সোনালি আঁশ সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বপ্নে স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালে বিজেএমসির আওয়তায় ৭০টিরও বেশি পাটকল ছিল। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মিলসংখ্যা কমতে কমতে ২৫-এ গিয়ে ঠেকে। সর্বশেষ পাটকলগুলোও বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসি। বর্তমানে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও বেসরকারী খাতের অনেক পাটকল ঠিকই মুনাফা করতে পারছে। কোভিড-১৯ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ^বাজারের পাটের চাহিদা বাড়ছে, এমন একটি সম্ভাবনাময় সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস পাটকলগুলোর উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করে বলেছেন, সরকারী খাতের পাটকলগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে শ্রমিকদের সমুদয় পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে যে পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদিত হয় তার ৯৫ শতাংশই বেসরকারী পাটকলে উৎপাদিত হয়। সরকারী খাতটি অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, যা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিল না। এগুলোকে আবার প্রতিযোগিতায় কীভাবে আনা যায় এবং কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিবেচনায় এখন পাটকলগুলো বন্ধ করার ঘোষণা করা হয়েছে।
এসব পাটকল বন্ধ থাকলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় চালু থাকলে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। কাজেই এসব পাটকলের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক ভাইদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তার জন্য সরকার তাদের ২০১৫ সালের জাতীয় মজুরি কাঠামো অনুযায়ী সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশনাও দিয়েছেন, যে পাটকলগুলো বন্ধ আছে সেগুলো কীভাবে চালু করা যায়, যাতে সেগুলো বর্তমান এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। এ-সংক্রান্ত একটি কর্মপন্থা প্রস্তুত করে অতি দ্রুত তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর অতীত তুলে ধরে ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো গত ৪৮ বছরের মধ্যে শুধু চার বছর লাভের মুখ দেখে এবং ৪৪ বছর ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান দিয়েছে। লোকসান হলে কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য সরকারের অর্থের ওপর নির্ভর করতে হতো বলে প্রতি মাসেই শ্রমিক-কর্মচারীদের এ-সংক্রান্ত সমস্যা চলছিল। পাটকল শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে তিন দিনের মধ্যে তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী পাটকলগুলোর ২৫ হাজার শ্রমিককে তাদের অবসরকালীন সুবিধাসহ পাওনা পরিশোধ বাবদ সরকারের ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। পাট খাতের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নজর রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর দর্শন হচ্ছে পাটকল শ্রমিকদের বাঁচানো।
শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের ধরন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেছেন, পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব শ্রমিক অনধিক দুই লাখ টাকা প্রাপ্য তাদের পুরো টাকা এককালীন নগদ পরিশোধ করা হবে। পাওনা টাকার মধ্যে ৫০ শতাংশ এককালীন নগদ এবং অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ শ্রমিকদের ভবিষ্যত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সয়ঞ্চপত্র আকারে পরিশোধ করা হবে।
এর আগে গত ২৫ জুন ’২০ পাটকল বন্ধসংক্রান্ত প্রস্তুতি সভা শেষে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক বলেছিলেন, আমরা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দেব। আগে মিলগুলোকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। আমরা বিক্রি না করে জুট মিলই রাখব। ম্যানেজমেন্ট দেব যাতে লোক ছাঁটাই না হয়। এই শ্রমিকরা এখানেই চাকরি পাবেন, কারণ স্কিল্ড ওয়ার্কার ছাড়া মিল চালাতে দেয়া হবে না। মিলগুলো বুঝে পাওয়ার পরে টেন্ডার হবে, যে বেশি দেয় তাকে দেয়া হবে কিন্তু হি মাস্ট বি এ জুট মিল এক্সপার্ট। জুট মিল এক্সপার্ট না হলে সে কাজ করবে না। জমি নেয়ার চেষ্টা করলে, সেটা আমরা দেব না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বঙ্গবন্ধু পাটের জন্য আন্দোলন করেছেন, সুতরাং পাটকে আমাদের রাখতে হবে। সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জুট থাকবে, এটা ডিসাইডেড।
সরকার পিপিপির কথা বললেও এর আগেও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ হয়। তখনকার অভিজ্ঞতাও ভাল নয়। বেসরকারী খাতে হস্তান্তর করা মিলগুলোর বেশির ভাগই সরকারের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারী খাতে দেয়া চারটি পাটকল ফিরিয়েও নিয়েছে সরকার। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারী খাতে দেয়া মিলগুলোর কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে মিল পরিচালনা না করে বন্ধ অবস্থায় ফেলে রেখেছে, হাজার-হাজার শ্রমিক-কর্মচারীকে তাদের কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এতে মিল হস্তান্তরের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে এবং হস্তান্তর চুক্তি লঙ্ঘিত হয়েছে।
সার্বিক প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকারের আমলেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল নিয়ে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কয়েক বছর আগে চীনের সরকারী প্রতিষ্ঠান চায়না টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন ফর ফরেন ইকোনমিক এ্যান্ড টেকনিক্যাল কর্পোরেশনের (সিটিইএক্সআইসি) কারিগরি সহায়তা নেয়ার জন্য সমঝোতা চুক্তি সই হয়। সিটিইএক্সআইসি জরিপ বলছে, পাটকলগুলোর বিদ্যমান পুরনো মেশিন সংস্কার করে কোন লাভ হবে না। সব মেশিন বদলানোর পরামর্শ দেন তারা। এখন সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সরকারী-বেসরকারী অংশীদারির ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল পরিচালনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে সরকার।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) সভাপতি মো. জাহিদ মিয়া বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আশা করি, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী মিলগুলো আধুনিকায়নের পর পাট খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হবে। তবে পাটের বৈশি^ক চাহিদা কমে আসছে। এ প্রেক্ষাপটে লাভজনকভাবে মিল পরিচালনা করার জন্য সুচিন্তিত পরিকল্পনার প্রয়োজন আছে। পিপিপির আওতায় এ বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েই মিলগুলো পরিচালনা করা প্রয়োজন হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা বিশ^ এখন সবুজায়নে জোর দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৮টি দেশ পলিথিন ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ওই দেশগুলোর বিপুল পরিমাণে পাটের ব্যাগের চাহিদা সৃষ্টি হবে। পাটবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশে^ বছরে পাঁচ হাজার কোটি পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক আঁশ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই দেড় হাজার কোটি ডলারের শপিং ব্যাগের বাজার তৈরি হবে। এছাড়া পাটের শপিং ব্যাগ, শৌখিন ও আসবাবসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনেরও সুযোগ হয়েছে। বিশ^বাজারে শুধূ পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে ৫০০ বিলিয়ন পিস। এতে পাটের তৈরি পণ্যের বড় ধরনের চাহিদা তৈরি হবে। এতে দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণে পাটের ব্যাগের চাহিদার সৃষ্টি হবে। তাছাড়া পাটের শপিং ব্যাগ, শৌখিন ও আসবাবসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। ফলে রফতানির অন্যতম খাত হতে পারে পাট। সেই বাজার ধরতে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো এরই মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের অভাবে সেটি ধরা কষ্টকর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ জুট ডাইভারসিফায়েড প্রডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ রাশেদুল করীম মুন্না এ বিষয়ে বলেছেন, বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের কারণে পাটের সম্ভাবনা অফুরন্ত। সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক বাজারের ১০ শতাংশও দখল করতে পারলে শুধু এই পাট দিয়েই বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। আগামী বছর থেকে পাট শিল্প থেকে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করা মোটেও কোন স্বপ্ন নয়। এজন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কারখানা স্থাপন করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য প্রবেশের জন্য গবেষণা বাড়ানো ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদামাফিক পণ্য তৈরির জন্য দেশে দক্ষ জনবল তৈরি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি যান্ত্রিক সুবিধা বাড়াতে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য বেসরকারী খাতকে যেমন সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমন রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণাহীনতা ও পুরনো মেশিন দিয়ে বিশ^বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। দেশের কারখানাগুলোতে মাত্র পাঁচ-সাত ধরনের ইয়ার্ন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ভারতের কারখানাগুলো ১১০টির বেশি ইয়ার্ন তৈরি করছে। ফলে সুতাভিত্তিক পণ্য তৈরিতে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। এক সময় পাট দিয়ে শুধু দড়ি, চট, ছালা তৈরি হতো। কিন্তু পাট দিয়ে এখন শত শত ধরনের ব্যবহার্য জিনিস তৈরি হচ্ছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: