ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও বাজেট প্রস্তাবনা

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১১ জুন ২০২১

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও বাজেট প্রস্তাবনা

এবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসের ঠিক দু’দিন আগে জাতীয় সংসদের বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট পেশ করা হয়েছে। প্রতি বছরই ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। আর এবারের বাজেট পেশ করা হয়েছে ৩ জুন। অর্থাৎ পরিবেশ দিবসের ঠিক দু’দিন আগে বাজেট দেয়া হয়েছে। এ বাজেট উপস্থাপনায় বায়ু ও শব্দ দূষণের দুটি কথা এবং দুটি নতুন প্রকল্পের উদ্ধৃতি ছাড়া দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে আর কোন কথাই বলেননি অর্থমন্ত্রী। অথচ পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে অর্থমন্ত্রীর উচিত ছিল দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের কার্যক্রম, পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সরকারের ভবিষ্যত কর্মসূচী এবং পরিবেশ সহায়ক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দেশবাসীকে একটি ধারণা দেয়া। পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে এক পৃষ্ঠার মতো বক্তব্য অর্থমন্ত্রীর ১৯২ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যেই পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুতে সরকারের নীতিসমূহ তুলে ধরা যেত। এটি হয় তো পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা। মৃতপ্রায় ওই মন্ত্রণালয়টি নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রীকে এ বিষয়ে ব্যাকআপ দিতে পারেনি। বর্তমান সময়ে পরিবেশ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে না পারলে যেমন এই পৃথিবী রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে, তেমনি পরিবেশ সম্মত উন্নয়ন না হলে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে না। আর উন্নয়ন টেকসই না হলে যতই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হোক না কেন, বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। অর্জিত হবে না এসডিজির লক্ষ্য। পরিবেশ রক্ষা কেন প্রয়োজন তা গত দেড় বছর ধরে খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করছে পৃথিবী। তাই করোনাকালে প্রকৃতির কদর বেড়ে গেছে অনেকটাই। সারা বিশ্ব আবার আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চাইছে। যে কারণে জাতিসংঘ এবারের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে, ‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার।’ এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে একটি স্লোগানও ছিল, সেটি হলো ‘প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি।’ পৃথিবীকে আগের অবস্থায় অর্থাৎ প্রাক-শিল্পযুগে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য শুধু এই প্রতিপাদ্য নিয়ে এবার বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দিবসই পালিত হয়নি, এর আগে পরিবেশ সংক্রান্ত আরও দুটি দিবস এ বছর পালিত হয়েছে সেগুলোর প্রতিপাদ্যেও এই আকুতি ছিল। এর মধ্যে গত ২২ এপ্রিল পলিত হয় বিশ্ব ধরিত্রী দিবস এবং ২২ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। এই দুটি দিবসের প্রতিপাদ্যেও ছিল মোটামুটি একই ধরনের। অর্থাৎ রিস্টোর আওয়ার আর্থ, রিস্টোর আওয়ার ইকোসিস্টেম। এসব প্রতিপাদ্য দিয়ে হয়ত পৃথিবীকে প্রাক-শিল্পযুগে ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। কিন্তু যতটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া যায়, সেটাই আসলে এসব প্রতিপাদ্যের মূল লক্ষ্য। অর্থাৎ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার মাধ্যমে ধরিত্রীকে টিকিয়ে রাখাই হল এসব দিবসের লক্ষ্য। আর পৃথিবীকে নিরাপদ এবং বাসযোগ্য রাখতে জলবায়ু সঙ্কট এবং পরিবেশ দূষণ রোধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সারা বিশ্বের পরিবেশ সচেতন মানুষ এই দিনগুলোতে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় জোরালো ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে রাখছেন জোরালো বক্তব্য। জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে বাংলাদেশের কণ্ঠকে সুউচ্চে তুলে ধরছেন। নিজেও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন এ বিষয়ে শুধু জনসচেতনতাই নয়, বৈশ্বিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্যও। অথচ আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয়, পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যু বোধহয় আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় নিচের দিকে চলে গেছে। অন্তত এবারের পরিবেশ দিবস পালন দেখে তাই মনে হয়েছে। একজন পরিবেশ সচেতন সাংবাদিক হিসেবে আমার চোখে ঢাকা শহরের কোথাও পরিবেশ দিবসের ব্যানার-ফেস্টুন চোখে পড়েনি। বিকেল বেলা কয়েকটি ঘোড়ার গাড়িকে শহর প্রদক্ষিণ করতে দেখা গেছে। গাড়িগুলোতে যে ব্যানারগুলো লাগানো ছিল, সেগুলোও ছিল প্যাঁচানো। আমার মতো পরিবেশ সচেতন ব্যক্তি না হলে কারও পক্ষে বোঝার উপায় নেই সেগুলো শহর প্রদক্ষিণ করছে আসলে পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। তবে বাংলাদেশে পরিবেশ দিবসের যে মূল কর্মসূচী থাকে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বৃক্ষরোপণ অভিযানের উদ্বোধন সে কাজটি ঠিকমতোই হয়েছে। কারণ সেটির আয়োজন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে সোনালু, জাম, আমড়া ও ডুমুর গাছের চারা চারা রোপণের মাধ্যমে ৫ জুন জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ২০২১ উদ্বোধন করেন। এটি অবশ্য বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের কর্মসূচী। এবারের বৃক্ষরোপণ অভিযান-২০২১ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘মুজিববর্ষে অঙ্গীকার করি, সোনার বাংলা সবুজ করি।’ পরিবেশ মন্ত্রণালয় হয়ত দায়সারা গোছের পরিবেশ দিবস পালনকে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের দোহাই দেবেন। কিন্তু করোনার মধ্যে আরও ভালভাবে দিবসটি উদযাপন করা যেত মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়াই। এ জন্য সুন্দর একটি পরিকল্পনা থাকলেই হতো। কিন্তু যেভাবে পরিবেশ দিবস পালন করা হলো তাতে এই দিবসের মূল যে উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, সেই সচেতনতার ‘স-ও’ সৃষ্টি করা যায়নি। অথচ জনগণের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদফতর ও বন অধিদফতরের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের পাশাপাশি মোবাইল ফোনে পরিবেশ বিষয়ক বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থার কথা। এ ছাড়া রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান, স্থাপনা ও সড়কে ব্যানার, ফেস্টুন স্থাপন করে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব উপলব্ধি করে মানুষকে গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারণা চালানোর কথাও বলা হয়েছিল পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এ জন্য টাকা তো ঠিকই খরচ হয়েছে, কিন্তু এই না পারার ব্যর্থতার দায়িত্ব কিন্তু কেউ নেবে না। এবার ফিরে আসি গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে পাস হওয়া প্রস্তাবিত বাজেটে পরিবেশ প্রসঙ্গে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে সেই আলোচনায়। গত বাজেটে (২০২০-২১ অর্থবছর) পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল এক হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এ বছর সেখান থেকে বরাদ্দ আরও ২৪ কোটি টাকা কমে গেছে। এ বছর অর্থাৎ আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের নতুন বাজেটে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে এক হাজার ২২৩ কোটি টাকা। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে এই বরাদ্দ কোনভাবেই খাপ খায় না। প্রকৃতি ও পরিবেশকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য এই বরদ্দ কোনভাবেই যথেষ্ট নয়। এতে বোঝা যায়, পরিবেশকে সরকার আসলে কতটা গুরুত্ব দেয়। গত প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরেই এই মন্ত্রণালয় গুরুত্বহীন অবস্থায় আছে। ব্যর্থতার কারণে বৈশ্বিক জলবায়ু ইস্যুর সব কাজই এই মন্ত্রণালয়ের হাতছাড়া হয়ে গেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু ইস্যুটি এখন দেখভাল করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজই কমে গেছে। অথচ দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ রক্ষার কাজটিও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ঠিকভাবে করতে পারছে না। কারণ এ বছরের খরচের জন্য মন্ত্রণালয়কে যে এক হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল সেটিও মন্ত্রণালয় খরচ করতে পারেনি। ফলে সম্পূরক বাজেটে বরাদ্দ কাটছাঁট করে কমাতে হয়েছে। সংশোধিত বাজেটেই এক হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৭ কোটি টাকা। আসলে মন্ত্রণালয়ের এই পারদর্শিতার কারণেই নতুন বাজেটে বরাদ্দ কমে গেছে। ফলে সরকারের অবহেলা এবং মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা দেশের পরিবেশের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের পরিবেশের কী অবস্থা তা খুব সহজেই বুঝা যায় জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইন্ডেক্সের (ইপিআই) দিকে তাকালে। ১৮০টি দেশের মধ্যে এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২। অর্থাৎ তালিকায় শেষের দিকে এই অবস্থান আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের পরিবেশ স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য কী দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় পরিবেশের দুটি অনুষঙ্গ বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণ রোধের দুটি উদ্যোগের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বায়ু দূষণ রোধে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণে দেশে বায়ু পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থপন করা হবে। বায়ু মান সূচকের জন্য এই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন দেশের বায়ু দূষণের তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হবে। যা দৈনিক ভিত্তিতে প্রকাশ করা হবে। সম্প্রতি বায়ু দূষণ তীব্র আকার ধারণ করেছে। সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে। এই অবস্থায় বায়ু দূষণ রোধ করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। সেটা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় প্রতিফলিত হয়েছে। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী সচিবালয় এলাকাকে হর্নমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। যদিও এই ঘোষণা খুব একটি কার্যকরী হয়নি। বায়ু দূষণের মতো শব্দ দূষণও চরম আকার ধারণ করেছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর শব্দ দূষণ রোধে একটি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব এই প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন করে বাস্তবায়ন শুরু করা উচিত। অন্যথায় দেশের নতুন প্রজন্ম বধির প্রজন্মে পরিণত হবে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুই উন্নয়ন ও বাণিজ্য ইস্যুকে ছাড়িয়ে শীর্ষে উঠে এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্লাইমেট লিডার্স সামিটই তার বড় উদাহরণ। নতুন প্রজন্মও এই ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় সরকার পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুতে কোন নীতি অনুসরণ করছে তা উল্লেখ থাকলে ভাল হতো। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তা সাড়া ফেলত। বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এতদিন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় পেয়ে এসেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করলে এই ছাড়গুলো আর পাবে না। তখন বাংলাদেশে তৈরি পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে পরিবেশসম্মতভাবে উৎপাদন করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে ক্রেতাদের জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে। তাই এখন থেকেই টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতে দেশে পরিবেশ সহায়ক পণ্য উৎপাদনের কাজ শুরু করতে হবে। কারণ হাতে বেশি সময় নেই। ২০২৬ সালের মধ্যেই দূষণমুক্ত সবুজ জীববৈচিত্র্যময় পরিবেশ নিশ্চিতে গ্রহণ করতে হবে পদক্ষেপ। পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে যুগ যুগ ধরে। এবারও পরিবেশ দিবস পালন ব্যতিক্রম ছিল গত বছরের (২০২০) মতো। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এবছরও দিবসের সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন ছিল ভার্চূয়াল ভিত্তিক। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে একটি করে ‘ডুমুর’ ও ‘সোনালু’ গাছের চারা রোপণ করেন। এ সময় তিনি করোনাভাইরাসের এই মহামারীর মধ্যে সবুজ পৃথিবী গড়ার ওপর জোর দিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের সবুজ বাংলাকে আরও সবুজ করতে হবে। কাজেই আসুন আমরা সবাই মিলে ব্যাপকভাবে এই দেশে বৃক্ষরোপণ করি এবং আমাদের সোনার বাংলাকে আরও সোনার সবুজ বাংলা করি। অনুষ্ঠানে তিনি সবাইকে অন্তত একটি করে ফলদ, বনজ এবং ভেষজ গাছ লাগানোর পাশাপাশি গাছের যত্ন নেয়ারও আহ্বান জানান। বিশ্ব পরিবেশ দিবস জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি বিশ্বজনীন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে প্রতি বছর ১৪৩টিরও বেশি দেশ অংশ নেয়। ১৯৭৪ সালে প্রথম এই দিবসটি পালিত হয়। তবে তার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল সুইডেনের। ১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর ১৯৭২ সালের ৫-১৬ জুন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর পরের বছর আমেরিকায় ১৯৭৪ সালে ‘অনলি ওয়ান আর্থ’ বা ‘একমাত্র পৃথিবী’ এই থিম নিয়ে প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও ১৯৭৪ সাল থেকেই পরিবেশ দিবস ধরাবাহিকভাবে পালিত হয়ে আসছে। তবে ১৯৮৭ সালে বিভিন্ন আয়োজক দেশ নির্বাচনের মাধ্যমে এই ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্র ঘোরানোর ধারণাটি শুরু হয়। বিশ্বের বুকে প্রকৃতির অবদান বোঝাতেই এই দিন পালন করা হয়। ইউনাইটেড নেশনস বা রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে প্রকৃতির অবদান সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে শুরু হয় এই উদযাপন। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পরিবেশবিদ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সচেতন করার চেষ্টা চালানো হয় এই নির্দিষ্ট দিনে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে গোটা বিশ্ব এখন এক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তবে তা প্রকৃতির ওপর ভাল প্রভাব ফেলেছে। লকডাউনের ফলে পানি ও বাতাসের দূষণ কমেছে। গাছপালাও সেজে উঠছে রঙিন ফলে ফুলে। গবেষকরা বলছেন, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বিগত দুই বছরে লকডাউনের মধ্যে বেশি গাড়ি চালাননি। ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে। বায়ু দূষণের মাত্রা খানিকটা হলেও কমেছে। তবে মাস্ক, গ্লাভসসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিক স্থানে না ফেলার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এসব কারণেই এবারের পরিবেশ দিবসের থিম দেয়া হয়েছে, ‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’। বর্তমান অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে অতীতকে ফেরানো সম্ভব নয় ঠিকই। তবে আমরা গাছ লাগাতে পারি, আমাদের আশপাশের শহরকে আরও সবুজ রাখতে পারি। তাই নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরির জন্য পরিবেশের সচেতনতার বিষয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠা উচিত। এ পৃথিবীকে বাস-উপযোগী রাখতে সকলেরই যথাযথ ভূমিকা রাখা উচিত। এমনিতেই করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ২০২০ সাল থেকে অনেকেই হারিয়েছেন প্রিয়জনদের। ফলে পৃথিবী যে অনিরাপদ এবং বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে, তা স্পষ্টত লক্ষণীয়। এমন প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। শুধু একটি দিবসেই নয়, সারা বছরই হোক আমাদের পরিবেশ দিবস। করোনা থেকে মুক্তি পেতে সচেতন হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আসুন হাত ধৌত করি, হাঁচি-কাশি হওয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করি, বাইরে যাওয়ার আগে মাস্ক ব্যবহার করি। আসুন একটি বসবাসযোগ্য নিরাপদ পৃথিবী গড়তে নিজে সচেতন হই, অন্যকে সচেতন করি। ৯.০৬.২০২১ লেখক : সাংবাদিক
×