ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ॥ জানা-অজানা

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১৬ জুন ২০২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ॥ জানা-অজানা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। আমাদের দেশে যতগুলো সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে ও শিক্ষার মান বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান শীর্ষে। শিক্ষাদান ছাড়াও নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন এবং স্বাধিকার অর্জনের প্রত্যয়েও সদা মানবিক ও সোচ্চার থেকেছে এই অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এর শিক্ষার্থীরা। এক সময় আমাদের গর্ব এটিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। এ বছর আমাদের প্রাণপ্রিয় এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠার একশত বছর পূর্তি। ১৯২০ সালে বঙ্গীয় আইন সভা বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনী ভিত্তি লাভ করে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই পাঠদানের মধ্য দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ৮৭৭ জন ছাত্র নিয়ে। কলা, বিজ্ঞান ও আইনÑ এই তিনটি অনুষদ ও বারটি বিভাগ নিয়ে ছিল এর যাত্রা শুরু। প্রথম উপাচার্য ছিলেন মিঃ পি. জে হারটগ (চ.ঔ ঐধৎঃড়ম)। প্রথম কনভোকেশন হয়েছিল ১৯২৩ সালে। শুরুর বছরগুলোতে শিক্ষক ও ছাত্রদের বড় অংশই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আজ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ ছাত্র শিক্ষা গ্রহণ পর্ব শেষ করেœে। তাদের মধ্যে অনেকে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, আবার অনেকে হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অন্তরালে। এই বিশ^বিদ্যালয়েই কেটেছে আমার শিক্ষাজীবনের শেষ পর্ব। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক তথ্য জেনেছি। এখনও জানতে ইচ্ছে হয়। ১৯৯৩ সালে আমার স্ত্রীর দাদা (পিতামহ) আবদুল ওয়াদুদ সাহেবের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। অর্থাৎ তিনি ১৯২২ সালে ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও রাজনীতি (Economics & Politics) বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯২৬ সালে মাস্টার্স পাস করে বের হন। পরবর্তীতে তিনি বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিনগুলোর কিছু কথা শুনেছি। কতজন ছাত্র ছিল তখন, কারা শিক্ষক ছিলেন এবং তাদের কোন্ কোন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনা হয়েছিল ইত্যাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অতি সাধারণ প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ অনেকের মতো আমারও ছিল এবং আছে। আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান অপরিসীম। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত ছাত্র আত্মাহুতি দিয়েছেন। প্রাণ দিয়েছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় অনেক শিক্ষক। ১৯৭১-এ বর্বর ঘাতকেরা আমাদের চূড়ান্ত মুক্তির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে দেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত শিক্ষকবৃন্দসহ দেশের বরেণ্য অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। বিদ্যাপীঠের গৌরব দেশের এই কৃতী সন্তানদের প্রতি বিন¤্র শদ্ধা। সেইসঙ্গে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কারণ বিচারক হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কুখ্যাত নায়কদের বিচার কার্যটি আমারই পৌরহিত্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছে। এ বিচারকার্যে আমার সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা বৈষম্যপুষ্ট পাকিস্তানী শাসন আমলে বাঙালী শিল্প, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার যে অদম্য সংগ্রাম ও আন্দোলন করেছেন তা ইতিহাসে চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে। এই আন্দোলন আর সংগ্রামের ফলেই আমাদের স্বাধীনতা। পূর্ব পাকিস্তানে দমননীতি চালিয়ে পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রচর্চা এদেশে নিষিদ্ধ করে দেয় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা এর প্রতিবাদে সোচ্চার হন। প্রতিবাদ করেন তখনকার বাঙালীদের উদীয়মান নেতা শেখ মুজিব ও অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মী। ষাটের দশকের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর দলের প্রতিটি সভার শুরুতেই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গাইতে বলতেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাতেই এ গানটি আজ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থান প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে। কবিগুরু নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। পরম ভালবাসার প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই দুই প্রতিষ্ঠান নিয়েই আমার ভাবনা ও সত্য নিঃসৃত কিছু তথ্য তুলে ধরছি এ লেখায়। কবিগুরু রবীন্দ্রপ্রেম থেকে নিজেকে কখনও দূরে রাখতে পারি না। সম্প্রতি সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছিলাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসরে। এটি নওগাঁ জেলার আত্রাই থানার অন্তর্গত। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর কাচারি বাড়িসহ ভারতের পশ্চিম বাংলা ও মেঘালয়ের শিলং-এ রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত বেশ কিছু স্থান দেখতে গিয়েছি। শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে গিয়েছি একাধিকবার। রবীন্দ্র তীর্থ ভ্রমণ সম্বন্ধে অন্য কোন সময় লেখার ইচ্ছা রইল। আজ একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ উপস্থাপন করছি। আগেই উল্লেখ করেছি যে, আর ক’দিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (এ বছর) তার শতবর্ষ পূর্ণ করতে যাচ্ছে। কবিগুরুর জন্মের একশত ষাট বছর পূর্তির বছর ২০২১। কালের যাত্রায় পথ অতিক্রম করার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে বিশ্বমানের অনেক মানুষকে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন বহু মনীষীর পদচারণার সাক্ষী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের মধ্যে অন্যতম। পতিসর কাচারি বাড়িতে বেশ কিছু ছবির মধ্যে দুটি ছবি, ছবি বলা ঠিক হবে কিনা জানি না, একটি পত্র বা চিঠির ছবি, আরেকটি সনদপত্রের ছবি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি আলোড়িত হয়েছি। পত্রটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট রমেশ চন্দ্র মজুমদার, যিনি আর সি মজুমদার নামে বহুল পরিচিত ছিলেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁর কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি পত্র। পত্রের তারিখ ১৬ মাঘ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১৬ মাঘ সম্ভবত ইংরেজী ১৯২৬ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ অথবা ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ হবে। সনদপত্রটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রদত্ত ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ বা ‘ডি’লিট’ উপাধি প্রদানের সনদপত্র। আমি ইতোপূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনেক ছবি দেখেছি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কবিগুরুকে প্রদত্ত ডি’লিট উপাধি প্রদানের সনদটি কখনও দেখিনি। আর সি মজুমদারকে লেখা চিঠিটিও ইতোপূর্বে আমার দেখার সুযোগ হয়নি। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নিতিশ সেনগুপ্ত তাঁর বই ‘ল্যান্ড অব টু রিভার্স এ হিস্ট্রি অব বেঙ্গল ফ্রম দি মহাভারত টু মুজিব’-এ ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কার বাংলার অবস্থা চিত্রায়িত করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, “Nowhere else in the subcontinent were Muslims as worse off as in Bengal just as, paradoxically, few other communities derived as much benefit from British rule as the Bengalee Hindus’ (পৃষ্ঠা-২৭৮), যার অর্থ দাঁড়ায় উপমহাদেশের অন্য কোথাও মুসলমানদের অবস্থা বাংলার মুসলমানদের মতো এত খারাপ ছিল না। অপরদিকে বাঙালী হিন্দুরা ব্রিটিশ আমলে যত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে এতটা ওখানকার অন্য কোন সম্প্রদায় ভোগ করেনি। এ অবস্থায় ১৯০৫ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তখন এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। এই সিদ্ধান্তের ফলে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটবে বলে তারা প্রত্যাশা করে। ১৯ জুলাই ১৯০৫ চূড়ান্তভাবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত আসে। বছর ছয়েক পরেই কলকাতাভিত্তিক বাঙালী হিন্দুদের অসহযোগ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে এবং ১২ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। বঙ্গভঙ্গ রদ পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ভালভাবে নিতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে তাদেরকে অনেকটা খুশি করার জন্যই ২১ জানুয়ারি ১৯১২ সালে তদানীন্তন ভাইসরয় ও গবর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ একটি মুসলিম প্রতিনিধি দলের কাছে অচিরেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি দেন। তখন পূর্ব বাংলায় হাতেগোনা কিছু কলেজ ও স্কুল ছিল। কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। সারা পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা মিলিয়েই তখন মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেটি হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলমানদের দেয়া লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রতিশ্রæতি কলকাতার একটি প্রভাবশালী মহল ভাল চোখে দেখেননি। এই প্রভাবশালী মহলটিতে ছিল হিন্দু আধিক্য। তারা আনুষ্ঠানিকভাবেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করার জন্য ভাইসরয়ের কাছে আবেদন করেন। এমনকি কলকাতায় এ নিয়ে কিছু সভা-সমাবেশও হয়। কারও কারও মধ্যে একটি ধারণা আছে যে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কলকাতার ঐ প্রভাবশালী মহলের একজন ছিলেন, যিনি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং বইয়ে যা পাওয়া যায় তা থেকেই আমাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। ১৯২১ সাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বছর। সে সময়কার বা তার অব্যাবহিত কিছু আগের কোন মানুষই হয়তবা এখন আর বেঁঁচে নেই। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কুলোদা রায় তাঁর প্রবন্ধ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্রনাথ’-এ উল্লেখ করেছেন যে, বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। পশ্চিম বাংলা এবং বিহার অঞ্চলের কিছু মুসলমানও এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল ভিন্নতর। তাদের মতে এই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের বা তাঁদের সন্তান-সন্তুতিদের কোন কাজে আসবে না। যদি কোন উপকার হয় সেটা পূর্ব বাংলার মানুষেরই হবে। যে মুসলিম জনগোষ্ঠী এরকম চিন্তা করতেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন মওলানা আকরম খাঁ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মৌলবি আবুল কাশেম, মৌলবি লিয়াকত হোসেন প্রমুখ। তদানীন্তন পূর্ব বাংলারও বেশ কিছু মুসলমানের মধ্যে এরকম একটি ধারণা ছিল যে, পূর্ব বাংলায় যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাস করা ছাত্র নেই, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে। তাদের যুক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে ঐ টাকা দিয়ে পূর্ব বাংলায় আরও কিছু স্কুল ও কলেজ স্থাপন করলে এই অঞ্চলের মুসলিম ছেলেমেয়েদের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার সুযোগের পরিধি বাড়বে। তারা আরও ভাবতেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য যে বাজেট সরকার থেকে আসে তা অনেকাংশেই কমে যাবে। তবে নিঃসন্দেহে কলকাতার হিন্দু সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া প্রায় সকলেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল। এটা সত্য যে, তাদের অনগ্রসর অংশটির অনেকেই সঙ্কীর্ণ মানসিকতার কারণে চাইত না যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানরা শিক্ষায়-দীক্ষায়, জ্ঞান, বিজ্ঞানে অগ্রসর হোক, সমৃদ্ধ হোক। কিন্তু প্রধান কারণ তা ছিল না। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার প্রধান কারণ ছিল ভিন্নতর। কলকাতাভিত্তিক হিন্দু শিক্ষিত সমাজ ভেবেছিল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট কমে যাবে। স্যার ড. রাসবিহারি ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার অগ্রসরমান হিন্দু সমাজ তো লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে স্মারকলিপিই প্রদান করেছিল। তাঁকে যারা সমর্থন জুগিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে যে সকল রাজনীতিবিদের নাম শোনা যায় তাঁরা ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, অম্বিকাচরণ মজুমদার, আনন্দ চন্দ্র রায় প্রমুখ। বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তখনকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জী যিনি পরবর্তীতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিও হয়েছিলেন, তিনিও ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছিলেন। বিনিময়ে সরকারকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন প্রফেসরের পদ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। তখনকার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পদ সৃষ্টি করা এত সহজ ছিল না। কলকাতার যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের অনেকের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি নিজেও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সে কারণে অনেকেই মনে করতেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও বিরোধী ছিলেন। জানা যায়, তখনকার কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজসহ একটি ব্যাপক জনগোষ্ঠী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে প্রায় ১০/১২টি প্রতিবাদ সভাও করেছিলেন। এর একটি ছিল কলকাতার গড়ের মাঠের প্রতিবাদ সভা। ঐ সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেছিলেন বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। আমাদের সকলের স্বার্থেই কথাটির সত্যতা যাচাই করা উচিত। গড়ের মাঠের সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৮ মার্চ ১৯১২ সালে। গড়ের মাঠ এখন ময়দান নামে সমধিক পরিচিত। মাঠটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন, তবে জনসাধারণের অবারিত প্রবেশাধিকার রয়েছে। ১৯১২ সালের সেই মাঠের জনসভা বা প্রতিবাদ সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত ছিলেন কিনা বা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন কি না এ সমস্ত তথ্য জানতে হলে আমাদের ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হবে। ইদানীংকালে বিতর্কটি সামনে আনেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) এম এ মতিন। তিনি তাঁর বই ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’তে উল্লেখ করেছেন যে, গড়ের মাঠের সভাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন। এই বইটি প্রকাশের পর সাহিত্য সাময়িকী ‘কালী ও কলম’-এর সম্পাকীয় পরিষদ সদস্য এ.জেড.এম. আবদুল হাই তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে জেনারেল মতিনের দেয়া তথ্যটির বিরোধিতা করে তাঁকে তাঁর দেয়া তথ্যটির সূত্র বা সোর্স জনসমক্ষে প্রকাশের আহ্বান জানান। কিন্তু জেনারেল মতিন আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেননি, উত্তরও দেননি। যে কোন তথ্যই প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তা কোন না কোন ধরনের সাক্ষ্য বা সূত্র দ্বারা সমর্থিত হতে হয়। হয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ। জাতীয় অধ্যাপক বিশিষ্ট নজরুল গবেষক বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের গবেষণাধর্মী বই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর’-এও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এমন কোন তথ্য নেই। বাংলা, বাঙালী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি, সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মোঃ হাবিবুর রহমান। তাঁর কোন বইতেও এরকম কোন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বলে কখনও শুনিনি। আমি তাঁর লেখা যতগুলো বই পড়েছি তাতে এরকম তথ্য আমার চোখে পড়েনি। জানি না এটি আমার দেখার বা পড়ার সীমাবদ্ধতা কিনা। এটি বলতেই পারি, বাঙালী শিক্ষিত সমাজ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এই দুই কবির ব্যাপারে ভীষণ দুর্বল ও অনুভূতিপ্রবণ। এই দু’জনের জীবনচরিত পাঠ থেকে শুরু করে তাঁদের সৃষ্টি ও কীর্তি প্রতি মুহূর্তেই বাঙালীর জীবনকে পথনির্দেশনা দেয়। জীবনকে চিনতে শেখায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও তাঁর জীবনের কঠিনতম মুহূর্তগুলোতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হতেন, হতেন উজ্জীবিত। এটি বঙ্গবন্ধুরই স্বগতোক্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ব্যক্তি জীবনে একজন অসাম্প্রদায়িক মেধাবী ও সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। জীবন চলার পথে উচ্ছৃঙ্খলতা তাঁর জীবনে ঠাঁই পায়নি। প্রতিদিনের কার্যধারা ও উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ও ভাবনা তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। কিছু লেখালেখি করে যদি সেটি মনোপূত না হতো তবে সেটিকে তিনি কাটাকাটি করে একটি ড্রইং-এ পরিণত করতেন। তাঁর ঘরের ময়লা ফেলার বাক্সে বা ঝুড়িতে নাকি খুব কমই পরিত্যক্ত কাগজ পাওয়া যেত। বাংলা ও বিশ্ব বাঙালী সমাজ সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। গবেষণাধর্মী বইগুলো থেকেই উঠে আসে ইতিহাসের অনেক সত্য। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা পিতৃস্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯১২ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখ বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিলেত যাওয়ার তারিখ ঠিক হয়েছিল। যাওয়ার কথা ছিল জাহাজে। কবির শারীরিক অবস্থা এত লম্বা পথ জাহাজে পাড়ি দেয়ার মতো অনুক‚লে ছিল না। তাই বিলেত গমনের পরিকল্পনা সেবারকার মতো বাদ দিতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ছিলেন ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র। তাঁর কাছে প্রেরিত কবির বেশ কিছু পত্রের একটিতে উঠে এসেছে কবির ১৯ মার্চের বিলেত যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিলের বিষয়টি। জমিদার বাড়ির নিয়ম ও রীতি অনুযায়ী তাঁরা স্টেট থেকে যে অর্থ গ্রহণ করতেন বা খরচ করতেন তার হিসাব রাখা হতো পাকাপাকিভাবে। ঠাকুর বাড়ির যে বইয়ে বা খাতায় খরচের হিসাব রাখা হতো সেটিতে ২৪ মার্চ ১৯১২ সালে কবি ও কবি পতœীর কুষ্টিয়ার শিলাইদহে যাওয়ার খরচাদির উল্লেখ রয়েছে। কবি শিলাইদহে এসে ‘পদ্মা’ বোটে করে নদীপথেই বেশি চলতেন। কিন্তু কলকাতা থেকে হয় গোয়ালন্দ ঘাট বা শিলাইদহের নিকটবর্তী অন্য কোন স্থানে এসে তারপর তিনি ‘পদ্মায়’ উঠতেন। কবির চিঠিপত্র থেকে আরও জানা যায় যে, তিনি ২৮ মার্চ ১৯১২ তারিখ শিলাইদহ থেকে তাঁর সন্তানদের গৃহশিক্ষক শ্রী জগনানন্দ রায়কে এক পত্রের মাধ্যমে তাঁর নিজের স্বাস্থ্যের অবস্থা ব্যক্ত করেছেন, যা শিলাইদহের স্থানীয় পোস্ট অফিস থেকেই পোস্ট করা হয়েছিল। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ তারিখটি ১৩১৮ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ ছিল ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র বা ১৫ চৈত্র। ড. মুহম¥দ শহীদুল্লাহ কর্তৃক প্রণীত বাংলা দিনপঞ্জীর সংস্কারের কারণে তারিখটির একদিন হেরফের হয়ে থাকতে পারে। শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরেছিলেন ১২ এপ্রিল ১৯১২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সকল কবিতা, পত্রে বা প্রবন্ধের নিচে স্থান ও তারিখ উল্লেখ করতেন, যা আমরা অনেকেই করি না। শিলাইদহে তিনি ঐ সময় ১৭/১৮টি কবিতা ও গান রচনা করেন। তার মধ্যে গীতিমাল্যের ৪র্থ কবিতা/গান ‘স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি’ লিখেছেন শিলাইদহে, তারিখ ১৫ চৈত্র ১৩১৮, যা ২৮ মার্চ ১৯১২ তারিখের সঙ্গে মিলে যায়। (রবীন্দ্র সমগ্র খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা ১০৭, প্রকাশক পাঠক সমাবেশ)‘...আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ’ ... গানটি রচনা করেন শিলাইদহে, তারিখ ১৪ চৈত্র ১৩১৮, যা ইংরেজী ১৯১২ সালের ২৭ মার্চ হয়। আরও একটি গান ‘এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী’... এটি তিনি শিলাইদহে বসেই লিখেছিলেন ২৬ চৈত্র ১৩১৮ তারিখে, যা ইংরেজী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হয় ৭ বা ৮ এপ্রিল ১৯১২। (সঞ্চয়িতা- অষ্টম মুদ্রণ সংখ্যা, প্রতীক প্রকাশন সংস্থা, বাংলাবাজার পৃষ্ঠা ৩৩১)। ওপরের তথ্যাবলী বিশ্লেষণে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ যেহেতু শিলাইদহে ছিলেন, তাই কলকাতার গড়ের মাঠের সভায় তাঁর উপস্থিত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কবি এসেছিলেন শিলাইদহে একটু বিশ্রাম নিতে। চলবে... [ঢাকা, ১২ জুন ২০২১ খ্রিঃ] লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আপীল বিভাগ
×