ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীতে বিলিন হতে চলেছে নাকুগাঁও বধ্যভূমি

প্রকাশিত: ১৬:০৮, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীতে বিলিন হতে চলেছে নাকুগাঁও বধ্যভূমি

সংবাদদাতা, নালিতাবাড়ী, শেরপুর ॥ শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁও স্থলবন্দর সংলগ্ন ‘নাকুগাঁও বধ্যভূমি’র অধিকাংশ জায়গা পাশে বয়ে চলা ভোগাই নদী গর্ভে বিলিন হতে চলেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত এই বধ্যভূমি। তাই স্বাধীনতান স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারীভাবে উদ্যোগ করার জন্য জোড়দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। উপজেলার নাকুগাঁও স্থলবন্দর সংলগ্ন ভারত সীমানার কাঁটাতারের বেড়াঘেঁষে ২০ শতাংশ জমিতে এই বধ্যভূমির বেশিরভাগ জায়গা এখন পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি খরাস্রোতা ভোগাই নদী গর্ভে বিলীন হতে চলেছে। যে অংশটুকু রয়েছে তাতেও কখনো খড়ের গাদা, ঝোপঝাঁড় আবার কখনো গরু ছাগল বিচরণ করতে দেখা যায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মে। এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বর্বরোচিত হামলা চালায় উপজেলার নয়াবিল ইউপির নাকুগাঁও সীমান্তের স্থলবন্দর এলাকায়। পাকহানাদার বাহিনী অতর্কিতভাবে গণহত্যা চালিয়ে ঘণ্টা খানিকের মধ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও নাকুগাঁও বধ্যভূমিকে রক্ষার কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্নস্থানে এসব বীর শহীদদের স্বরণে স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হলেও অযতœ আর অবহেলায় পড়ে আছে নাকুগাঁও বধ্যভূমি। জানা গেছে, এদিন পাক হায়েনাদের হামলায় নিহত হওয়া ৯ জন বিএসএফের হিসেব জানা গেলেও বাংলাদেশিদের সঠিক পরিসংখ্যান আজও জানা যায়নি। নিহত বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল মোতালেব ও আশফাকুর রহমান। এ দু’জনের লাশ ভারতের বিএসএফ বাহিনী নাকুগাঁও সীমান্তের ভারত অংশের মসজিদ সংলগ্ন এক কবরস্থানে দাফন করা হয়। বাকি বাঙালিদের লাশ বাংলাদেশে সমাহিত ও ভারতীয়দের ভারতে দাহ করা হয়। সীমান্ত এলাকার কোলঘেঁষে নোমেন্স লেন্ড এলাকা হওয়ায় এখানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা যাচ্ছে না। তবে এলাকাবাসী জানান, নোমেন্স ল্যান্ড এলাকা হলেও এ বধ্যভূমির আশ পাশে বাংলাদেশ অংশে অনেক বাড়ি-ঘর আর ভারতীয় অংশে বিএসএফ ক্যাম্প ও স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে ভারতীয়রা। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম বেলায়েত হোসেন খসরু ও ১৯৯২ সালের ২৭ জুন শেরপুরের জেলা প্রশাসক এখানে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। অজ্ঞাত কারণে সে কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী সরেজমিনে এই গণকবরের হাল দেখে দ্রুত একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণের মৌখিক নির্দেশ দিলেও এ যাবতকালেও কোনো কাজ হয়নি। অথচ ভারত অংশের বধ্যভূমিকে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে সিমেন্ট ও কংক্রিটের পাইলিং করে তীরক্ষাবাঁধ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। শুধু অবহেলায় পড়ে আছে আমাদের গৌরবের স্মৃতি। এই বধ্যভূমির পার্শ্ববর্তী বাড়ির বাসিন্দা শ্রী রাজকুমার বলেন, আমি দেখেছি এখানে পাকহানাদার শত্রুরা অনেক মানুষ হত্যা করার পর এখানে তাদের গণকবর দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে এই বধ্যভূমির জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নাকুগাঁও গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা আমির ফকির বলেন, ‘সে দিনের ভয়াল স্মৃতির কথা আজও মনে পড়ে। এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রু মুক্ত করার জন্য প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করছে, আমিও দৃঢ়চিত্তে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। ১৯৭১ সালের ২৫ মে হঠাৎ নাকুগাঁও এ পাকবাহিনীরা আক্রমণ করে অগণিত ভারতের মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশি মুক্তিবাহিনীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমার মনের পরে নাইল্লা (পাট) জাগের মতো হেই দিন মানুষকে গণকবর দেওয়া অইছিল। কিন্তু এখানে আইজও কোনো প্রকার স্মৃতি সৌধ বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা অয় নাই।’ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শাহাবুদ্দিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে চিরঅম্লান করে রাখতে নাকুগাঁও বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হেলেনা পারভীন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলক নির্মাণের বিষয়টি সরাসরি জেলা প্রশাসক দেখভাল করে থাকেন। তাই জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
×