ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দাবদাহেরকালে আশা জাগানিয়া মানবিক উদ্যোগ

কোথাও বিশ্রামাগার, জলপানের ব্যবস্থা কৃত্রিম বৃষ্টি

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

কোথাও বিশ্রামাগার, জলপানের ব্যবস্থা  কৃত্রিম বৃষ্টি

.

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত। গ্রীষ্মের শুরুতে যে গরমাগরম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, এখনো তা অব্যাহত আছে। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকে না। জীবিকার প্রয়োজনে ঠিকই ঘরের বাইরে বের হতে হচ্ছে মানুষজনকে। আর বের হতে না হতেই শিকার হতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগের। সূর্যের প্রখর রোদে গা ঘামছে। পুড়ছে। ঘটছে হিটস্ট্রোকের ঘটনাও।

তবে একদিকে যখন শান্তি-স্বস্তি সব কেড়ে নিচ্ছে প্রকৃতি, তখন অন্যদিকে চোখে পড়ছে আশাজাগানিয়া মানবিক উদ্যোগ। ঢাকায় বিভিন্ন সংঘ-সংস্থা-সমিতির পক্ষ থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিকদের জন্য জলপানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। লেবুর শরবত ওরস্যালাইন বা ডাবের পানি বিতরণ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও প্রস্তুত করা হয়েছে বিশ্রামাগার, সেখানে দাঁড়িয়ে বা বসে ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে নেওয়া যাচ্ছে। আরও শীতল হতে চাইলে আছে কৃত্রিম বৃষ্টিতে গা ভিজিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। সংঘ-সমিতির পাশাপাশি মানবিক মানুষরাও এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ফলে ছোট পরিসরে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও উদ্যোগগুলো মানবিক সমাজ গঠন এবং পরস্পরের জন্য বাঁচার স্বপ্নকে সত্য করে তুলছে।  

গরম বাড়তে থাকার মধ্যেই একটু একটু করে সামনে আসছিল এসব মানবিক উদ্যোগ। বর্তমানে ঢাকার ব্যস্ততম রাস্তায়, মোড়ে বা ফুটপাতে উদ্যোগগুলো বেশি চোখে পড়ছে। ঘামের কারণে শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। সেই ঘাটতি পূরণে বেশি বেশি পানি পানের বিকল্প নেই। এই বাস্তবতায় ক্লান্ত পথিকের জন্য পানির ব্যবস্থা করছে অনেক সংগঠন। শনিবার খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় পানীয়জলের ব্যবস্থা করেছিলইয়ুথ ফর বাংলাদেশনামের একটি স্বেচ্ছ্বাসেবী সংগঠন। সংগঠনের পক্ষ থেকে খোলা ভ্যানে করে পানি নিয়ে আসা হয়। বেশ কয়েকটি বড় মাঝারি ট্যাঙ্কভর্তি পানি। সেখান থেকে গ্লাসে নিয়ে বিতরণ করা হচ্ছিল। তৃষ্ণার্ত মানুষ ভ্যান ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে এখানে চলে পানি বিতরণ কার্যক্রম। রিক্সাচালক, সিএনজি অটোরিক্সা চালক, ভবঘুরে, এমনকি ট্রাফিক পুলিশের সদস্যকে এখানে পানি পান করতে দেখা যায়। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এই ধরনের মানবিক উদ্যোগ অনেক দিন ধরেই অব্যাহত রেখেছেন। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজটি হচ্ছে। গরমের পুরো সময় কাজ চলবে বলে জানান তারা।

জলপানের ব্যবস্থা করা হয়েছে ঢাকা মহানগর দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতির পক্ষ থেকেও। শনিবার দুপুরের দিকে প্রেস ক্লাব এলাকায় এই সমিতির কার্যক্রম চোখে পড়ে। এখানেও ভ্যানে করে খাবার পানি বিতরণ করা হচ্ছিল। একসঙ্গে দুই থেকে তিন গ্লাস পানি পান করতেও দেখা গেছে কাউকে কাউকে। ব্যবসায়ীদের অনেক বদনাম। তবে এই মুহূর্তে বদনামের কথা ভুলে অনেকেই তাদের প্রশংসা করেছেন!        

সরাকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে পানি বিতরণের কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স। সংস্থাটির মূল কাজ অগ্নি নির্বাপণ। এর ফাঁকেই পথচারী, রিক্সাচালক ভিক্ষুকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে সুপেয় পানি বিতরণের কাজ করছে। গত বুধবার  সচিবালয় এলাকা, ধানমন্ডি নম্বর সড়কসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পানীয়জল বিতরণ করা হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই কার্যক্রম। এরপর থেকে একেক দিন একেক এলাকায় জলপান করানো হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসীমের দেওয়া তথ্যমতে, বুধবার সকাল থেকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ১৮০০ লিটারের ওয়াটার ট্যাঙ্ক বসিয়ে সেবাটি প্রদান করা হয়। দুজন সদস্য পানি বিতরণ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পানির ট্যাঙ্কের পাশে অবস্থান করেন। বর্তমানে একেক দিন একেক জায়গায় এই সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।    

ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. সালেহ উদ্দিন জানান, যারা রাস্তায় সামান্যতম ক্লান্তিতে থাকবেন তারাই ট্যাঙ্ক থেকে পানি পান করতে পারবেন। তীব্র দাবদাহ যতদিন স্বাভাবিক হবে না, ততদিন কার্যক্রম চালু রাখা হবে বলেও জানান তিনি।  

গরমে ঢাকায় সাধারণ পথচারীদের তেষ্টা মেটাতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান মানবিক মানুষ হিসেবে আলাদা স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার উদ্যোগে ১৬ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার পানির ট্যাঙ্কের মাধ্যমে গত সোমবার থেকে সুপেয় পানি বিতরণ করা হচ্ছে। ডিএমপি মিডিয়া উইংয়ের এডিসি কেএন রায় নিয়তি জানান, বিভিন্ন দিনে মতিঝিল শাপলা চত্বর, পল্টন, গুলিস্তান মাজার, পুরনো হাইকোর্ট ভবন, টিএসসি, নীলক্ষেত মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, বাটা সিগন্যাল, ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ড এবং কাওরান বাজারে পানি বিতরণ করবে ডিএমপি। ছাড়া গত শনিবার থেকে মহানগরের বিভিন্ন পয়েন্টে সাধারণ জনগণ, পথচারীদের মাঝে সুপেয় পানি বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ, যা অব্যাহত থাকবে।

এখানেই শেষ নয়, অতিরিক্ত গরম থেকে পথচারীদের রক্ষা করতে রাজধানীতে অস্থায়ী বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি। শনিবার মগবাজার মোড়ে তাদের এই কার্যক্রম চোখে পড়ে। যারপরনাই ব্যস্ত এলকায় বিশ্রামাগার গড়ে তোলা হয়েছে। এর ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু চেয়ার পাতা। আছে ফ্যানের ব্যবস্থাও। সাধারণ পথিকরা সেখানে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। রাখা হয়েছিল পানি পানের ব্যবস্থাও। বিতরণ করা হচ্ছিল   আমিন নামের এক রং মিস্ত্রি শার্টের বোতাম খুলে দিয়ে বসেছিলেন ফ্যানের সামনে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘যেইখানে কাজ করতাছি, সেইখানে ফ্যান নাই। কী যে কষ্ট, ভাই! এখানে আইসা জীবনটা বাঁচাইলাম।

এদিকে, বাড়তি কৌতূহল দেখা দিয়েছে কৃত্রিম বৃষ্টি নিয়ে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এই কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করছে প্রতিদিন। একেক দিন একেক রাস্তা ধরে ছুটছে ওয়াটার ক্যানন। কখনো শূন্যে, কখনো রাস্তায় পানি ছিটানো হচ্ছে। ওপর থেকে স্প্রে করা পানি গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঝরছে। এভাবে পরিবেশ কিছুটা শীতল করার চেষ্টা। মজার বিষয় হচ্ছে, ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিকরাও ওয়াটার ক্যানন দেখলে দৌড়ে সেদিকে যাচ্ছেন। আর দূরন্ত কিশোরা তো জামা খুলে দাঁড়িয়ে পড়ছে পানির নিচে! অদ্ভুত এই উৎসব চোখে পড়েছে কি? উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বিচিত্র উদ্যোগ যতদিন সম্ভব অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও যারা জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন, তাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে সড়কে পানি ছিটানো হচ্ছে। এর ফলে যে জায়গায় পানি ছিটানো হয়, সে জায়গার বাতাস কিছুটা হলেও শীতল হয়। আশপাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করা মানুষ স্বস্তি বোধ করেন। জন্যইপ্রাকৃতিক সমস্যাবলে একেবারে বসে না থেকে চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি। তার দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকা উত্তর সিটিতে পানি ছিটানোর দুই ধরনের ১২টি ভারী যন্ত্র রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুটি হচ্ছে স্প্রে-ক্যানন। আর ১০টি হচ্ছে ওয়াটার বাউজার। প্রতিটি স্প্রে-ক্যানন ১৫ হাজার লিটার পানি ধারণ করতে পারে। একবার পানি ভরলে একটি স্প্রে-ক্যানন দিয়ে প্রায় ২৫ কিলোমিটার সড়ক এলাকায় পানি ছিটানো যায়। আর ১০টি ওয়াটার বাউজারের প্রতিটিতে ১০ হাজার লিটার করে পানি ভরা যায়। এই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ লিটার পানি সড়কে ছিটাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি।

রাজনৈতিক দলগুলোও কিছু কাজ করছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ব্যাপকহারে পানি এবং ওরস্যালাইন বিতরণের কাজ করছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও শনিবার শান্তিনগর এলাকায় পানি বিতরণ করেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

এসবের বাইরে অনেক মানবিক মানুষ নিজে উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন সেবা দিচ্ছেন। কেউ বাসার সামনে বেসিন বসিয়ে দিয়ে মুখে জল ছিটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কেউ নিজে গাড়িতে করে পানির বোতল নিয়ে বের হচ্ছেন। গাড়ি থামিয়ে বিতরণ করছেন। এমনকি অনেকে পশু পাখিদের জন্য পানির ব্যবস্থা করছেন। সব মিলিয়ে অসাধারণ। আমরা তো এমন অসাধারণ মানুষমানবিক সমাজই দেখতে চাই

×