ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাস্টিন গোমেজ

নবযাত্রায় কল্যাণের পথে

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১৪ এপ্রিল ২০২১

নবযাত্রায় কল্যাণের পথে

আমাদের বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের পলিমাটিতে ব্যাপক ফসল ফলার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা এসে এ এলাকায় তাদের বসতি স্থাপন করেছেন। মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্যের সংস্থান করতে গিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এ পলিভূমিতে এসে বসতি স্থাপন করার কারণে এটি প্রাচীনকাল থেকেই একটি জনবহুল দেশ। নানা দেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে এখানে যারাই এসেছেন, এখানকার উদার মন বাসিন্দারা তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং আপন করে নিয়েছে। এভাবে গোড়া থেকেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে বহুত্ববাদের ধারায় গড়ে উঠেছে এ দেশ। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধও প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ সব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের মূল শিক্ষা হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্মতা। আহ্বান করে শিকড়ে ফিরে যেতে যে শিকড়ে প্রোথিত রয়েছে আমাদের অস্তিত্ব। যেখানে রয়েছে মানুষ হিসেবে মানুষের সার্বিক কল্যাণের অকৃত্রিম আহ্বান। তেমনি পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙালীদের সংস্কৃতির একটি অংশ। পহেলা বৈশাখ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে। আমাদের বাংলার নববর্ষ হলো কল্যাণ ও নবযাত্রার প্রতীক। অতীতের সকল গ্লানি ভুলে গিয়ে আমরা সুখ ও আনন্দময় জীবনের প্রত্যাশায় উদ্যাপন করি বাংলা নববর্ষকে। আর এই পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। ইতিহাস বলে, পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে। সম্রাট আকবরই প্রথম বাংলা সন প্রবর্তন করেন। শুরুতে পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা কৃষক, জমিদার ও ভূস্বামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য এ উপলক্ষে মেলা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হতো। ধীরে ধীরে তা ব্যাপকতা পায়। নানা উৎসব-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে সার্বজনীন, শুভবোধ আর কল্যাণ চেতনার প্রতীক। সত্যিকার অর্থে বাংলা নববর্ষ একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। প্রথম দিকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি উপাদান হিসেবে বাংলা নববর্ষ পালিত হলেও পরে রাজনৈতিক আন্দোলন দিনটিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও বাঙালী সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ শুরু হলে ছায়ানট পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে রবীন্দ্র সঙ্গীতের আয়োজন করে। সেই থেকে বাঙালীর আত্মপরিচয় ও আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষের যাত্রা শুরু। শুরু হয় তাদের জীবনের এক নবযাত্রা। যে যাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে শিক্ষা দেয় মানুষ হিসেবে মানুষের সার্বিক কল্যাণের। বাংলা নববর্ষে বাঙালীর ঘরে ঘরে এদিন উৎসবের ছোঁয়া লাগে। পরস্পরের মঙ্গল কামনা এ দিনের সামাজিকতার অঙ্গ। তাই তো সকলে একসুরে গায় : ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, /যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ বাঙালীর নববর্ষ মানে, বাঙালীর জীবনে এক নতুন দিন, নতুন বারতা। সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় বাংলার নতুন বছর। বাংলার ঘরে ঘরে থাকে উৎসবের আমেজ। সাধারণত, বাংলা নববর্ষের সূচনা হতো হালখাতা উন্মোচনের মাধ্যমে। গ্রাম-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় নববর্ষের শুরুতে পুরনো হিসাব-নিকাশের সমাপ্তি টেনে নতুন হিসাব-নিকাশের খাতা খুলতেন এবং এটাই হালখাতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে কৃষিপ্রধান এই দেশের সাধারণ মানুষদের কাছে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময় বাঙালীরা নিজেদের বেশি করে আবিষ্কার করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে। দেশের প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সঙ্গীত এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে। এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা আত্মার মিলন সৃজিত হয়। বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িকতার দেশ, তার স্ফুরণ ঘটে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে। এখান থেকেই বাঙালী বরাবরই তার নবযাত্রার প্রেরণা পেয়ে থাকে। বাংলা নববর্ষে সকল, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সত্তা এবং গোত্রের সব মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের সর্বমানুষের সার্বজনীন উৎসব। ওই একটি দিনে ধনী-নির্ধনের বৈষম্য ঘুচে যায় এবং সবার মুখে হাসি ফোটে। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তার ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করছেন এই বলে যে : ‘ভেঙ্গে আবার গড়তে জানে সে চিরসুন্দর!/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’/পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন ইসলামের নির্দেশ। হাজার বছর ধরে এ দেশের হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করে এই সহিষ্ণুতার বিরল নজির স্থাপন করেছে। চৈত্রসংক্রান্তি কিংবা দুর্গাপূজার মেলায় অনেক বাঙালী মুসলিম তরুণরা অংশ নিয়ে থাকে। একইভাবে মুসলমানদের ঈদের মাঠের রাস্তায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মিষ্টির দোকান দিয়ে থাকে, চকবাজার থেকে ইফতারির স্বাদ তারাও গ্রহণ করে থাকে। আর খ্রীস্টানদের বড়দিন উৎসবে হিন্দু ও মুসলমানদের একসঙ্গে অংশগ্রহণেরও উদাহরণ আছে। আমরা চাই বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ধারা বজায় রেখেই একসঙ্গে জাতীয় উৎসবগুলো উদ্যাপন করে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরুক। আজ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে পদার্পণ করেছি। বাংলাদেশের প্রধান চালিকাশক্তির উৎস হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সেজন্যই আমরা আশাবাদী যে, আমরা চলমান সঙ্কটকে অতিক্রম করে এবারের বাংলা নববর্ষকে মুক্তকণ্ঠে ও অবারিত চিত্তে আহ্বান জানাতে পারব। নতুন প্রজন্মের কাছে জাতীয় সংস্কৃতির প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরে তাদের সামনে অপসংস্কৃৃতির মুখোশ উন্মোচন করতে হবে, পাশাপাশি সুস্থ ও দেশীয় সাংস্কৃতিক কর্মসূচীতে তাদের জড়িত করতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মীদের, সংগঠকদের খুঁজে বের করতে হবে সেই জাতীয় সংস্কৃতির পথ ও পদ্ধতিতে। নববর্ষ কীভাবে পালন করলে আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষা পায়, আবার তরুণরা তাদের আনন্দ থেকেও বঞ্চিত না হয় সে রাস্তা তাদের সামনে বের করে দেয়ার দায়িত্ব সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠকদের। সে কর্মসূচী এমন হতে হবে যা তরুণদের কাছে জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য হবে। বর্তমানে দেখা যায় একশ্রেণীর ভিন্ন মতবাদীদের প্ররোচনায় আমাদের তরুণ সমাজ নববর্ষের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। নববর্ষকে তাদের কাছে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যার ফলে তরুণরাও এসব মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। আমাদের এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, তারুণ্যই উৎসব, উৎসব তরুণদের জন্য, তরুণরাই উৎসবের প্রাণ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর বৈসাবি উদ্যাপনকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এ তিনটি সম্প্রদায়ই পহেলা বৈশাখকে তাদের নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপন করে। চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’, ত্রিপুরারা ‘বৈসু’ নামে একই সঙ্গে এ উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। একই সঙ্গে পালনের সুবিধার্থে তারা তিনটি উৎসবের নামের প্রথম বর্ণ নিয়ে ‘বৈসাবি’ উৎসব নামে এক সঙ্গে পালন করে। একই সময়ে সেখানে বসবাসরত বাঙালীরা নববর্ষ পালন করে থাকে। একই লাইনে দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রায় শামিল হয়। তবে একই সঙ্গে পালন করলেও উদ্যাপন রীতি ও আচারে তারা নিজ নিজ সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে থাকে। লেখক : সাংবাদিক
×