ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রেশমি সুতোয় এখন নতুন স্বপ্ন দেখছেন রাজশাহীবাসী

স্বল্প পরিসরে রেশম উৎপাদন শুরু

প্রকাশিত: ০৯:১১, ১৪ মে ২০১৯

 স্বল্প পরিসরে রেশম উৎপাদন শুরু

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহীর আরেক নাম রেশমনগরী। ‘সিল্কসিটি’ হিসেবেও পরিচিত। শিক্ষানগরী হিসেবে রাজশাহীর যে সুনাম, রেশমনগরী হিসেবে সুনাম তার চেয়ে মোটেও কম ছিল না। তবে রাজশাহীর রেশম অনেকটায় স্মৃতি। লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে ২০০২ সালে রাজশাহী রেশম খারখানা বন্ধ করে দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ১৫ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৭ সালের ২৭ নবেম্বর থেকে আবারও পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যায় রাজশাহীর রেশম কারখানা। এদিন থেকে একটি লুমে রেশম বস্ত্র উৎপাদন শুরু হয়। ফলে রেশমি সুতোয় এখন নতুন স্বপ্ন দেখছেন রাজশাহীবাসী। মহাজোট থেকে নির্বাচিত রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর কারখানাটি আবার চালু করা সম্ভব হয়। সংসদ সদস্য বাদশা রাজশাহীর সরকারী রেশম কারখানার নবযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তার চোখেও স্বপ্ন, এখন থেকে আবার শুধু শিক্ষানগরী নয়, রেশমনগরী হিসেবেও রাজশাহী তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে। তার স্বপ্ন আরও বড়-নিকট ভবিষ্যতে রাজশাহী শিল্পনগরী হিসেবেও পরিচিতি পাবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই পাঁচটি লুম চালুর মাধ্যমে শুরু হয় কারখানার আরও বিস্তৃত কার্যক্রম। তবে তেমনভাবে আর এগোতে পারছে না। রাজশাহী রেশমের সুদিন ফেরাতে সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনও আন্তরিক। সর্বশেষ গেল ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী রেশম কারখানা পরিদর্শন করে আশার বাণী শুনিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, রাজশাহী রেশম কারখানায় আরও পাঁচটি লুম চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘ দিন পড়ে থাকা লুমগুলো এখন ঘঁষে-মেজে চালুর উপযোগী করা হচ্ছে। এর আগে গেল বছর পরীক্ষামূলকভাবে কারখানার ছয়টি লুম চালু করা হয়। পর্যায়ক্রমে কারখানার সব লুমই চালু করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেশম কারখানায় এখন পরীক্ষামূলকভাবে ছয়টি লুম চলছে। লুমগুলো এ পর্যন্ত ২ হাজার ৬০০ গজ কাপড় উৎপাদন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বলাকা, স্পান সিল্ক থান, কোরা বলাকা, গরদ কাপড় ও থান কাপড়। আরও পাঁচটি লুম চালুর উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। তখন উৎপাদন আরও বাড়বে। রেশম বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত রেশম বোর্ডের নিজেদের উৎপাদিত গুটিতেই কারখানায় রেশম কাপড়ের উৎপাদন চলছে। তারা কারখানার সব লুমই চালু করতে চান। তবে এ জন্য আরও বেশি পরিমাণ রেশম গুটি প্রয়োজন। তাই তাদের গুটির উৎপাদন বাড়াতেও কাজ করতে হচ্ছে। যত বেশি কাঁচামাল উৎপাদন বাড়বে ততই বেশি সংখ্যক লুম চালু করা হবে। এ বিষয়ে সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, রেশম রাজশাহীর ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে রেশম বোর্ডকে যেভাবে সহযোগিতা করা প্রয়োজন তারা করবেন। রাজশাহী মহানগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকায় ১৯৬১ সালে সাড়ে ১৫ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত হয় এই রেশম কারখানা। রেশমের উন্নয়নে রাজশাহীতেই স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয়। কিন্তু এক কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় রেখে ২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার কারখানাটি বন্ধ করে দেয়। এতে বেকার হয়ে পড়েন কারখানার প্রায় ৩০০ শ্রমিক। সে সময় অনেক আন্দোলন করেও কারখানাটি চালু করতে পারেনি রাজশাহীবাসী। দীর্ঘ দিন পর রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা রেশম বোর্ডের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর কারখানাটি চালুর উদ্যোগ নেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে কারখানার পাঁচটি লুম চালু করা হয়। পরে চালু হয় আরও একটি। এখন আরও ছয়টি লুম চালুর প্রক্রিয়া চলছে। বন্ধ ঘোষণার সময় কারখানায় মোট ৬৩টি লুম ছিল। এর মধ্যে উৎপাদন চলত পুরনো ৩৫টি লুমে। নতুন ২৮টি লুম চালুর আগেই কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধের আগে কারখানাটি বছরে এক লাখ ৬ হাজার মিটার রেশম কাপড় উৎপাদন করত। কারখানায় ৬৩টি লুম চালু করা গেলে বছরে কাপড় উৎপাদন হবে দুই লাখ ৮৭ হাজার মিটার। ধীরে ধীরে সব লুমই চালুর পরিকল্পনা আছে রেশম বোর্ডের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সরকারী এই রেশম কারখানায় উৎপাদিত হয় কয়েক লাখ মিটার রেশম কাপড়। লুমের চাকার খট খটা খট শব্দ আর শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যস্ত পদচারণায় কারখানা থাকত মুখরিত। বলাকা সিল্ক, লাল পাড়ের গরদ শাড়ি, নানা রঙের আর কারুকাজ করা শাড়ি, পাঞ্জাবির কাপড়, মটকা ছিল সবার কাছে আকর্ষণীয়। এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী মসলিন হারিয়ে গেলেও সেই অভাব কিছুটা পূরণ করেছিল রাজশাহীর সিল্কের কাপড়। জানা যায়, ষাটের দশকের শুরুতে রাজশাহী রেশম কারখানা স্থাপিত হয় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রেশম সুতা দিয়ে। ৪৭১ জন শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে স্থাপিত হয় এই রেশম কারখানা। ১৯৭৪ সালে রেশম শিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্য বাংলার রেশমের রাজধানী রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ সিল্ক রিসার্চ ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (বিএসআরটিআই) বা রেশম গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড প্রতিষ্ঠা হলে রাজশাহী সিল্ক ফ্যাক্টরি এ বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রথম অবস্থায় কারখানাটিতে এক শ’টি রিলিং মেশিন, ২৩টি শক্তিচালিত ও ১০টি হস্তচালিত তাঁত স্থাপন করে কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ সাল নাগাদ এক শ’টি রিলিং মেশিনকে ২০০টিতে ও ২৩টি শক্তিচালিত তাঁতকে ৪৩টিতে উন্নীত করা হয়। রাজশাহী তখন সিল্কের জন্য ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে। রাজশাহী হয়ে ওঠে ‘সিল্ক হেভেন’।
×