ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের উদ্যোগের কারণেই রেমিটেন্স ও রিজার্ভে রেকর্ড

প্রকাশিত: ২১:২৮, ১০ জুলাই ২০২০

সরকারের উদ্যোগের কারণেই রেমিটেন্স ও রিজার্ভে রেকর্ড

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চলমান করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সঙ্কটের মধ্যেও জুলাই মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। একইসঙ্গে জুন মাসে প্রবাসীরা দেশে রেকর্ড ১৮৩ দশমিক ৩০ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। আগের মাসেও রেকর্ড থাকায় গোটা অর্থবছরেই রেমিটেন্স নতুন রেকর্ড গড়েছে। অর্থনীতির এই দুই সূচকের এই ‘উল্লম্ফন’ সাময়িক ইতিবাচক হলেও দীর্ঘমেয়াদে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, করোনার এই সঙ্কটে পরস্পর সম্পর্কিত এই দুই সূচকের উত্থানের পাশাপাশি রফতানিতে ধস দেশের অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, করোনাভাইরাসের কারণে অভ্যান্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানির পরিমাণ কমে গেছে। এতে করে রিজার্ভ থেকে খরচ কমার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। আবার বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় দুই বিলিয়ন ডলার অনুদান পাওয়া গেছে। করোনা সঙ্কটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের দেশে ফেরত আসতে হচ্ছে বলে তাদের সব সঞ্চয় কিংবা ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া অর্থও দেশে আসছে রেমিটেন্স আকারে। ফলে রিজার্ভ বাড়ছে। এ কারণেই মে ও জুনে রেমিটেন্স আর জুন-জুলাইয়ে রিজার্ভে ব্যাপক উর্ধগতি দেখা গেলেও সেটা সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদে এটি ভীষণ দুশ্চিন্তার কারণ, এমনকি এ পরিস্থিতি রীতিমতো অশনী সংকেত হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে রফতানিতে ধস আর বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের অর্থনীতিতে সামনে কঠিন সময় পাড়ি দিতে হবে। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ আমদানির মাত্রা কমে যাওয়া। রফতানিতেও ধস নেমেছে। দ্বিতীয়ত, করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় দাতা সংস্থাগুলো বড় অঙ্কের অনুদান দিচ্ছে। এগুলো এখনও ব্যবহার না হওয়ায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রেমিটেন্স বাড়ার পেছনের সম্ভাব্য কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক প্রবাসী করোনার কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা জানেন না আর ওই দেশে যেতে পারবেন কি না। ফলে তাদের যা কিছু সঞ্চয় আছে, সব পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ কারণেই সম্ভবত রেমিটেন্স বেড়েছে। এসব শ্রমিকরা প্রবাসে কাজের জন্য ফিরতে না পারলে এখনকার এই ‘উর্ধগতি’ টেকসই হবে না। বরং সামনে দুর্দিন অপেক্ষা করছে। রেমিটেন্স ও রিজার্ভ বেড়ে গেলেও উল্লসিত হওয়ার কোন কারণ নেই বলে মনে করেন মির্জ্জা আজিজ। তিনি বলেন, করোনা পরবর্তী দেশে স্বাভাবিক অর্থনীতি চালু হলে আমদানির মাত্রা বেড়ে যাবে। তখন রিজার্ভ কমে যাবে। অন্যদিকে রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ প্রবাসীদের যারা দেশে চলে এসেছেন, তারা ফিরতে পারবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। আবার বিমান চলাচল স্বাভাবিক হলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী ফেরত আসার সংখ্যা সম্ভবত আরও বাড়বে। তাই রিজার্ভ আর রেমিটেন্স বেড়ে যাওয়ায় উল্লিসিত হওয়ার কিছু নেই। বরং দেশে বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি কমেছে। রফতানি ও মূলধনী যন্ত্রাংশ উৎপাদনও কমেছে। সব মিলিয়ে আমাদের অর্থনীতির পরিস্থিতিকে খুব একটা ভাল বলা যাবে না। রিজার্ভ-রেমিটেন্সের রেকর্ডে সন্তুষ্ট না হয়ে বরং এর কারণ বিশ্লেষণ করার কথা বলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনিও মনে করছেন, কারণ বিশ্লেষণ করলে বরং সন্তুষ্টি উধাও হয়ে দুশ্চিন্তা বাড়বে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, হাজার হাজার প্রবাসী দেশে ফিরছেন। এর আগে তাদের সঞ্চয়গুলো পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলো প্রবাসীদের সর্বোচ্চ ১০ হাজার রিয়াল পাঠানোর বিষয়ে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বলে শুনছি। এ কারণে অনেক প্রবাসী তাদের সঞ্চয়ের পুরো টাকা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারণ দেশে আসার সময় একসঙ্গে বেশি টাকা নিয়ে এলে অনেক সময় হয়রানির আশঙ্কা থাকে। প্রবাসীদের সোনার ডিম দেয়া হাঁসের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, এতদিন প্রবাসীরা হাঁসটা থেকে ডিমটা পাঠাত, এখন আমরা হাঁসটাই খেয়ে ফেলতে যাচ্ছি। ডিমটা আর খেতে পারব না। চলমান এ পরিস্থিতির কারণেই রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়ে গিয়ে রিজার্ভ বাড়িয়েছে বলে মনে করেন আহসান মনসুর। একইসঙ্গে করোনা মোকাবেলায় দাতা সংস্থাগুলোর দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার অনুদানও ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন তিনি। বলেন, আমরা আপৎকালীন বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে সাহায্যে সহযোগিতা চেয়েছি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা আমাদের দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার সাহায্যে দিয়েছে। এ কারণে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন বেড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রিজার্ভ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় অংশটি এসেছে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক থেকে। পিআরআইয়ের এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, আমাদের আমদানি ভয়ানকভাবে কমে গেছে। কারণ আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির অবস্থা ভাল না। অভ্যান্তরীণ চাহিদার পতন হওয়ার কারণে আমদানি কমে গেছে। যতদিন কোভিড-১৯ আমাদের মাঝে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত অর্থনীতির অবস্থা ভাল হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। প্রায় একই বক্তব্য দিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদও। তিনি বলেন, আগে যেখানে ১৫-১৬ শতাংশ আমদানি হতো, এখন তার পরিমাণ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। ফলে আমদানির কারণে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হতো, এখন সেটা করতে হচ্ছে না। রিজার্ভ থেকে যাচ্ছে। আবার যোগ হয়েছে রেমিটেন্স। তাতে রিজার্ভ বাড়ছে। কিন্তু প্রবাসীরা তো ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বা কাজ হারানোর ভয়ে সব সঞ্চয় পাঠিয়ে দিচ্ছে। অনেকের ব্যবসা ছিল, ব্যবসা গুটিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে রেমিটেন্সের এই ধারা একদমই সাময়িক। বরং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমার রেমিটেন্সেও কয়েক বছর আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারি। কারণ সব দেশই নিজেদের পুনর্গঠন নিয়ে ব্যস্ত। এ অবস্থায় তারা বিদেশী শ্রমিক আগের মতো নেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করা যাচ্ছে না এবং এ গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা সাবেক এই গবর্নরের। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো অর্থ ছাড় করছে না, নানা অজুহাত দেখিয়ে শুধু কাগজপত্র চাচ্ছে। বড় উদ্যোক্তাদের কিছু অর্থ ছাড় দিলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থ দিচ্ছে না। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০-৬০ কোটি টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে। এভাবে অর্থ ছাড় দিলে তো প্রণোদনা কোন কাজে আসবে না। অর্থনীতির ১২টা বেজে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম রেমিটেন্স ও রিজার্ভে রেকর্ডের কারণ তুলে ধরে বলেন, ‘সরকারের ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগের কারণে দেশে বৈধ পথে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে। আর রেমিটেন্স বাড়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।’
×