ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফল মানেই সার্ভার জট: কবে মিলবে মুক্তি?

সোহানুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সরকারী রাজেন্দ্র কলেজ

প্রকাশিত: ২২:০৮, ৫ জুন ২০২৫; আপডেট: ২২:০৯, ৫ জুন ২০২৫

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফল মানেই সার্ভার জট: কবে মিলবে মুক্তি?

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের বৃহত্তম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য রীতিমতো এক দুঃস্বপ্ন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন কাঙ্ক্ষিত ফল প্রকাশিত হয়, তখন সেই ফল জানতে গিয়েই শুরু হয় নতুন আরেক যুদ্ধ—সার্ভারে ঢোকা যায় না, ওয়েবসাইটে ফল দেখা যায় না, সার্ভার ক্রাশ কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে লোডিং হয়। 

প্রতিষ্ঠার তিন দশক পেরিয়ে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এর অধীনে প্রায় ৩১ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। দেশের প্রায় ২,২০০টির বেশি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত, যেখানে অনার্স ও মাস্টার্সসহ বহু বিষয়ে পাঠদান চালু আছে। দেশের উচ্চশিক্ষার বিশাল একটি অংশকে একত্রিত করে এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। এমনকি জনসংখ্যার দিক থেকে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও বিবেচিত।

কিন্তু এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো যেন সময়ের চেয়ে বহু বছর পিছিয়ে পড়ে আছে। প্রতি বছর কোনো বর্ষের বা বিষয়ের ফল প্রকাশের দিন দেখা যায় একই চিত্র—পরীক্ষার্থীরা সকাল থেকে মোবাইল, ল্যাপটপের সামনে বসে অপেক্ষা করছে, কিন্তু ফল দেখতে পারছে না। সার্ভার বারবার ক্র্যাশ করে, ওয়েবসাইটে ঢোকা যায় না। কেউ কেউ ওয়েব সাইটে ঢুকতে পারলেও অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রী ফলাফল প্রকাশের সাত-আট ঘন্টায়ও রেজাল্ট দেখতে পারেনা । কেউ কেউ আবার দুই-তিন দিন পরেও রেজাল্ট দেখতে ব্যর্থ হয়।

এ বিষয়ে রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রাসেল মুন্সী জানান, "ফল প্রকাশের দিন আমাদের ভেতরে একটা মানসিক চাপ কাজ করে। তার ওপর যদি দেখা যায় ফলই দেখতে পাচ্ছি না, তখন সেটা দুশ্চিন্তাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। পরিবার থেকেও জানতে চায়, বন্ধু-বান্ধব ফল জানে, আমি জানি না। এসব মিলে পরিস্থিতি খুবই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে।"

তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই সমস্যার সমাধান কী? এত বছরেও কেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি কার্যকর, আধুনিক এবং শিক্ষার্থী-বান্ধব ফলাফল সিস্টেম গড়ে তুলতে পারল না?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সার্ভার আধুনিকীকরণ এবং ফলাফল ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ হতে পারে একটি বাস্তবসম্মত সমাধান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটি যদি AWS, Google Cloud বা Microsoft Azure-এর মতো ক্লাউড সার্ভারে হোস্ট করা হয়, তাহলে সেই সার্ভার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়তি ট্রাফিক সামাল দিতে সক্ষম হবে। এতে ওয়েবসাইট ধীর হবে না বা বন্ধ হবে না। মূল ওয়েবসাইটের পাশাপাশি একাধিক ‘mirror’ বা বিকল্প ওয়েবসাইট চালু করা যেতে পারে যেমন: result1.nu.ac.bd , result2.nu.ac.bd। এছাড়াও সারা দেশের কলেজ গুলোকে ১৫ থেকে ২০ টি আঞ্চলিক বা সাব জোনে ভাগ করে একই সময় পৃথকভাবে ফলাফল প্রকাশ করা। তাহলে একই সাথে সবাই একই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করবে না এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে ফলাফল দেখা যাবে। 

এ বিষয়ে শতবর্ষী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ওবায়দুর রহমান বলেন, “প্রতিবার ফলাফল প্রকাশের দিন আমাদের শিক্ষার্থীরা মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হয়। সার্ভার সমস্যার কারণে অনার্স প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন পর্যন্তও অনেক শিক্ষার্থী এডমিট কার্ড সংগ্রহ করতে পারেনি। একটি আধুনিক ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে উচ্চশিক্ষার এমন মৌলিক সেবাগুলোকে আরও দক্ষ ও শিক্ষার্থী-বান্ধব করতে হবে। আমরা আশা করি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে আসবে এবং প্রযুক্তিগত দুর্বলতা দূর করে শিক্ষার্থীদের এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেবে।”

পরীক্ষার ফলাফল সংক্রান্ত সার্ভার জটিলতা নিয়ে মুঠোফোনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোঃ এনামুল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান "আমরা চেষ্টা করছি আমাদের রেজাল্ট সম্পর্কিত সার্ভারের মান উন্নয়ন করার জন্য। ইতিমধ্যে আমরা কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি, ছাত্র-ছাত্রীরা তার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে। তবে এ সমস্যা পুরাপুরি ঠিক হতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। এছাড়াও আমরা চিন্তা করছি বিকাল ৩ টার সময় ফলাফল প্রকাশ না করে সকালের দিকে ফলাফল প্রকাশ করতে। যেন চাপ কিছুটা হলেও কমে" 


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত একটি প্রতিষ্ঠান। একটি পরীক্ষার ফল কেবল নম্বরের হিসাব নয়, সেটি অনেকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আর তাই ফলাফল দেখার মতো মৌলিক ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবাটিকে যদি এখনও নির্ভরযোগ্য করা না যায়, তবে সেটি নিঃসন্দেহে একটি বড় ব্যর্থতা।

সময় এসেছে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান খোঁজার। নতুবা প্রতিবার ফল প্রকাশের দিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আতঙ্ক হিসেবেই ফিরে আসবে।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজের অভিন্ন দাবি—ফলাফল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও একটি টেকসই সমাধান, যেন শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে আর এ ধরনের দুর্ভোগে না পড়ে।
 

আলীম

×