ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহামারী প্রতিরোধে দায়িত্বশীলতার বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ১৯ জুন ২০২১

মহামারী প্রতিরোধে দায়িত্বশীলতার বিকল্প নেই

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও এখন এক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় জোয়ারে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা করতে দেশের মানুষ আজ দিশেহারা। এ বছরের মধ্য মার্চ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন এক ধরনের ভাইরাসের ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণের ফলে যেভাবে মৃত্যু ও সংক্রমণের উল্লম্ফন হচ্ছে তাতে মানুষের জীবন রক্ষার বিষয়টিই এখন সরকারের নিকট অগ্রাধিকার পাচ্ছে। নতুন এই ভাইরাস অতি অল্প সময়ের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত করে মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম। এছাড়া নতুন ধরনের ভারতীয় ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে করোনার প্রথম ঢেউয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়ায় মানুষের মধ্যে করোনা ভীতি কমে আসছিল। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার উৎসাহে জনগণের মধ্যে গা ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছিল। গ্রাম-গঞ্জে উৎসব, সভা, কীর্তন, ওয়াজ মাহফিল, এমনকি খোদ ঢাকা শহরেও স্বাভাবিক জীবনকালের মতো জনসমাগমের কোন ঘাটতি ছিল না। করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনেকের মধ্যেই ঢিলেঢালা ভাব চলে আসছিল। স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনসচেতনতা তৈরি এবং করোনা ঠেকাতে মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব বজায়, সেনিটাইজার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ম-কানুন মানতে প্রচার মাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায়ও কিছুটা শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং জনস্বাস্থ্যবিদদের সতর্কতার পরও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। করোনা চিকিৎসায় বিশেষ যেসব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল তারও বেশ কিছু গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বসুন্ধরায় সরকারী খরচে করোনা সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে ২০০০ বেডের অস্থায়ী হাসপাতাল করা হয়েছিল তাও গুটিয়ে নেয়া হলো। এভাবে করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় কিছু হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেল। কতিপয় আইসোলেশন কেন্দ্র উঠে গেল। স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত ১০০ কোটি টাকা ব্যবহার করতে না পারায় অব্যবহৃত রয়ে গেল। বিদেশ হতে আগত যাত্রীরা কোয়ারেন্টাইন ছাড়াই অবাধে নিজ নিজ বাড়িঘরে যেতে লাগল। তাছাড়া করোনা চিকিৎসার উপকরণের ঘাটতি পূরণ করতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় জরুরীভিত্তিতে কেনার জন্য ১০২ কোটি টাকার জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন সামগ্রী ১০ মাস এয়ারপোর্টে পড়ে থাকার পর মাত্র কয়েকদিন আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খালাস করা শুরু করেছে। এতে অনেক উপকরণ নষ্ট হয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ধরনের অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সতর্কতা থাকলেও দায়িত্বে নিয়োজিত বিভাগসমূহের পরিকল্পনা, দূরদর্শিতার অভাব, সময়োচিত পদক্ষেপ না নেয়া এবং সর্বোপরি সমন্বয়হীনতার কারণে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর অবস্থা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু সম্প্রতি করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাবে চিকিৎসাসেবায় নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ভারতীয় ভাইরাস ২০ সালের ভাইরাসের চেয়ে তিনগুণ শক্তিশালী এবং এটি ত্রিমুখী রূপ পরিবর্তনে সক্ষম বলে বিশেষজ্ঞদের মতামতে জানা যায়। অধিকন্তু দেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য মহামারীকালে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। কারণ ভারতে এটি মহামারী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই রোগে প্রায় ২০০ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে। জাতীয় যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় পেছনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত প্রত্যেকটা আন্দোলন-সংগ্রামে এ জাতি দল-মত অহংবোধ ভুলে এক কাতারে লড়াই করে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করেছিল। এবারে মহামারীতেও আমরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে করোনার মরণ থাবা হতে জাতিকে রক্ষা করব। এখানে প্রত্যক্ষ সেবাদানকারীদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করা আছে। স্বাস্থ্যকর্মীগণ আক্রান্ত রোগীদের প্রত্যক্ষভাবে সেবাদানে নিবেদিত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে জনগণের মধ্যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে মাঠ পর্যায়ে সদা তৎপর। তাছাড়া গণমাধ্যম কর্মীগণ জনসচেতনতা সৃষ্টিতে মাঠ পর্যায়ে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সরকার, জনগণ, মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে সাংবাদিকগণ সেতুবন্ধন হিসেবে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার, জনগণ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে অজানা বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে পারে এবং এর সুফল আমরা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে এই তিন শ্রেণীর সেবাদান কর্মীদের করোনা মোকাবেলায় সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে সমগ্র জাতি কুর্নিশ জানায়। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলস সেবাদানের জন্য বিভিন্ন সময় জাতি একযোগে তাদের মহান সেবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্মুখ শ্রেণীর যোদ্ধার মধ্যে কারও অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অবশ্য রোগীর সংস্পর্শে থেকে প্রত্যক্ষ চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকায় ডাক্তারদের মৃত্যুর সংখ্যাই সর্বাধিক। এবারের লকডাউন চলাকালে এলিফ্যান্ট রোডে বিএসএমএমইউর একজন ডাক্তারের সঙ্গে কর্তব্যরত পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটের যে বাকবিত-া হলো তা অনভিপ্রেত। কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ডাক্তারকে আইডি দেখাতে বললে ঘটনার সূত্রপাত। ঘটনাটি চিকিৎসক ও পুলিশদের এ্যাসোসিয়েশন পর্যন্ত গড়ায়, উভয়পক্ষেই পাল্টাপাল্টি বিবৃতির মাধ্যমে নিজ নিজ পক্ষের অবস্থান তুলে ধরা হয় এবং এতে একপক্ষ অন্যপক্ষকে দোষারোপ করে। ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে এবং ভিডিওর ঘটনা দৃষ্টিগোচর হয়। বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে ডাক্তার-পুলিশের বাকবিতন্ডাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি কাম্য নয় বলে আদালত মন্তব্য করে। উচ্চ আদালতের মন্তব্যে বলা হয়, দেশের প্রত্যেকটা নাগরিক যখন করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত তখন এ ধরনের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি অনভিপ্রেত এবং সরকারী কর্মকর্তাদের নিকট থেকে সবাই দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে। হাইকোর্টের এই মন্তব্যের মধ্যে সরকারী কর্মকর্তাদের নিকট জাতির প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছে। অনেক ধরনের প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করে জাতি আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। এখন প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সব ভেদাভেদ ভুলে একতাবদ্ধ হয়ে সমন্বয়, দায়িত্বশীলতা, আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে মরণঘাতী করোনা মহামারী প্রতিহত করা। এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা, সহায়তা ও আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। কিন্তু প্রয়োজন হলো শীর্ষ পর্যায়ে প্রণীত নীতি নির্দেশনা বাস্তবায়নে নির্বাহী বিভাগসমূহের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় ও উদ্যম। এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে কর্মকর্তাদের উদ্যমে ভাটা পড়ে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। হাইকোর্টের মন্তব্য দিয়েই ইতি টানি- মহামারীতে বিপর্যস্ত অবস্থায় সরকারী কর্মকর্তাদের নিকট থেকে সবাই আরও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকরিজীবী
×