অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পাট পাতা থেকে ২ বছর আগে চায়ের উৎপাদন শুরু হলেও এখনও দেশের মানুষ তা পান করার সুযোগ পায়নি। তবে এরই মধ্যে ওই চা ইউরোপের বাজারে সাড়া ফেলেছে। সেখানকার অন্তত চারটি দেশে ‘অর্গানিক পণ্য’ হিসেবে এই চা রফতানি হচ্ছে। তবে পাট পাতার চা রফতানিতে ‘অর্গানিক’ পরিচয়টি বিপদের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ পর্যন্ত পরীক্ষা নিরীক্ষায় ইতিবাচক ফলাফল মিললেও দেশে উদ্ভাবিত পাট পাতার চা শতভাগ অর্গানিক কিনা, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তারা জানিয়েছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এ সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাবে। ওই চায়ের উদ্ভাবক জানিয়েছেন, মার্চ-এপ্রিল নাগাদ এটি বাংলাদেশের বাজারে ছাড়া হতে পারে।
ফুল আসার আগে তোষা পাটের গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়। সূর্যের আলোয় তা শুকিয়ে গুঁড়া করলেই চা তৈরি হয়ে যায়। এরপর সেখান থেকে তৈরি পানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী চিনি বা মধু মিশিয়ে পান করা যায়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এই চা উৎপাদন শুরু করে। পরে গুয়ার্ছি এ্যাকুয়া এ্যাগ্রো টেক নামের প্রতিষ্ঠান অর্গানিক চা হিসেবে তা জার্মানিতে রফতানি শুরু করে। এখন ইংল্যান্ড, সুইডেন এবং ফ্রান্সের বাজারেও ‘অর্গানিক’ পরিচয়ে ওই চা রফতানি করা হচ্ছে। জানা গেছে, এ পর্যন্ত উৎপাদিত ১০ টন চায়ের মধ্যে আড়াই টন বিদেশে রফতানি করা হয়েছে। পাইপলাইনে আছে আরও ৩ টন।
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কোন পণ্যকে অর্গানিক ঘোষণা করতে হলে তার উৎপাদন অঞ্চলকে অর্গানিক জোন ঘোষণা করতে হয়। ভারতে অর্গানিক পণ্যের জন্য পৃথক জোন রয়েছে। আমাদের দেশে এখনও তেমন কোন জোন নেই। তিনি বলেন, ‘পাট পাতার চা অর্গানিক পণ্য হিসেবে রফতানি হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।’ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ধরা যাক আপনি যে জমিতে পাট চাষ করলেন সেই জমিতে কোন রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করলেন না। জৈব সার ব্যবহার করলেন কিন্তু পাশের জমিতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা হলো। বৃষ্টির পানিতে তা মিশে আপনার জমিতে চলে আসতে পারে। এভাবে চাষ করলে শতভাগ অর্গানিক পণ্য বলা যাবে না। বরং কেউ এর ‘অর্গানিক’ পরিচয়কে চ্যালেঞ্জ করলে সম্ভাবনাময় পণ্যটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) জুট লিভস ড্রিংক প্রজেক্টের উপদেষ্টা এইচ এম ইসমাইল খান এই চায়ের উদ্ভাবক। তিনি জানিয়েছেন, এরই মধ্যে আইসিডিডিআরবি, বিএসটিআই এবং জার্মানির একাধিক সেন্টারে এই চা পরীক্ষা করে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। তবে এখনই চূড়ান্তভাবে একে অর্গানিক বলার সুযোগ নেই। ‘পুরো প্রক্রিয়াটিই এখনও পরীক্ষামূলক (ট্রায়াল)। সনদ পাওয়া গেলে তখন কেবল পাট পাতার চা-কে শতভাগ অর্গানিক বলে দাবি করা যাবে।’ তিনি বলেন, আমরা পাটের চা পরীক্ষা করতে দিয়েছি। এই পরীক্ষার ফল পেতে তিন বছর সময় প্রয়োজন হয়। এরই মধ্যে এক বছর পার হয়েছে। আরও দুই বছর লাগবে সনদ পেতে। পরীক্ষা জার্মানিতে হবে। ইন্টারট্রপ নামের একটি জার্মান প্রতিষ্ঠান এই কাজে সহযোগিতা করছে।’
বাংলাদেশের মানুষের জন্য শীঘ্রই পাট পাতার চা দেশের বাজারে ছাড়া হবে। ইসমাইল খান বলেন, আগামী ৬ মার্চ পাট দিবস। ওই দিনই দেশে পাটের চায়ের মোড়ক উন্মোচন হবে। সেই হিসেবে মার্চ-এপ্রিল মাস নাগাদ বাজারে চলে আসবে পাটের চা। তিনি জানান, ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাট পাতার চা উপহার দেয়া হলে তিনি এতে জেসমিন ফ্লেভার যুক্ত করতে বলেন। পরে জেসমিনসহ আরও তিনটি ফ্লেভার যুক্ত করা হয়। কৃত্রিম নয়, অর্গানিক উপায়েই মূল উপাদান সংগ্রহ করে ফ্লেভার যুক্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রাচীনকালে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ফিলিপিন্স ও মিসরে রোগ নিরাময়, রোগ প্রতিরোধ এবং রোগীর শীঘ্র আরোগ্য লাভের জন্য পাট পাতার নির্যাস ও স্যুপ নিয়মিত ব্যবহার হতো। খ্রীস্টপূর্ব ৬০০০ বছর অগেও পাট পাতা রোগ নিরাময় ও সৌন্দর্য চর্চায় পাট পাতার ব্যবহার হতো। জানা গেছে, এখন জেসমিন, রোজি, লেমন গ্রাস ও জিনজার রোজ এই চার ফ্লেভারের পাট পাতার চা উৎপাদন করা হচ্ছে। চা তৈরির তোষা পাট চাষে মানিকগঞ্জে ৫ একর জায়গায় অর্গানিক প্ল্যান্ট গড়ে তোলা হয়েছে। রাজধানীর উত্তরখানে একটি কারখানায় এই চা উৎপাদন হচ্ছে। ভবিষ্যতে দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে রফতানি বাড়ানোর জন্য জামালপুর জেলার সরিষাবাড়িতে নির্মিত হচ্ছে পাট পাতার চায়ের কারখানা। এক কোটি ১৬ লাখ টাকার ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মূল প্রজেক্ট সেখানে গড়ে তোলা হবে। তখন পাটের চায়ের উৎপাদনের পরিমাণও বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই প্রাণীদেহে পাট পাতার চায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এবার মানুষের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হবে। আর্সেনিক আক্রান্ত ২০০ জনের ওপর ট্রায়াল চলবে ২ বছর ধরে। এছাড়া ডায়াবেটিক আক্রান্ত মানুষের ওপর ট্রায়াল চলবে ৬ মাস। আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষ এই চা নিয়মিত পান করলে শরীর থেকে আর্সেনিক পুরোপুরিভাবে চলে যাওয়ার কথা। ট্রায়াল সফল হলে তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, পাট পাতা থেকে চা তৈরি করে তাদের খাওয়ানো হবে নাকি ক্যাপসুল তৈরি করা হবে।