ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা শুরু

বইয়ের পৃথিবী, সারা বিশ্বের বইপ্রেমীদের মহোৎসব

মোরসালিন মিজান, ফ্রাঙ্কফুর্ট, জার্মানি থেকে 

প্রকাশিত: ২২:৫২, ১৮ অক্টোবর ২০২৩

বইয়ের পৃথিবী, সারা বিশ্বের বইপ্রেমীদের মহোৎসব

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার প্রথম দিন... নান্দনিক সব স্টল ঘুরে বই দেখছেন বইপ্রেমীরা

বই নিয়ে এত বড় মেলা, এত বড় উৎসব হতে পারে! চোখে না দেখলে আসলেই তা বিশ্বাস করা কঠিন। হ্যাঁ, বলছি ফ্রঙ্কফুর্ট বইমেলার কথা। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই বইমেলা বুধবার ইউরোপের দেশ জার্মানিতে শুরু হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১০০ দেশের প্রকাশক, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিকসহ বই ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যোগ দিয়েছেন মেলায়। সবার উপস্থিতিতে প্রথম দিনেই দারুণ সরব হয়ে উঠেছে আয়োজনটি।
দিনভর মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে মনে হয়েছে, এ যেন এক বইয়ের পৃথিবী। সাধারণ ধারণা এমন যে, বইয়ের দিন শেষ হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতে বই কোথাও নেই। বই পড়ার সময় নেই মানুষের। পাঠভ্যাস শিকেয় উঠেছে।

সবার হাতে মোবাইল ফোন। ফেসবুকে ইউটিউবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটালেও বই নিয়ে আগ্রহ নেই। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা হতাশার পরিবর্তে স্বপ্নের কথা বলছে। এখানে বই আর বই। সকল গল্প আড্ডা আলোচনা তর্ক-বিতর্ক সবকিছু বইকে ঘিরেই। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বইয়ের মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য এখানে এসেছেন। হাজার হাজার মানুষ। প্রত্যেকেই বইয়ের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। বিশেষ করে প্রকাশক এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অসংখ্য স্টল সাজিয়ে বসেছেন। কেউ বইয়ের স্বত্ব বিক্রয় করছেন। কেউ কিনছেন। আর বইপ্রেমী মানুষেরা কৌতূহল নিয়ে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মেলায় বেশ কয়েকটি বড় বড় হলঘর। এক একটি হলের আয়তন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের চেয়েও বড়।
এক ঘণ্টা ধরে দেখলেও একটি হলঘর দেখে শেষ করা যায় না। এ ভাবে প্রত্যেকটি হল ঘুরে দেখতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। হলের ভেতরে বিভিন্ন দেশের স্টল। সব স্টলেই বই সাজানো। একটি স্টল বা প্যাভিলিয়ন কত সুন্দর করে সাজানো যেতে পারে, কাঠামো কত সুদৃশ্য হতে পারে, শৈল্পিক বিন্যাস কত আকর্ষণীয় হতে পারে মেলা ঘুরে সেটা উপলব্ধি করা যায়। প্রতিটি স্টলে টেবিল চেয়ার পাতা। আলোচনা চলছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে এক দেশ বা এক ভাষার বই অন্য দেশ বা অন্য ভাষায় অনুবাদ করার চুক্তি হচ্ছে। এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে বই। ভাষা বা দেশ কোনো বাধা হচ্ছে না।
মেলার ৩ নম্বর হলে মূলত জার্মানির প্রকাশকরা স্টল ও প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছেন। বড় ও সুবিন্যস্ত প্যাভিলিয়নগুলোতো বটেই, সাধারণ স্টলগুলোও ভীষণ আকৃষ্ট করে। একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম এরিনা। মেলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন যারা তাদের একজন বিয়াংকা কুছেনবোরড। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, প্রতি আধাঘণ্টা পরপর একটি মিটিং করতে হচ্ছে তাকে। অন্যান্য দেশের প্রকাশকদের সঙ্গে মিটিং করছেন তিনি। এই মিটিংয়ের মাধ্যমে জার্মান ভাষায় লেখা শিশুতোষ বইয়ের স্বত্ব বিক্রি করছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কেও জানেন। বলছিলেন, বাংলাদেশেও একটি মেলা হয় বলে তিনি শুনেছেন। অমর একুশে বইমেলার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে মেলাটির ব্যাপারে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়েরও খোঁজখবর নেন।
ইকুয়েডর থেকে মেলায় এসেছেন সাউল অরথেগা। লিভরারিয়া নামের একটি পাঠাগারের পক্ষ থেকে বইয়ের স্বত্ব কিনতে এসেছেন তিনি। এবারই প্রথম মেলায় আসা। কথা প্রসঙ্গে এই তরুণ জানান, এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১১টি বইয়ের স্বত্ব ই-কমার্স এর মাধ্যমে কিনেছেন তিনি। জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ‘সরি’ বলে উঠে পড়েন। জানান, তার একটা মিটিং আছে। এভাবে সবাই আসলে বৈঠক করছেন বইকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে। এবারের মেলার থিম কান্ট্রি স্লোভেনিয়া। একাধিক স্থানে তারা তাদের দেশীয় ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতিসহ নানা কিছু উপস্থাপন করছেন। থিম কান্ট্রি হওয়ায় মেলায় আগতরা একবারের জন্য হলেও স্লোভেনিয়ার হলঘরে যাচ্ছেন।

যতভাবে সম্ভব তারা তাদের বই, তাদের লেখকদের উপস্থাপন করেছে। দেশটির দাবি, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কবি তাদের দেশে জন্ম নিচ্ছে! ঘুরেফিরেই তারা তাদের কবিরের কথা বলছেন। কবিতার কথা বলছেন। ইতালি থেকেও অনেক প্রকাশক মেলায় অংশ নিয়েছেন। সংখ্যাটা ৬০ এর বেশি হবে। মেলার প্রবেশপথে বা বের হয়ে যাওয়ার সময় তাদের দেশের পক্ষে বিভিন্ন প্রচার লক্ষ্য করা যায়।
এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো মূলত স্থান পেয়েছে ৬ নম্বর হলঘরে। এখানে চীন দক্ষিণ কোরিয়া সিঙ্গাপুর ভারতসহ অনেকগুলো দেশ। দেশগুলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, প্রকাশক ও প্রকাশকদের প্রতিনিধিরা যার পর নাই ব্যস্ত। লেখকরা এসেছেন। অনুবাদকরা এসেছেন। সবাই মিলে কোন কোন বইয়ের স্বত্ব কিনবেন বা বিক্রি করবেন তা নিয়ে কথা বলছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বিএলআর। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অনুবাদক সয়োউং হান বলছিলেন, আমি আমার প্রতিষ্ঠানকে প্রমোট করতে এসেছি। এবং মেলা ঘুরে পপুলার কনটেন্ট দেখতে চাই। আমরা শুধু বই নয়, বিভিন্ন গেমসের স্বত্ব বিক্রি করি। গেমগুলোর ভাষা অনুবাদ করি আমি। এবারের মেলায় তার প্রতিষ্ঠান নিজেদের সবকিছু খুব ভালোভাবে তুলে ধরতে চান বলে জানান এই তরুণী।
সিঙ্গাপুর এবং ভারতের প্যাভিলিয়ন ও স্টলগুলোতে প্রথম দিনই জমজমাট অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। সিঙ্গাপুরের একটি স্টলে ঢুকতেই কর্মীরা এসে স্বাগত জানালেন। চকলেট দিয়ে আপ্যায়নও করলেন। ভারতের স্টল থেকেও একই রকমের আতিথেয়তা পাওয়া গেল। এভাবে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছিলেন তারা। তবে বাংলাদেশের স্টলে গিয়ে একেবারে হতবাকই হতে হলো। আশপাশের সকল স্টলে যখন উৎসব চলছে, যখন সবাই কৌতূহলী চোখে স্টল ঘুরে দেখছে তখন একমাত্র বাংলাদেশের স্টলটি ছিল শূন্য। এখানে কোনো মানুষজন ছিল না। কোনো বই ছিল না।

আন্তর্জাতিক একটি প্লাটফর্মে বাংলাদেশের স্টলের এই ন্যাংটো অবস্থা দেখে যে কারোরই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্টলটি নিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র। সরকারি খরচে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুরসহ একাধিক কর্মকর্তাকে মেলায় পাঠিয়েছেন। কাজ করছে জার্মানিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসও। কিন্তু কি কাজ তারা করছে সেটি প্রথম দিনে অন্তত বোঝার কোনো উপায় ছিল না। বাংলাদেশকে এমন কুৎসিত চেহারায় উপস্থাপন করার দায় কে নেবে?
এদিকে, বাংলাদেশের স্টলে প্রবাসী বাঙালিরা এসে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। কঙ্কন নামের এক লেখক এসেছিলেন কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বই তিনি সঙ্গী সাথীদের দেখাতে পারেননি। তাই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, এই ধরনের একটি প্রেস্টিজিয়াস আয়োজনে এসে এভাবে নিজেদের দেউলিয়া প্রমাণ করার কোনো মানে হয় না। যারাই বাংলাদেশকে দেখবে তারাই হতাশ হবেন। মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষও এই বিষয়টি হয়তো আমলে নেবে। নিলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আর স্টল নাও পেতে পারে। তিনি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাউকে মেলায় না পাঠানোর আহ্বান জানান। বলেন, নিজের দেশকে ছোট করার জন্য মেলায় আসার প্রয়োজন নেই।

×