
মঙ্গলবার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলের কয়েকটি বাস পুড়ে যায়
ইরান ও ইসরাইল একে অন্যকে লক্ষ্য করে হামলা অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার পঞ্চমদিনের মতো এসব হামলা চলে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও দেশটির সামরিক গোয়েন্দা অধিদপ্তরে সফলভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। মঙ্গলবার ভোরে চালানো এই হামলায় মোসাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন ধরে যায়। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে জ¦লতে থাকা কেন্দ্রীয় কাযালয়ের একটি ভিডিও প্রকাশ করে ইরান। অবশ্য এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে ইসরাইল।
দেশটির কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ। এরপরই ইরানের রাজধানী তেহরানসহ অন্যান্য এলাকায় বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। এতে কয়েকজন হতাহত হয়। এরপর ইরান ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিব ও জেরুজালেমের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে অন্তত ২০ দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইরানের বিপ্লবি গার্ড-আইআরজিসি জানায়, তাদের অ্যারোস্পেস ফোর্স ইউনিটগুলো মোসাদের বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান পরিচালনা করেছে।
ইসরাইলের অত্যন্ত উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আমরা ইসরাইলের হার্জেলিয়ার গোয়েন্দা ভবন, মোসাদ এবং আমান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তর লক্ষ্য করে সফল হামলা চালিয়েছি। মোসাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত কেন্দ্রে এখনও আগুন জ্বলছে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আমি ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে ‘যুদ্ধবিরতির চেয়ে ভালো’ কিছু চাই। তিনি বলেন, এ সংঘাতের ‘একটি সত্যিকার সমাপ্তি’ দরকার। একই সঙ্গে ট্রাম্প বলেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারবে না। খবর ইরনা, পার্স টুডে, আলজাজিরা ও বিবিসি অনলাইনের।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন সময় এই মন্তব্য করলেন যখন দেশ দুটির মধ্যে সংঘাত পঞ্চম দিনে গড়ায়। ট্রাম্প আরও বলেন, ¯্রফে যুদ্ধ বিরতি নয়। আমি ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে একটি সত্যিকার সমাপ্তি চাই। এরপরই ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, যুদ্ধবিরতির আলোচনার জন্য তিনি এখনো ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে তেহরানের একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করা উচিত। ট্রাম্প বলেন, ইরান যদি কথা বলতে চায়, তারা জানে কীভাবে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
তেহরান থেকে লোকজন সরানোর আহ্বান প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, এটি কোনো নির্দিষ্ট হুমকির কারণে নয়, বরং পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষের নিরাপত্তার জন্যই। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু চাই মানুষ নিরাপদে থাকুক যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। তাই নিরাপদ থাকাই ভালো। মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন মার্কিন সেনা বা সম্পদ নিয়ে উদ্বেগ আছে কি না -এমন প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, যদি ইরান তাদের স্পর্শ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এত জোরে পাল্টা জবাব দেবে তা দেশটি টের পাবে।
এ সপ্তাহে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও স্টিভ উইটকফকে ইরানের সঙ্গে বৈঠকে পাঠানোর খবর সম্পর্কে ট্রাম্প বলেন, ‘হতে পারে। হতেই পারে। আমি দেশে ফিরে কী অবস্থা পাই, তার ওপর নির্ভর করছে।
ইরান-ইসরাইল সংঘাত শুরুর পর এই প্রথমবার মুখ খুললেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ইরান-ইসরাইল সম্পর্ক নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ‘হঠাৎ উত্তেজনা বৃদ্ধি’ পাওয়ায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উল্লেখ্য, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক মিত্র চীন।
চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, চীন ‘অন্য কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখ-তা লঙ্ঘনকারী যে কোনো কর্মকা-ের’ বিরোধিতা করে। তিনি আরও বলেন, সামরিক সংঘাত কোনো সমস্যার সমাধান নয়। আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ানো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত স্বার্থে নয়।
কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিয়োয়েভের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট এসব কথা বলেন। তিনি সেখানে দ্বিতীয় চীন-মধ্য এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, সব পক্ষকে যত দ্রুত সম্ভব এই সংঘাত প্রশমনে কাজ করতে হবে। চীন শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ‘গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত’।
মঙ্গলবার ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের অন্তত চারটি স্থানে আঘাত হানে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরাইলের মধ্যাঞ্চলের হার্জলিয়া শহরের একটি আটতলা ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় শহরটিতে একটি ফাঁকা বাসে আগুন ধরে যায়।
ইসরাইলের জরুরি বিভাগ জানায়, ইরানের সর্বশেষ এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ এবং দেশটির সামরিক বাহিনীর নতুন শীর্ষ কমান্ডার মেজর জেনারেল আলী শাদমানিও ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন বলে দাবি ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী- আইডিএফের। মেজর জেনারেল আলী শাদমানি ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ড হেডকোয়ার্টার খতম-আল আলবিয়া এর প্রধান ছিলেন।
১৩ জুন ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ইসরাইলের বিমানবাহিনী রাজধানী তেহরানসহ ইরানের ৮ শহরে বোমা বর্ষণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিহত হন খতম-আল আলবিয়ার শীর্ষ নির্বাহী লেফটেন্যান্ট জেনারেল গোলাম আলী রশীদ। তিনি নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, অর্থাৎ ১৩ জুন সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল শাদমানিকে খতম আল আলবিয়ার শীর্ষ কমান্ডার ও নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেন খামেনি।
মেজর জেনারেল শাদমানি ইরানের সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে সিনিয়র কমান্ডার ছিলেন। এছাড়া তিনি ছিলেন ইরানের অতি অল্পসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন, যার সঙ্গে খামেনির ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে শাদমানির নিহত সম্পর্কে ইরানের সামরিক বাহিনী কোনো মন্তব্য করেনি।
উত্তেজনা হ্রাসের আহ্বান জি-৭ নেতাদের ॥ কানাডায় অনুষ্ঠিত জি৭ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতারা সোমবার ইরানে ‘উত্তেজনা কমানোর’ আহ্বান জানিয়ে একটি যৌথ বিবৃতি জারি করেন। তবে তারা একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান সংকটে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা নিশ্চিত করছি যে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। ‘আমরা ধারাবাহিকভাবে স্পষ্ট করে বলেছি যে ইরান কখনও পারমাণবিক অস্ত্র রাখতে পারবে না। ‘আমরা জোর দিয়ে বলছি যে ইরান সংকটের সমাধান হলে গাজায় যুদ্ধবিরতিসহ মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে বৈরিতা হ্রাস পাবে।’
ইরান থেকে ছয়শরও বেশি বিদেশি আজারবাইজানে ॥ শুক্রবার ইরানে হামলা শুরু করার পর থেকে প্রতিবেশী দেশ আজারবাইজানে ১৭টি দেশের ছয়শর বেশি নাগরিক চলে এসেছে বলে জানিয়েছে দেশটি।
বাকুতে এক সরকারি সূত্র জানায়, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা শুরু হওয়ার পর থেকে ১৭টি দেশের ছয়শরও বেশি নাগরিক ইরান থেকে আজারবাইজানে প্রবেশ করেছে। এসব নাগরিক আজারবাইজান ও ইরানের সীমান্তবর্তী আস্তারা চেকপয়েন্ট দিয়ে কাস্পিয়ান সাগর উপকূল অতিক্রম করে আজারবাইজানে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তাদের বাকু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেওয়া হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আজারবাইজানে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, সার্বিয়া, রোমানিয়া, পর্তুগাল, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন ও ভিয়েতনামের নাগরিক। আজারবাইজান ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় তার স্থলসীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং এরপর থেকে তা বন্ধই ছিল।
সংঘাত বন্ধে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত রাশিয়া ॥ ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান সংঘাত বন্ধে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত রাশিয়া। আল জাজিরা জানিয়েছে, মঙ্গলবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এ কথা জানিয়েছেন। এদিন নিয়মিত এক ব্রিফিংয়ে পেসকভ বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত বন্ধে প্রয়োজনে রাশিয়া মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত।
তবে পেসকভ বলেন, ‘বর্তমানে আমরা অন্তত ইসরাইলের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের মধ্যস্থতা গ্রহণ বা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে যাওয়ার আগ্রহ দেখছি না।’ ইরান রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও, রাশিয়া বহু বছর ধরেই ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ইসরাইলকে দূরে ঠেলে না দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করছে মস্কো। মস্কোর স্টেট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের সহকারী অধ্যাপক নিকোলাই সুরকভ আল জাজিরাকে বলেন, রাশিয়া একটি অত্যন্ত জটিল ভারসাম্যের খেলা খেলছে। দেশটি আন্তরিকভাবেই একটা রাজনৈতিক সমাধান চায়।