ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

তাহেরা বেগম জলি

সবার উপরে মানুষ সত্য

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২১ অক্টোবর ২০১৬

সবার উপরে মানুষ সত্য

মৃত্যুদূত যখন আমাকে তাড়া করে ফিরছে, তখন তিনজন তরতাজা যুবক পৌঁছে দিয়েছিল আমাকে জীবনের প্রান্তে। সহপাঠী, সহযোদ্ধা- এমন কি মিছিলের অগণিত পা, তার সিংহভাগই এদেশের পবিত্র যুবক সম্প্রদায়। আমার জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে অন্যায়ের কাছে হার না মানা আমার দেশের দামাল ছেলেদের উন্নত শির। আমার জীবনের প্রতিটা কর্মযজ্ঞে পুরুষ সমাজের উজ্জ্বল উপস্থিতিই তাদের প্রতি আমার সমীহের উৎস। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করেছিলাম, নারী-পুরুষের যৌথ শক্তিই কোন কাজের প্রকৃত পরিণতিতে পৌঁছানোর মন্ত্রশক্তি। আজ যে, নারীজাতি অন্ধকারের এপিঠে আলোর সন্ধান পেয়েছে, এখানেও কৃতিত্বের অনেকটা জুড়ে আছে পুরুষের পদচারণা। অনেকেরই জানার কথা, নারী সমাজের আজকের আধুনিক পোশাকের কথা উঠলে, জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নাম-ই উঠে আসবে আগে। বেগম রোকেয়াই আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ। কিন্তু রাজা রামমোহন, মহান বিদ্যাসাগরের আলোর নিশানা ছাড়া বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব কল্পনা করা যায় না। সময়ের গতি পথের কোন একটা বাকে এসে নারীসংগ্রাম ভিন্নতা অর্জন করেছিল সময়ের প্রয়োজনেই। পুরুষ মানুষকে অসম্মান করতে নয়। বরং আদিম সময়ে সামাজিক বিভাজনের শিকার, নারী সমাজের কারাবাস মুক্তির নিশানা চিহ্নিত করা হয়েছিল ওইভাবেই। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে নারী সমাজ আজ প্রতিভা, সাহস, এমন কি শারীরিক শক্তিতেও প্রমাণ করছে, সেদিন দূরে নয়-সদল্বলে আমরা তারস্বরে বলব, আমরা তো মানুষ। মেয়ে মানুষ তো নই! এবং নারী সমাজের এই বিস্ময়কর উত্থান, নারী-পুরুষের সমন্বিত কর্ম সাধনারই সুফল। এভাবেই একটা সমাজ সামনে এগিয়ে যায় পেছনের অন্ধকারকে চোখ রাঙিয়ে। এবং স্তরে স্তরে পরাস্ত হয় সমস্ত পশুশক্তি। আমরা যে দেখছি আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষ? এ দৃশ্য মানব জাতির সাধারণ চরিত্র ধারণ করে না। সমাজের অশুভ দানবীয় শক্তি, অলস-ভোগবাদী জীবনের নেশায় সৃষ্টি করেছে এই কৃত্তিম বিভাজন। এ সঙ্কট উত্তরণের নজির এবং উপায় পৃথিবীর ইতিহাসে আছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলেই নারী জাতি পেয়েছিল তাদের ভোটের অধিকার, হয়ে উঠেছিল সমাজের দাবিদার। এবং তারপর দেশে দেশে বেজে উঠেছিল নারী অধিকারের জয়ডঙ্কা। নারীজাতি সেখান থেকে পিছু হটেছে, এমনটা এখনও দৃশ্যমান নয়। আমাদের দেশে সত্যিই এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী পথ পাড়ি দিচ্ছি এদেশের নারী সমাজ। দেশের অন্যান্য অরাজকতার সঙ্গে এটা বিচ্ছিন্ন করে দেখার ফলেই, আমাদের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে শুধুমাত্র পুরুষ সমাজের উপর। আর এতে করে, সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু, বর্তমান অমানবিক সমাজ থেকে যাচ্ছে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটা ঠিক, স্বাধীন গোত্র হিসেবে নরজাতির দায় খানিকটা হলেও বেশি। নারী সমাজের সংগ্রাম শুধুই নারী সমাজের-এভাবে ভাবলে হয়ত শুধু অন্ধকারেই আমাদের ঘুরপাক খেয়ে মরতে হবে। এই সুযোগে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে কায়েমি স্বার্থবাদী দুর্বৃত্ত সমাজ। নারী পরাধীনতার উৎস, আমাদের সামনে এগোনোর সহায়ক হবে। কিন্তু কিছুতেই তা নারী-পুরুষ বিভাজনের উপাদানে পরিণত হবে না। নারী-পুরুষ মিলেই সমাজ। সঙ্কট যেভাবেই তৈরি হোক-সমাধানের দায় মানুষ হিসেবে উভয়ের। সে ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা স্বাধীন মানুষ যারা, ঐতিহাসিকভাবে তাদের ঘাড়েই বর্তায় এই মহান দায়িত্ব। নারী-পুরুষের এই চূড়ান্ত বৈরি সম্পর্ক কিছুতেই সভ্যতার পরিণতি হতে পারে না। মানুষ এমন দানবীয় শক্তি নিয়ে আরেকজনের উপরে আঁছড়ে পড়তে পারে-এ অসম্ভব। কখনও সত্য হতে পারে না, মানুষ নই, আমরা শুধুই নারী পুরুষ। ‘কুহেলিকা যত বড় ঘটা করেই সূর্যালোক ঢেকে দিক তবু সেই মিথ্যে। সূর্যই ধ্রুব।’- ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ই
×