ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

ইতিহাসের বিস্ময় মুজিবনগর সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ১৮ এপ্রিল ২০২১

ইতিহাসের বিস্ময় মুজিবনগর সরকার

২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতিকে মুক্ত করার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিরোধ গড়ে ওঠে সর্বত্র। পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিবেশী ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয়, অবাধ রাজনৈতিক কার্যপরিচালনার সুযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমএলএদের কুষ্টিয়া জেলার ভারত সীমান্তে বৈদ্যনাথতলায় অধিবেশনে একত্র হন। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।’ ওই ঘোষণায় আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রীরূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়। ১৭ এপ্রিল। দিনটি ছিল শনিবার। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের অখ্যাত ভবেরপাড়া গ্রামে বৈদ্যনাথতলা। সাদামাটা পরিবেশে একটি আমবাগানে শপথ নেয় ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার। আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। প্রায় ১০ হাজার মানুষের বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে সকাল ১১টায় আওয়ামী লীগ চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলীর স্বাধীনতা সনদ পাঠের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ গঠিত হয়। এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাঠের মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তা সাংগঠনিক রূপ নেয়। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশনায় সকালে দমদম বিমানবন্দরে গোপনে সজ্জিত হয় ভারতীয় যুদ্ধবিমান বহর। মেহেরপুর সীমান্তে ভারতীয় ভূখ-ে অবস্থান করছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনী। মেহেরপুরে আ¤্রকাননের দূর-দূরান্তে ঘাস-পাতা বিছানো জালের ছাউনিতে ভারতীয় বাহিনীর এ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান মেহেরপুরের আকাশ নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দেয়। সকাল ৯টা থেকেই সেখানে নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমন শুরু হয়। আনন্দ-আবেগে উদ্বেলিত শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে আ¤্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল। চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছিল শপথমঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ছয়খানা চেয়ার। আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি, চেয়ার ও বাঁশ আনা হয়। ওপরে শামিয়ানাও লাগানো সম্ভব হয়নি। ফলে খোলা আকাশেই মঞ্চ তৈরি করে শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। শপথ অনুষ্ঠানে দেশী-বিদেশী ১২৭ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নবগঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং সশ¯্র বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী, মনসুর আলী অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, যোগাযোগ ও ত্রাণমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম রচিত, অধ্যাপক ইউসুফ আলী পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের মূল সাংবিধানিক ভিত্তি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আইনগত বৈধতা প্রদান করে স্বাধীনতা সংগ্রামের। বাংলাদেশের সংবিধানেও সংযোজিত রয়েছে এই ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে দেশী-বিদেশী সাংবাদিক, বিদেশী পর্যবেক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জয় চাই।’ শপথ গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার প্রদত্ত ভাষণে বলেন- ‘বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে কিভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তাঁরা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা-আকাক্সক্ষাকে সত্যিকারভাবে উপলদ্ধি করতে পারবেন।’ বাংলাদেশের বুকে ইয়াহিয়া খানের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোনমতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লঙ্ঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারী পশুর মতো। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এসব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে, ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো তাহলে তারা একই দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারত না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচার গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানে বিয়োগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালীর রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পোড়া মাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়।’ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আরও বলেন, ‘হিটলারের পর গণহত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উটপাখির নীতি অনুসরণ করেছিল। তারা যদি মনে করে থাকে যে, এতদ্বারা তারা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছে তা’হলে তারা ভুল করেছে। কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মোহমুক্ত। তাদের বোঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালন-পালন করছে। দুনিয়ার কোন জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট-বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।’ তিনি সুস্পষ্ট করে আরও বলেন, ‘সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা’ আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাব। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করে তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।’ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এভাবেই দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সূচনা হয়। বৈদ্যনাথতলাকে তিনি তাদের কাছে তুলে ধরেন মুজিবনগর নামে। সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশ সরকার কি এই মুজিবনগর থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করবে?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সরকার শুধু এক জায়গাতেই থাকবে না। যেখানে থাকবে সেটাই হবে মুজিবনগর।’ দুপুর থেকে আকাশবাণী, বিবিসিসহ বিশ্বের গণমাধ্যমসমূহে যখন প্রচারিত হয়ে গেল যে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আমবাগানে স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হয়েছে ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে তখন পাক হানাদাররা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এলো মেহেরপুরের দিকে। হানাদার বাহিনী মেহেরপুর মহকুমা এলাকা দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকবার তারা ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণে মুজিবনগর প্রশাসন সুবিধামতো মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতের কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে মুজিবনগর সরকার। মুজিবনগর সরকারের জন্ম হয়েছে ব্যতিক্রমী পথে। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসন গড়ে উঠবে সাংবিধানিক বাতাবরণে। কিন্তু তখন দেশে সংবিধানের কোন কথাই নেই, কোন ধারাবাহিকতাও নেই। দেশজুড়ে এখানে-ওখানে যত স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠছিল সেসব একটা দাবানলে রূপান্তরের দায়িত্ব গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার। এ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক প্রশাসন দাঁড়িয়ে যেতে শুরু করে। যদিও তাদের অধিকাংশকেই কাজ করতে হতো ভারতে থেকে। প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে তুলতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগেছে। আগরতলায় ‘ইস্টার্ন রিজিয়ন’ নামে এই অঞ্চলের এমএনএ ও এমএলএদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কাজ করছিলেন। আবার পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগরতলায় যেসব কর্মকর্তা গিয়েছিলেন তারা কাজ করছিলেন মুজিবনগরে। ধীরে ধীরে এসবের মধ্যে সমন্বয় ঘটে। এই সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিচ্ছিন্ন প্রশাসনিক উদ্যোগ একটি জাতীয় প্রশাসনের রূপ পরিগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অসামান্য। এ সরকারের সবচেয়ে মূল্যবান ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়জুড়ে আশার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত রাখা। এ সরকারই দেশের আপামর মানুষের মনে এই বিশ্বাস জুগিয়েছে যে, দেশে মুক্তির যে লড়াই চলছে তার শেষে নতুন সূর্য উঠবে। মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্মকা-, কূটনৈতিক প্রচার, বিশ্ব জনমত গঠন এবং এক কোটি উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে। তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে দেশের অভ্যন্তর থেকে লাখ লাখ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানীদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখাসহ বিভিন্ন অবিস্মরণীয় কীর্তি সম্পন্ন করে, যা সমকালীন ইতিহাসের বিস্ময়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×