ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

জন্মবার্ষিকী স্মরণে ॥ নজরুলের চেতনায় নারী

প্রকাশিত: ০০:০৪, ২৪ মে ২০২২

জন্মবার্ষিকী স্মরণে ॥ নজরুলের চেতনায় নারী

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলার আকাশে ধূমকেতুর মতো যার অভ্যুদয়। পরাধীন ভারতে এক ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ আবহে বিদ্রোহী কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা, সৃষ্টিশীল জগৎ তৈরি করা। বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারের ১৮৯৯ সালে নজরুল মা জাহেদা খাতুনের কোল আলো করে পৃথিবীতে আসেন। বাংলার জ্যৈষ্ঠ মাসের ১১ তারিখ। বিশ শতকীয় অবিভক্ত ভারতের উন্মত্ত আস্ফালনের কঠিন সময় নজরুলের সংগ্রামী বৈতরণী বয়ে চলা সমকালীন অঙ্গনের এক দুঃসহ ইতিবৃত্ত। সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ও ব্রিটিশ শাসনের একাধিপত্যে অতি সাধারণ মানুষ অসহনীয় অবস্থায় নিপতিত হয়। মানুষে মানুষে পর্বতপ্রমাণ ফারাক, তারচেয়েও বেশি অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া অর্ধাংশ নারীর দুর্ভোগ, নিপীড়ন সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার এক অশুভ সংকেত। সংগত কারণে ভেতর থেকে উদ্দীপ্ত হতে থাকে বিদ্রোহীর দাবানলে বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব¡। এমন অনধিগম্য বিরাট সামাজিক অসাম্য, বৈষম্যের প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন- শুধু সমাজই নয় নারীর নিজেও তাদের যথার্থ মুক্তির ব্যাপারে কেমন যেন অসংহত, দ্বিধান্বিতই শুধু নয় উদাসীনও বটে। সর্ব মানুষের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে খড়গগ্রস্ত হতে গিয়ে নারী জাতির অসম্মান, অপমানের বিরুদ্ধেও তার ক্ষুরধার লেখনীকে শাণিত করতে মোটেও ভাবলেন না। সেটা শুধু কাব্যিক ছন্দোবদ্ধ আবেগেই নয় বরং সুচিন্তিত মতামতের দৃঢ় অভিব্যক্তিও নানা মাত্রিকে সৃজন ও মনন দ্যোতনায় ভর করে। বাঙালীর সমাজ চেতনায় নারীর অধিকারও স্বাধীনতায় দীর্ঘ সময়ের যে অবাঞ্ছিত রোষানল তাকে কোনভাবেই মানেননি নজরুল। অবহেলিত নারী সমাজকে তার যোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই চিরায়ত রুদ্ধ সংস্কারের মূলে সজোরে করাঘাত করা ছাড়া বঙ্গললনার মুক্তি সুদূর পরাহত। নারীকে তার আজন্ম রুদ্ধ পরিবেশ থেকে বের করে আনতে গেলে শিক্ষাব্যবস্থাকে অবারিত করা ছাড়াও হরেকরকম অপঘাত এবং বন্ধন থেকেও মুক্ত করতে হবে। শিক্ষার মতো উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচকে সম্পৃক্ত হয়ে সব ধরনের বন্ধনজালের অর্গল উপড়ে ফেলার উদাত্ত আহ্বান জানান উদীয়মান সময়ের প্রজন্মের প্রতি। বিদ্রোহী কবির আকুল আবেদন ছিল কল্যাণী নারীদের তাদের প্রাপ্য সম্মানের আলোকে অর্ধেক আসন ছেড়ে দেয়া সময়ের অনিবার্য চাহিদা। এমন অভিমতও ব্যক্ত করেছেন- ‘আমাদের পথে মোল্লারা যদি হন বিন্ধ্যাচল, তাহা হইলে অবরোধ প্রথা হইতেছে হিমাচল।’ যাকে কবি শ্বাসরোধের সঙ্গে তুলনা করতেও ক্ষান্ত হননি। যেহেতু সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তির সিংহভাগ পুরুষশাসিত সমাজের সঙ্গত কারণে মুক্তির বারতাও ধ্বনিত হবে শক্তিমান পুরুষদের পক্ষ থেকেই। নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন কত প্রতিভা আর ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো নারীরা সমৃদ্ধভাবে তৈরি হওয়ার বিপরীতে সব ধরনের গুণাবলী হারাতেও সময় লাগেনি। সমাজের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নিজেদের জলাঞ্জলি দিতেও অনেক নারীকে দুর্ভোগও লাঞ্ছনা পোহাতে হয়েছে। ঘরবন্দী নারীদের বিদ্রোহের ধজা উড়িয়ে বদ্ধ গৃহের তালা খুলে দিতে হবে। অন্য অনেকের মতো নজরুলও মনে করতেন নিজেকে নিজেই বাঁচাতে হবে। এছাড়া বিকল্প পথ অন্য কিছুতে নেই। শেকল ভাঙার গান গাইতে হবে নারীদের অন্তরের নিভৃত আঙিনা থেকে। দুঃসাহসিকা নারীকে নির্ভীক পদভারে সামনের দিকে দুরন্ত বেগে এগিয়ে যেতে হবে। কবির মতে জুজুবুড়ির ভয়ে কম্পমান শুধু পুরুষরাই নয় বরং মেয়েদের যেভাবে আবৃত করে রেখেছে সেটাকে তাড়ানোর শক্তিও অর্জন করতে হবে। তবে পিতৃহীন নজরুল স্নেহময়ী জননী জাহেদা খাতুনের মায়া মমতা থেকে এক প্রকার দূরেই ছিলেন। মাতৃ সান্নিধ্য থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন নজরুল মায়ের অভাব পূরণেও সকাতর অনুভূতিতে এক প্রকার বিমর্ষই থাকতেন। কাব্য মহিমায় নিজের মায়ের বন্দনা অপ্রকাশিত থাকলেও অন্যত্র মাতৃস্নেহের সন্ধান কবির জীবনের আবশ্যকীয় পর্যায়। মা বিরজা সুন্দরী কিংবা মিসেস এম রহমানকে নিবেদিত কাব্য শৌর্য আজও মাতৃমহিমার অনন্য নজির। আর নারী জাতির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া তো ছিলেন বিদ্রোহী কবির কাছে অনবদ্য এক রমণীয় ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তার অনুসৃত নারী শিক্ষা বঙ্গললনার সার্বিক মুক্তির যথার্থ নির্দেশনা বলে নজরুল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। নারী জাতির যথার্থ অভিভাবক বেগম রোকেয়াকে পাওয়া বঙ্গদেশের রমণীদের জন্য এক বিরাট উপহারই শুধু নয় আশীর্বাদও বটে। শুধু তাই নয় তাকে প্রাসঙ্গিক অর্থে কাজে লাগিয়ে বাংলার নারীদের এগিয়ে যাওয়া একান্ত জরুরী। শুধু শিক্ষা নয়, সাংস্কৃতিক বিকাশেও নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সৃজন ও মনন দ্যোতনায় পড়বে প্রয়োজনীয় প্রভাব ও বিকাশ। সেই কারণেই নজরুলের ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় নারীদের জন্য একটি বিশেষ স্থান নির্ধারণ করা ছিল ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ নামে। যেখানে নারীরা তাদের চিন্তা, চেতনা, ধ্যান ধারণা, প্রতিভা বিকাশে বিভিন্ন মননশীল লেখা ছাপাতে পারতেন। লেখা যথানিয়মে আসতো- কবি তা নির্দ্বিধায় ছাপাতে কার্পণ্য করতেন না। মিসেস এম রহমানের লেখাতো নিয়মিতই প্রকাশ পেতো। সমকালীন আঙিনা উত্তপ্ত হতেও সময় লাগতো না। শুধু যে পুরুষরা এমন লেখনীর প্রতিপক্ষ ছিলেন তা কিন্তু নয় অনেক রক্ষণশীল মহিলারাও এর বিরুদ্ধাচরণ করতে পিছপা হতেন না। প্রতিবাদী চেতনায় কড়া প্রত্যুত্তরও আসতে দেরি হতো না। তৎকালীন সময়ে এই ধারণাই প্রচলিত ছিল যে ‘সন্ধ্যা প্রদীপে’ নারীরাই পক্ষে, বিপক্ষে, বিতর্কে, মতদ্বৈততায় নিয়োজিত থাকতেন। এভাবে নজরুলের চেতনায় নারীর সামগ্রিক বিকাশ সম্প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তো। সেটা মননশীল কিংবা সৃজনসম্ভার যাই হোক না কেন। নারীর প্রতি সহনশীল এই সংগ্রামী প্রাণপুরুষ নারীকে তার যথার্থ মর্যাদা দিয়ে তাদের অধিকার হরণকেও অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যাত করেছেন। নারী শক্তির পূজারী এই বিপ্লবী মহানায়ক আন্দোলন আর লড়াইকে আমলে নিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জীবনের অনুগামী করতে সব সময় পরামর্শ দিতেন। ভাবতেন পুরো একটি অংশের অর্ধেকই যদি অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থেকে স্বাধীনতা আর অধিকার হারাতে বসে, তাহলে সমাজ ব্যবস্থায় আলো বিকিরণ হতে আরও বহু সময় গড়িয়ে যাবে।
×