
মুসলমানদের দুইটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদ-উল-আজহা। এই ঈদের আগমন মানেই সারাদেশে এক আনন্দঘন পরিবেশ, যেখানে ধনী-গরিব, কৃষক-শ্রমিক নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একই আবেগে উচ্ছ্বসিত হন। তবে ঈদ-উল-আজহার তাৎপর্য কেবল উৎসব-আনন্দেই সীমাবদ্ধ নয়। এই দিনটি হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর প্রতি অগাধ আনুগত্যের এক অনন্য নিদর্শন, যা আমাদের আত্মত্যাগ ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়।
তবে আজকের প্রজন্ম, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা, কোরবানির এই গভীর তাৎপর্য কতটা হৃদয়ে ধারণ করছে? ঈদ-উল-আজহাকে কি তারা কেবল একটি সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখছে, নাকি আত্মত্যাগ, সমবেদনা ও সামাজিক সমতার মূল বার্তাও বিবেচনায় নিচ্ছে?
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন গাজী চেষ্টা করেছেন এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে চেয়েছেন, এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের চিন্তাভাবনায় ঈদুল আযহার মূল দর্শন কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে।
"ঈদ আমাদের জন্য কেবল আনন্দ নয়, ত্যাগের শিক্ষাও।"
‘ঈদ মানে আনন্দ। ধর্মীয় দিক বিবেচনায় আমরা আমাদের আনন্দকে ভাগ করে নেই। ঈদ-উল-আজহা আমাদেরকে ত্যাগের শিক্ষা দেয়। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের মধ্যে আনন্দ, ধৈর্য, ত্যাগ, স্রষ্টার সন্তুষ্টিসহ নানা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বিকাশ সাধনের মাধ্যম ঈদুল আজহা।
ক্লাস, পরীক্ষার সকল চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে, ঈদের দিনগুলোতে নিজের পরিবারের সাথে সময় কাটানো। স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া—সব মিলিয়ে চমৎকার একটা সময় কাটবে আশা করছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রেখে আগামীর বাংলাদেশের জন্য কাজ করে যাওয়াই হোক আমাদের প্রতিটি আনন্দ উৎসবের লক্ষ্য।’
সাগর আল হাসান
কৃষি অনুষদ
সেশন: ২০২০-২১
"কোরবানির মূল শিক্ষা তাকওয়া, না যে কত মাংস দেওয়া হলো।"
‘মুসলিম হিসেবে ঈদ আমাদের জন্য এমন একটি দিন, যা মহান আল্লাহ্ নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন হালাল পথে আনন্দের সাথে উদযাপন করতে। তবে ঈদ-উল-আজহার মাধ্যমে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে ত্যাগেই যে প্রকৃত সুখ—তা-ই যেন অনুধাবন করার সুযোগ দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে ঈদ উদযাপন একজন মুসলিমের মৌলিক অধিকার। কিন্তু ফিলিস্তিনের মানুষের সে অধিকার খর্বিত হওয়ায় মানুষ হিসেবে লজ্জিত বোধ করছি। বিশ্ব বিবেক তাদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়াক—এটাই হয়তো এই ঈদের সবচেয়ে বড় চাওয়া থাকবে।
দেখতে দেখতেই কখন যেন বড় হয়ে গেলাম।
কখন যেন জীবনের প্রিয় জিনিসগুলো হারিয়ে যেতে শুরু করল। গতবছর এই ঈদে আমার জীবনসমতুল্য বাবা বেঁচে ছিলেন। যা আয়োজন করার উনিই করতেন, কোনো চিন্তা ছিল না। এবার তিনি নেই। এর চেয়ে বড় অভাব হয়তো মানব জীবনে আর থাকে না। তাকে ছাড়া ঈদ উদযাপন যেন আলোকিত চাঁদের মাঝে এক বিশাল বড় অন্ধকার। যাই হোক, তবুও ঈদ আসবে।
পরিশেষে সবাই মনে রাখব—কোরবানির মাংস নয়, একমাত্র তাকওয়াই আল্লাহ্র কাছে গৃহীত হয়। সকলের পরিবারের সাথেই সুন্দর সময় কাটুক—এই কামনা করছি।’
মো: সেলিম রেজা সত্য
ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ
সেশন: ২০২১-২২
"ঈদ মানেই পরিবার, ভালবাসা ও একত্রতা।"
‘ঈদ-উল-আজহা আমাদের জন্য কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি ত্যাগ, ভালোবাসা ও পরিবারকে ঘিরে উদযাপনের এক অপূর্ব উপলক্ষ।
পরিবারের সবার সঙ্গে সকালবেলা ঈদের নামাজ আদায় করে কোরবানির প্রস্তুতি নেওয়ার আলাদা একটা আনন্দ আছে। গরু বা খাসি কোরবানি দেওয়ার পর সবাই মিলে মাংস ভাগ করে নেওয়া, রান্না করা ও আত্মীয়স্বজনের বাসায় পাঠানো—এসবই ঈদের আনন্দের অংশ। এ বছরেও ঠিক এমনটাই করার পরিকল্পনা আছে। ঈদের পরদিন হয়তো কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা আছে, যেন প্রাকৃতিক পরিবেশে ঈদের ছুটি আরও উপভোগ করা যায়। ঈদ মানেই একসাথে থাকার আনন্দ, প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটানোর নাম।’
নূর আয়েশা চৌধুরী
মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ
সেশন: ২০২১-২২
"ত্যাগ ও আনুগত্যের শিক্ষা থাকুক আমাদের প্রতিটি কর্মে।"
‘ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। যার অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব। নিজের এবং পরিবারের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর হাজারো শিক্ষার্থীকে মা-বাবা, পরিবার এবং আরামদায়ক পরিবেশ ত্যাগ করে পাড়ি দিতে হয় অচেনা মানুষের ভিড়ে। এদিন চাঁদরাতে ছোট বোনদের হাতে মেহেদি দেওয়া, মিষ্টান্ন রান্না করা, ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আম্মুকে সাহায্য করা। ঈদের নামাজ শেষে গরু কোরবানি দেখতে যাওয়া থেকে শুরু করে কোরবানির প্রাপ্ত মাংস তিন ভাগে ভাগ করে প্যাকেট করা, সামর্থ্য অনুযায়ী মাংস বিতরণ করা—সবকিছু মিলিয়ে ঈদ-উল-আজহাকে অর্থবহ করে তোলে।
কোরবানি দেওয়ার সারমর্ম ছোটবেলায় বুঝতে ব্যর্থ হলেও এটি যে ত্যাগ, আত্মসংযম ও রবের প্রতি আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ—সেটি বুঝেছি। এবং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সকলের মাঝে এই দীক্ষা ছড়িয়ে পড়লে সমাজ হবে সুন্দর, সমতাময়।
এইভাবে ঈদ একত্রিত করে একটি পরিবার, একটি সমাজকে। এই ত্যাগের উৎসবে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে সবসময় একটাই প্রার্থনা করি—আপনি আমাকে অহংকারমুক্ত, বিনয়ী মানুষ হতে সাহায্য করুন। জীবনে এতটাও বড় হতে চাই না, যা আমার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে।’
মাহফুজা রহমান
কৃষি অনুষদ
সেশন: ২০২২-২৩
"ঈদ-উল-আজহা ফিরে ফিরে আনে শৈশবের স্মৃতি।"
‘ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশির জোয়ার। মুসলিম উম্মাহর অন্যতম বৃহৎ উৎসব ঈদ-উল-আজহা, যা ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে এই উৎসব পালিত হয়। দুই ঈদের মাঝে ঈদ-উল-আজহা আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি।
ঈদের দিন সকালে সবাই নতুন পোশাক পরিধান করে ঈদগাহ বা মসজিদে নামাজ আদায় করা। নামাজ শেষে কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে সবাই একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। এরপর শুরু হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি। কোরবানি শেষ করে বিকেলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে যাওয়া। ভার্সিটির বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়া হয় না। কিন্তু ঈদ-উল-আজহা সেই সুযোগটি নিয়ে আসে। কোরবানির গোশত নিয়ে আত্মীয় বাড়ি যাওয়া, সেখানে সবার কুশলাদি জানা, নানান ধরনের মজাদার খাবার খাওয়া—সবকিছুই হারিয়ে যাওয়া শৈশবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’
নওফেল হাসান রাফি
ইন্টারডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি
সেশন: ২০২২-২৩
"মানবতার পোশাকেই হোক ঈদ উদযাপন।"
‘বছর ঘুরে আনন্দ, আত্মত্যাগের মহান বার্তা নিয়ে ঈদ-উল-আজহা তথা কোরবানির ঈদ হাজির হলো। কোরবানি ঈদ মানেই শুধু আনন্দ নয়, এটি আত্মত্যাগের এক মহৎ প্রতীক। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর নিঃস্বার্থ ত্যাগ আমাদের শেখায়—ভালোবাসার প্রমাণ হয় ত্যাগেই।
এই দিনে আমরা শুধু পশু কোরবানি দিই না, বরং অহংকার, লোভ আর হিংসাও ত্যাগের চেষ্টা করি। ঈদের খুশি তখনই পূর্ণ হয়, যখন তা ভাগাভাগি করি সকলের সঙ্গে। আমি পরিকল্পনা করেছি, এই ঈদে নিজের জন্য কম, অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বেশি ভাববো। গরিব-অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আনন্দ তাদের সাথে ভাগ করে নেব। ঈদের নতুন জামায় নয়, মানবতার পোশাকে সুন্দর হই আমরা সবাই। আত্মত্যাগের এই শিক্ষা ছড়িয়ে দিই মানবতার প্রতিটি প্রান্তে।’
টিএম আরিফিন
কৃষি অনুষদ
সেশন: ২০২৩-২৪
সানজানা