ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

খন্দকার ইসমাইল

শান্তিবাহিনীর অস্ত্রসমর্পণের স্মৃতি-১

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

শান্তিবাহিনীর অস্ত্রসমর্পণের স্মৃতি-১

বাংলাদেশ টেলিভিশনে একদিন অনুষ্ঠান ঘোষণা করছিলাম। হঠাৎ একজন এসে বললেন, আপনাকে আলী ইমাম সাহেব ডাকছেন, খুব জরুরী। আলী ইমাম ভাই তখন উপস্থাপনা শাখার অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ ছিলেন। আমি ভাবলাম কোন ভুল ঘোষণা করলাম কি না? ভয়ে ভয়ে ইমাম ভাইয়ের রুমে গিয়ে তাঁর পাশের চেয়ারে বসলাম। উল্লেখ্য, বিটিভিতে আমার প্রথম পদার্পণ এই আলী ইমাম ভাইয়ের মাধ্যমে। আলী ইমাম ভাই বললেন ‘এক্ষুনি জিএম নওয়াজেশ আলী খান সাহেবের কাছে তোমার বায়োডাটা দিয়ে আস। তোমাকে খাগড়াছড়ি যেতে হবে।’ আমি এতক্ষণ যে ভয়ের আশঙ্কায় ছিলাম তা কেটে গেল। বায়োডাটা জমা দিলাম সিকিউরিটি পাসের রুমে। খাগড়াছড়ির কথা শুনে খুব ভাল লাগল। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা লোকমুখে অনেক শুনেছি, বইপত্রে পড়েছি। খাগড়াছড়ি একটি নদীর নাম। নদীর পাড়ে খাগড়ার বন থাকায় পরবর্তীকালে তা পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে ওঠে। ফলে তখন থেকেই এটি খাগড়াছড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। এখন সেখানেই আমাকে যেতে হবে ভেবে মনে দারুণ আনন্দ লাগছে। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সময়কার সংঘর্ষ, রক্তপাত, হানাহানির বিবরণ। কিন্তু কি কারণে এত হানাহানি কখনও জানতে পারিনি। বিগত দিনে যারা দেশের ক্ষমতায় ছিলেন তারাও কখনও এই ব্যাপারটি জনগণকে জানতে দেয়নি। দীর্ঘদিনের এই হানাহানি, রক্তপাত বন্ধের জন্য বহুদিন আগে থেকেই শান্তিবাহিনীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ’৯৬ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের শাসন ভার গ্রহণ করার পর তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য সমস্যাকে একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে চেয়ারম্যান করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠন করে। এই কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা নামে পরিচিত) ও অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বহুকাক্সিক্ষত ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি দেশ বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। শান্তি চুক্তির অনেকগুলো শর্তের মধ্যে একটি শর্ত ছিল, চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে অস্ত্র জমা দানের দিন তারিখ স্থান নির্ধারণ করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড় টিলা পরিবেষ্টিত সবুজে ঘেরা খাগড়াছড়ি জেলার নবনির্মিত স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দানের ঘোষণা দেয়া হয়। ওইদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৭৩৯ জন সদস্য সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম দফা অস্ত্র জমা দেবে। সূচিত হবে একটি ঐতিহাসিক দিন। অনুষ্ঠানটিকে সফল করার জন্য চলতে থাকে বিপুল আয়োজন। খাগড়াছড়ির চারদিকে সাজ সাজ রব। নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে সরাসরি সম্প্রচার সম্ভব নয়। কথা চলছে কলকাতা দূরদর্শনের সঙ্গে। সফল হয়নি আলোচনা। আবারও অনিশ্চয়তা। কিন্তু অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। পুরো জাতির দৃষ্টি খাগড়াছড়ির দিকে। তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ-এর প্রচেষ্টায় ৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয় সরাসরি সম্প্রচারের। বাংলাদেশ বেতারও সরাসরি সম্প্রচার করবে এই অনুষ্ঠান। ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে ঐতিহাসিক অস্ত্র জমা দান অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ধারাভাষ্যকার হিসেবে সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের, আবেদ খান, শাহরিয়ার কবির, ড. হারুন অর রশিদ এবং সার্বিক উপস্থাপনা ও বর্ণনার জন্য বিটিভির পক্ষ থেকে আমাকে নির্বাচন করা হয়। এত বড় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনও ব্যাপক। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, বিটিভির নিজস্ব প্রযুক্তির ইতিহাসে এই প্রথম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে। অনুষ্ঠানের গুরুত্ব আরও বেশি উপলব্ধি হলো তখন, যখন তথ্য মন্ত্রণালয়, ডিজির অফিস কিংবা কখনও টেলিভিশন থেকে বারে বারে ফোন আসে আমার কাছে। সবার প্রশ্ন একটাই, খাগড়াছড়ি যাওয়ার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছি কিনা? কারণ, পুরো অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত। অনুষ্ঠানটিকে সফল করার জন্য খাগড়াছড়ি যাওয়ার আগে ৮ ফেব্রুয়ারি ধারাভাষ্যকার আমরা সবাই সৈয়দ হাসান ইমাম ভাইয়ের অফিসে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মিটিং করে অনুষ্ঠানটি কি ভাবে করব, কে কি বলব, কতটুকু বলবÑ তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করি। মিটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু মজার গল্পও হয়েছে। যেমনÑআমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেয়ার সময় হাসান ভাই প্রধানমন্ত্রীর ইন্টারভিউ নেবেন। আবেদ ভাই তখন বললেন, ‘আচ্ছা হাসান ভাই ধরুন ইন্টারভিউ নেয়ার সময় আপনাকে কেউ গুলি করল, আপনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন আপনার কাজ আমি কি ভাবে চালিয়ে নিতে পারি বলুন তো।’ হাসান ভাই তখন বললেন, ‘আমি গুলি খেলে তোমাকে আর অনুষ্ঠান চালাতে হবে না।’ আবেদ ভাই মুখ গম্ভীর করে বললেন, ‘কেন’? হাসান ভাই বললেন, ‘ছোট বেলায় একটা ধাঁধা আমরা প্রায়ই একজন আরেকজনকে বলতাম। তা হলো একটি গাছে ৬টি পাখি আছে। একটিকে গুলি করলে আর কয়টি থাকবে।’ এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়িতে হাজারো অতিথি যাবেন। এই ছোট্ট শহরে এত লোকের থাকা খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা হবে কিনা, সে ব্যাপারে সবাই সন্দিহান ছিলাম। ম. হামিদ ভাই বললেন (বিটিভির অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ), ‘কোথায় থাকা হবে জানি না, হয়ত সবাইকে কষ্ট করতে হতে পারে’। তিনি সবাইকে মশার কয়েল, কিছু শুকনো খাবার, চিড়া, গুড় এবং পানি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কেউ আবার খাবার স্যালাইন এবং ওষুধপত্র নিয়ে যেতে বললেন। আমার ভেতর এক ধরনের ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা কাজ করছিল। আমি সবার কথা রাখলাম। ৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় হাসান ভাইয়ের অফিসের সামনে থেকে আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা হব। আগের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত জিনিসপত্র গোছালাম। স্লিপিং ব্যাগ, গরম পানির ফ্ল্যাক্স, মিনারেল ওয়াটার, বিস্কুট, জুস, মশার কয়েল, ওষুধ, জামা-কাপড়, সেভিংয়ের জিনিসপত্র, টুথব্রাশ, ক্রিম, টাই, ব্লেজারসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে বড় এক ব্যাগ ভর্তি করলাম। বুঝলাম, একজন মানুষকে বাইরে কোথাও যেতে হলে কত কিছুর প্রয়োজন হয়। যা ঘরে থাকলে বোঝা যায় না। ভোর হলোÑ যাওয়ার জন্য সকল প্রস্তুতি শেষ। আমার স্ত্রী বিলকিস নাহার স্মৃতিসহ এক সঙ্গে বের হলাম। সে মতিঝিলে অফিসে যাবে। আমি বিএমএ ভবনে হাসান ভাইয়ের অফিসে নেমে গেলাম। সবাই একত্র হলাম। আমাদের যাওয়ার বাহন ছিল ৪টি বড় গাড়ি, ২টি মাইক্রো, ২টি পাজেরো এবং একটি ছটলু ভাইয়ের (আলী যাকের) গাড়ি। সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। দলের সব চাইতে কনিষ্ঠ সদস্য হলাম আমি। শাহরিয়ার কবির, আবেদ খান, আলী যাকের এক গাড়িতে। সাংবাদিকবৃন্দ এক গাড়িতে, মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তা এক গাড়িতে, সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. হারুন অর রশিদ এবং আমি অন্য আরেকটি গাড়িতে। সব গাড়িতেই কিছু কমলা এবং পানীয়র বোতল দেয়া হলো। রওনা হওয়ার আগে সিদ্ধান্ত ছিল চলতি পথে হাইওয়ে-ইন রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে একসঙ্গে লাঞ্চ করব। যাত্রা শুরু হলো। সকাল ১০টা। ঢাকা শহরের অতি পরিচিত ঐতিহ্যবাহী চিত্রের মুখোমুখি হলাম। প্রেসক্লাব থেকে ডেমরা যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগল। যদিও ১৫ মিনিটের পথ। তারপরের পথ ছিল খুব আরামদায়ক। গাড়িতে গল্প করতে করতে দুপুর দেড়টা বেজে গেল। হাইওয়ে ইন রেস্টুরেন্টের সামনে তিনটি গাড়ি থামালাম। ছিমছাম চমৎকার রেস্টুরেন্টের দোতলায় সবাই বসলাম। অন্য গাড়িটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সাংবাদিকদের নিয়ে ওই গাড়িটি ভুলে অন্য এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেছে। অবশ্য খাগড়াছড়ি পৌঁছার আগে পথে তাদের সঙ্গে আর আমাদের দেখা হয়নি। হাসান ভাই খাবারের অর্ডার দিলেন। তিনি ভেজিটেবল পছন্দ করেন তার সঙ্গে মাছ। আমিও হাসান ভাইয়ের দেখাদেখি ভেজিটেবল এবং মাছ নিলাম। এর আগে আমরা সবাই সুপ খেলাম। সবাই খাচ্ছি আর গল্প করছি। অনেক গল্পের মাঝে ছটলু ভাই তার বাবার স্মৃতিচারণ করলেন। তার বাবা একজন আইনজীবী। ‘দরিদ্র পরিবারের একটি ছেলে তার মাকে বঁটি দিয়ে আঘাত করলে এলাকার লোকজন ক্ষুব্ধ ছেলেটিকে ধরে মারধর করে এবং তার মাকে দিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করায়। সমস্যাটি তাহের সাহেবের (আলী যাকেরের বাবা) কাছে যায়। তিনি মামলাটি অন্যভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এলাকাবাসীর জোর দাবি ছেলের বিচার হতে হবে। তাহের সাহেব ছেলে আর ছেলের মাকে একটি রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করলেন এবং একজনকে বললেন একটি বড় কাঁঠাল নিয়ে আসতে। তিনি দু’জনের সঙ্গেই কথা বললেন। এলাকাবাসীর দাবি ছেলের বিচার চাই। কাঁঠাল আনা হলো। তাহের সাহেব কাঁঠাল হাতে নিয়ে একটি গামছা দিয়ে ছেলের পেটে কাঁঠাল বেঁধে এক ঘণ্টা হাঁটতে বললেন। কিন্তু ১০ মিনিট হাঁটার পর ছেলের কষ্ট দেখে মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ছেলেও মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। তখন তাহের সাহেব হাসতে হাসতে ছেলেকে বললেন তোমার মা ১০ মাস ১০ দিন কষ্ট করে তোমাকে পেটে ধরেছেন আর তুমি তাকে মারতে গেলে। ছেলে মায়ের কাছে ক্ষমা চাইল। মা তখন ছেলেকে ক্ষমা করে দিলেন। মামলা তুলে নিলেন।’ এর মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ। প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেল কেউ উঠছে না। অবশেষে আমি বললাম, এবার মনে হয় আমরা উঠতে পারি। সবাই সহাস্যে সম্মতি জানালেন। ভাল সময় কাটল রেস্টুরেন্টে। যাত্রাপথের বিরতি স্থানগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক আধুনিক হয়েছে। আমরা যে যেই গাড়িতে ছিলাম আবার সেভাবে যাত্রা শুরু করলাম। আমরা কথা বলছি। গাড়ি চলছে দ্রুতগতিতে। পথে একটা বাস পড়ে থাকতে দেখেছি। সম্ভবত কিছুক্ষণ আগে দুর্ঘটনা ঘটেছে। মনটা খারাপ হলো। (চলবে) লেখক : টেলিভিশন উপস্থাপক নির্মাতা ও নির্দেশক
×