ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

সম্পর্কে খুনসুটি

প্রকাশিত: ০০:০৮, ৩ জানুয়ারি ২০২২

সম্পর্কে খুনসুটি

ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্কের বাঁধন আমাদের দেশে চিরায়ত এক সামাজিক সৌহার্দ্যরে। সেই প্রাচীনকাল থেকে রামায়ণের রাম যখন চৌদ্দ বছরের বনবাসে তখন ছোট ভাই ভরত রাজা দশরথের আজ্ঞা অনুযায়ী সিংহাসনে বসেননি। বরং রামের পাদুকাই রাজার আসন অলঙ্কৃত করে। আর ভরত নিচে বসে রাজকার্য পরিচালনা করেছেন। ধর্মীয় উপাখ্যানের এমন অভিনব ভ্রাতৃপ্রীতি যুগেও সময়ের বিবর্তনে ফারাক দৃশ্যমান হলেও সহোদরের সহজাত সম্পর্কের চিড় ধরা অত সহজ ব্যাপার নয়। আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শাস্তি’ গল্পেও বলতে শুনি- বউ গেলে বউ পাবো ভাই চলে গেলে আর মিলবে না। এ শুধু গল্প কাহিনী নয়, আবহমানকাল ধরে চলে আসা ভাইয়ের চিরস্থায়ী বন্ধনেরও দৃঢ় শক্তি। এখনও আপন ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন যতই থাকুক মূল বাঁধনে এক অচ্ছেদ্য অন্তর্নিহিত বোধ সংশ্লিষ্টদের নানাভাবে জড়িয়ে রাখে। আবার বড়-ছোটর ফারাকের মধ্যে থাকে সম্পর্কে গভীরতম পর্যায়। বড় ভাই আগেই পৃথিবীর আলো দেখে। ছোট ভাই হয়ত তার চেয়ে ৩-৫ বছরের ব্যবধানে জন্ম নেয়। কিন্তু সে মাত্রায় বড়জন আনন্দে আপ্লুত হয় ছোট্ট কোমলমতি এক সহোদরকে পেয়ে। স্নেহ মমতায় আবিষ্ট করে রাখা ছাড়াও বন্ধুত্বের নিগূঢ় টানে পাশে একজন সঙ্গী পাওয়াটাও যেন অপূর্ব উপহার। তেমন অনন্য মায়ার বাঁধন সব সময় এক ও অবিচ্ছিন্ন থাকে না। বড় হওয়ার পালাক্রমে টানাপোড়েন এবং জীবনের অভিঘাতে নির্মল বাঁধন যে কখন আলগা হতে থাকে তাও বোঝা মুশকিল। বয়োবৃদ্ধির প্রাক্কালে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে বাবা-মায়ের কাছে কে বেশি প্রিয়। সেখানেই আসে চরম বিড়ম্বনা ও বিভ্রান্তি। আসলে পিতা-মাতা সব সন্তানকেই সমানভাবে দেখার চেষ্টা করেন। তবে শান্ত আর দুষ্টুর ভিন্ন মাত্রার বৈশিষ্ট্যে অপেক্ষাকৃত ভাল ছেলের দিকে ঝুঁকে পড়াটা বাহুল্য নয়। আবার দুষ্টু ছেলেটার দিকে সজাগ-সচেতনতায় পরম স্নেহের ছায়া দেয়াও পিতা-মাতার বিশেষ কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যায়। এ ছাড়া নিজেদের মধ্যেও তৈরি হয় এক ধরনের অকারণ খুনসুটি। পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, যত্নআত্তির সবকিছুই যেন দুজনের গভীর সম্পর্কের চিড় ধরায়। মনোমালিন্য হয়, হালকা পাতলা মারামারির পরিস্থিতি তৈরি হতেও সময় লাগে না। তবে বিচক্ষণ এবং স্নেহশীল বাবা-মা গভীর মমত্ববোধে দুই ছেলের মানসিক দ্বন্দ্বকে মিটিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন না। বিশেষ করে কারও পক্ষে নেয়া পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে যায়। সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় তরুণদের বেড়ে ওঠাও এক আপৎকালীন সময়। বয়োসন্ধিক্ষণের এই স্পর্শকাতর কালপর্বে ভাল-মন্দের ফারাক অপসৃত হয়। চোখে থাকে রঙিন চশমা। হয় পৃথিবীকে রঙের আধার মনে হয়। নতুবা কালো অন্ধকারের বিপন্ন জগতে হিমশিম খাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায়ও থাকে না। সময়টা খুবই উদ্বেগজনক। বাবা-মা আর অভিভাবকদের শক্ত হাতে লাগাম টানতে হয়। শাসনের অযৌক্তিক বিড়ম্বনাকে সামাল দিতে হয়। স্নেহের আতিশয্যের বাঁধনকে আরও নিবিড় করে সন্তানদের ভাবী জীবনযাত্রাকে নিরুদ্বেগ করে তোলাই পরিস্থিতির অপরিহার্য চাহিদা। আর দুই সহোদরকেও বুঝতে হবে নিজেদের মধ্যে অকারণ দুর্ভোগ ডেকে আনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মিলে মিশে এক সঙ্গে বাবা-মায়ের স্নেহ ছায়ায় অনাগত জীবনকে তৈরি করাই মহান ব্রত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
×