তহীন একগুঁয়েমি, কারখানার দুষ্টতা, এমনকি নাফটার সমালোচনা তার কবিতাকে ইকো-রাজনৈতিক মাত্রা দিয়েছে। প্রকৃতির অবক্ষয়ে তার কণ্ঠ আলোড়িত ও আবেগতাড়িত। তার ‘জোন লা ডেট্রয়েট’ কবিতায় আধুনিক সভ্যতার যান্ত্রিকতায় তিনি সমালোচনামুখর- ‘খ-ে খ-ে উড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীটা কার আর কার আর ট্রাক, বিদ্যুত আর কার, বৃহস্পতিবার নয়টার সময় এক সন্ধ্যায়? অমি গুনলাম ২০০ ট্রাক আর ৩০০ কার আর এটা শুধু লন্ডনেই। দেখ ডেট্রয়েটের আকাশ কী অসম্ভব তার রঙ!’ মেরি অলিভার আমেরিকান পুলিৎজার বিজয়ী (১৯৮৪)। তার কবিতায় রবীন্দ্রনাথের মতো প্রকৃতির সঙ্গে একনিষ্ঠ হতে দেখা যায়। প্রকৃতির মাঝে তিনি সত্তার জাগরণ দেখেন। তিনি প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু কণা, গাছপালা ও পশুপাখিকে সমান মূল্য দেন। প্রযুক্তিশাসিত বিশ্ব যখন প্রকৃতিবিমুখ তখনই তার কবিতা প্রকৃতির জয়গান গায় প্রকৃতি আর পশুপাখিকে করে তোলে মূল্যবান। তার ‘সং অব দ্য বিলাডারস’ কবিতায় তিনি দেখান একটি ঝিঁঝিঁ পোকাও কীভাবে প্রকৃতির অংশ হয়ে প্রকৃতি নির্মাণ করে যাচ্ছে- ‘এভাবেই চলতে থাকবে আমরা সবাই ধাবমান আমাদের অব্যক্ত নিয়মে তৈরি করে যাই পৃথিবী। পরিবেশ সচেতনতার বিষয়টি কে যদি প্রকৃতি-কেন্দ্রিক রাখি তা হলে বলা যায় ইকো-কবিতা অনেক পুরনো ধারা। প্রকৃতির সৌন্দর্য বা নান্দনিকতা, আধ্যাত্মিকতা, গভীর বেদনাবোধ প্রকৃতির লধহধশধহঃযধ স্বত্বার জাগরণ, ইত্যাদি বিষয়গুলো সুদূর অতীত থেকে কবিদের কবিতার মূল বিষয় ছিল। বিখ্যাত আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুয়িটম্যান (১৮১৯ -১৮৯২) এর কবিতায় পশ্চিমা ইকো-কবিতার সমৃদ্ধ রূপ ধরা পড়ে। তার ‘লিভস অব দ্য গ্রাস’ কাব্যে অতি ক্ষুদ্রতর সৃষ্টির জয়গান শুনতে পাওয়া যায়। তার উল্লাস কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিকে নিয়ে। তার কবিতায় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির ঐক্যের কথা আছে। কীটস, শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হুইটম্যান, রবার্ট ফ্রস্ট ও রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতায় সচেতন বা প্রচ্ছন্নভাবে প্রকৃতির ধ্বংসের প্রতি সহমর্মিতাবোধ এসেছে। সচেতন না হলেও অবচেতনভাবে হলেও রোমান্টিকদের মাঝে ইকো সচেতনতা কাজ করেছিল। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নাম বিশেষভা্েব বলতে হয়। তার ‘পল্লী প্রকৃতি’ প্রবন্ধে ও ‘বনবাণী’ কাব্যে, ‘বলাই’ গল্পে, ‘রক্তবরবী’ ও ‘মুক্তধারা’ নাটকে ও ‘দুই পাখি’ ও ‘প্রশ্ন’ কবিতায় (‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো, তুমি কি বেসেছ ভাল?) পরিবেশ সচেতনতা এসেছে খুবই সচেতনভাবে। ‘মুক্তধারা’ নাটকে আধুনিক যন্ত্র দানবের কথা এসেছে এবং মানুষ কীভাবে বাঁধ নির্মাণ করে প্রকৃতির জলধারাকে বাগে এনে প্রকৃতির উপর অবিচার করে এতে তার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ‘রক্তকরবী’ নাটকে দেখতে পাওয়া যায় মাটি খুঁড়ে প্রকৃতি বিনাশী রাজার সোনার প্রতি লোভ। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই পাখি’ কবিতায় বনের পাখি ও খাঁচার পাখি প্রকৃতি ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে। কবি আমাদের প্রকৃতির কোলে ফিরে যেতে বলেন। তার ডাক- ‘ফিরে চল মাটির টানে’ বা ‘এসো নীপবনে ছায়া বিথী তলে, করো ¯œান নব বারি ধারা জলে’। ভন গ্যটের কবিতাও (১৭৪৯-১৮৩২) ইকো-কবিতার বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল। তার কথায় ‘আমি পৃথিবীকে কল্পনা করি একটা অতিকায় জীবন্তস্বত্বা হিসেবে যে-সর্বদা নিশ্বাস নেয় ও ছাড়ে।’ রোমান্টিক কবিদের দেখানো পথে প্রকৃতির প্রতি আরও সচেতনতা নিয়ে নতুন ধারার কাব্য আন্দোলন গড়ে উঠছে। রোমান্টিক কবিতার নবতর শাখা হিসেবে প্রকৃতিপ্রেমী একদল নতুন কবিদের আবির্ভাব ঘটছে; যারা ইকো-কবি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন; যারা প্রকৃতিকে নান্দনিকভাবে দেখার পাশাপাশি একে রক্ষার পেছনেও সচেতনভাবে সোচ্চার। পরিবেশ সচেতন সবার আশা এই নবতর কবিতার ধারা আরও ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে সব সচেতন মননে। আর এই কবিতা পরিবেশ আন্দোলনের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
×