ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ অপূর্ব চৌধুরী

জ্বর ঠোসা কি জ্বরের কারণে হয়

প্রকাশিত: ০১:২৯, ৯ মার্চ ২০২১

জ্বর ঠোসা কি জ্বরের কারণে হয়

ইংরেজীতে সাধারণরা বলে ঈড়ষফ ঝড়ৎব । বাংলা করলে দাঁড়ায় ঠাণ্ডার ঘা। কারণ দেখা গেছে- ঠাণ্ডা লাগলে অথবা জ্বর এলে ঠোঁটের ওপরে অথবা নিচে কিংবা নাকে, অথবা নাকের আশপাশে, এমনকি থুঁতনি পর্যন্ত কিছু ব্লিস্টার বা জলভরা গুটি গুটি দানা উঠে। এদেরকেই কোল্ড শোর বলে। একটু সহজ করে বললে লোকে এটাকে বলে ফিভার ব্লিস্টার। বাংলায় কোল্ড শোর’কে ঠাণ্ডার ঘা না বলে এই ফিভার ব্লিস্টার থেকে নেয়া হয়েছে জ্বর ঠোসা। ব্লিস্টার মানে ঠোসা। লোকে তাই একে জ্বর ঠোসা বলে। আঞ্চলিক ভাষায় কোন কোন অঞ্চলে জ্বর ঠোয়াও বলে। বাংলা এবং ইংরেজী নাম থেকে কিছু না বুঝলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটির একটি নাম আছে । একে বলা হয় ঐবৎঢ়বং খধনরধষরং । খধনরধষ মানে ঠোঁট। তার মানে ঠোঁটের হারপিস। হারপিস এক ধরনের ভাইরাস। মানুষের শরীরকে আক্রান্ত করতে পারে দু’ধরনের হারপিস। একটি মুখে, আরেকটি যৌন অঙ্গে। পুরুষ এবং মহিলার কোন ভেদাভেদ নেই। বয়সেরও কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। মুখের হারপিসকে বলে ওরাল হারপিস। যৌন অঙ্গে হারপিস হলে তাকে বলে জেনিটাল হারপিস। হারপিস ভাইরাসটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে হারপিস সিম্প্লেক্স ভাইরাস । সংক্ষেপে ঐঝঠ এইচএসভি। হারপিস সিম্প্লেক্স ভাইরাস দুই ধরনের। একটি বলে হারপিস সিম্প্লেক্স ভাইরাস ১, একটি হারপিস সিম্প্লেক্স ভাইরাস ২ । ঐঝঠ-১ এবং ঐঝঠ-২ । ওরাল হারপিস হয় এইচএসভি ওয়ান এর কারণে। জেনিটাল হারপিস হয় এইচএসভি টু এর কারণে। এই ওরাল হারপিসটিকেই বলে কোল্ড শোর বা জ্বর ঠোসা। পৃথিবীতে সত্তর ভাগের বেশি লোকের শরীরে এই ভাইরাসটি আছে এবং থাকে। একবার শরীরে এই ভাইরাসটি ঢুকলে আর কখনো যায় না। সারা জীবন শরীরে থাকে। বিশেষ করে শরীরের চামড়ার উপরিভাগে যে স্নায়ুগুলো আছে তার মধ্যে এই ভাইরাস বেশিরভাগ সময় বসে থাকে। এমন জ্বরের ঠোসা ওঠা মানে ভাইরাসগুলো এ্যাক্টিভ। আবার জ্বর-ঠোসা চলে যাওয়া মানে ভাইরাসগুলো ইন্যাক্টিভ কিন্তু শরীরে আছে। ঠোঁটে বেশি উঠে, দুই কারণে। প্রথমত মুখ দিয়েই ভাইরাসগুলো শরীরে ঢুকে। তারপর মুখের আসে পাশে বসে থাকে। দ্বিতীয়ত: ঠোঁটের চামড়া খুব পাতলা। ভাইরাসগুলো বেশিভাগ সময় চামড়ার কাছাকাছি নার্ভগুলোতে থাকে। পাতলা চামড়া ভেদ করে সহজে ফুসকুড়ি হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে বলে ঠোঁটের আশপাশে বেশি ওঠে। বেশকিছু কারণে এটি একটিভ হয়। অন্যতম একটি কারণ হলো শরীরের ইমিউনিটি যখন দুর্বল হয়ে ওঠে। আর শরীরের ইমিউনিটি তখনই দুর্বল হয়ে যায়- যখন শরীরে কোন একটি ইনফেকশন দেখা দেয় এবং তার কারণে জ্বর হয়। এর আগ পর্যন্ত ইমিউনিটি শরীরকে প্রতিরোধ করে বলে ভাইরাসগুলো শরীরের ভেতরে থাকলেও একটিভ থাকতে পারে না। শরীরের টি সেল তাদের সবসময় প্রহরায় রেখে দুর্বল রাখে । ইমিউনিটি দুর্বলতার সুযোগে বেরিয়ে আসে। অনেক বেশি স্ট্রেস থাকলে, ডিপ্রেসড থাকলে, কোন টেনশনে থাকলে, তখন ভাইরাসটি একটিভ হয় এবং এমন জ্বর-ঠোসা আকারে ঠোঁটে দেখা দেয় । অনেক মেয়েদের পিরিয়ডের সময় এমনটি দেখা দেয় শরীরে হরমোন চেঞ্জ এর কারণে। ইমিউনিটি কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। খুব বেশি রোদে থাকলে, গরমে, খুব বেশি ঠান্ডায় ভাইরাসগুলো একটিভ হয়ে ওঠে। যাদের এ্যাকজিমা থাকে তাদের বারবার হয় এবং ব্লিস্টারগুলো বেশ বড় হয়। এটি হওয়ার আগে শরীরে প্রথম ক’দিন জ্বর জ্বর ভাব থাকে, গায়ে ব্যথা করে, ক্লান্ত লাগে, ঘুমের ডিস্টার্ব হয়। তারপর দিনভর ঠোঁট শুকিয়ে যায়, হালকা চুলকায়, কখনও জ্বালাপোড়া করে, কখনও আবার সু এর মতো ফোটায়। এক থেকে দুই দিনের মধ্যে ব্লিস্টার আকারে ভাইরাসগুলো ফুসকুড়ি র জন্ম দেয়। সঙ্গে গলাব্যথা, খাবার গিলতে ব্যথা, মাথা ধরা, পেটে অস্বস্তি এগুলাও দেখা দিতে পারে। এটি ছোটবেলাতেই কোন না কোনভাবে আমাদের শরীরে ঢুকে। একবার ঢুকলে কখনও ছেড়ে যায় না অথবা কোন মেডিসিন দিয়েও তাকে তাড়ানো যায় না। এটি একজন থেকে আরেকজনের দেহে সহজে ছড়ায়। বিশেষ করে আক্রান্ত যিনি হয়েছেন, সেই ঠোঁটের স্পর্শে গ্লাস, চামচ, তোয়ালে এ সমস্ত নিত্য জিনিসের মধ্য দিয়ে অন্যদের মধ্যে ছড়ায়। এটি জীবন-ঘাতী মারাত্মক কোন সমস্যা নয়। সাময়িক তিন থেকে সাত দিন অথবা তারও বেশি থাকতে পারে এবং নিজে চলে যায় । তবে যে ঘা ঠোঁটে থাকে, সেটি শুকাতে দেরি হয়, কখনও কখনও সেটি আবার ইনফেকশন হতে পারে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের শুকোতে দেরি হয় যদি ডায়াবেটিস কন্ট্রোল না থাকে। যেহেতু ভাইরাসটিকে কোন মেডিসিন দিয়ে মারা যায় না অথবা শরীর থেকে দূর করা যায় না, কিন্তু যখন ঠোঁটে একটিভ হয়ে প্রকাশ পায়, তখন কিছু এন্টিভাইরাল মেডিসিন সেই অংশে লাগিয়ে দিলে তাড়াতাড়ি ঘা টুকু শুকিয়ে যায় । অপুপষড়ারৎ নামক এ্যান্টি-ভাইরাস ক্রিমটি ব্লিস্টার দেখা দেবার শুরুর দিন থেকেই দিনে তিন থেকে চার বার লাগালে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই এটি চলে যায়, অথবা কমে যায় । যাদের এটি খুব বেশি হয়, কোনভাবে ইমিউনো কম্প্রোমাইজ, ক্যান্সারের থেরাপি নিচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটির মুখে ট্যাবলেট খেতে হয় । কোন কোন ক্ষেত্রে ট্যাবলেট এর বদলে ইনজেকশন দেয়া হয় পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে। তবে হাতের কাছে কোন ওষুধ না থাকলে ঘরের কিছু চিকিৎসাতেও দ্রুত এটি থেকে সেরে ওঠা যায়। এটি হলে ব্যথানাশক ওষুধ খেতে পারেন দুই থেকে তিন দিন। যেমন আইবুপ্রোফেন অথবা প্যারাসিটামল। চুলকালে অথবা জ্বালাপোড়া করলে কিংবা ব্যথা করলে বরফের কুচি লাগিয়ে ঘষতে পারেন। বাহিরে গেলে ঠোঁটে লিপ-বাম, বিশেষ করে এলোভেরা জেল, কিংবা সানক্রিম লাগাবেন। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ঠোঁটে হয়, তারপরেও কখনও কখনও এটি মারাত্মক হয়ে শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমনÑ এটি চোখে সংক্রমিত হতে পারে, তখন তাকে বলে ঐঝঠ শবৎধঃরঃরং । যাদের এ্যাকজিমা আছে, তাদের ক্ষেত্রে কখনো আঙ্গুল কিংবা শরীরের কোন অংশে বড় আকারে দেখা দিতে পারে । তখন তাঁদের বলে বপুবসধ যবৎঢ়বঃরপঁস । নিয়মিত ঘুম, স্ট্রেস বা উদ্বিগ্নতা কমিয়ে আনা, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে পুষ্টিকর খাবার, রোদে বের হলে ঠোঁটে প্রয়োজনীয় ক্রিম ব্যবহার, পর্যাপ্ত পানি পান, এমন সব নিয়ম মেনে চললে ভাইরাসটি শরীরে থাকলেও এ্যাক্টিভ হওয়ার সযোগ পাবে না। লেখক : এবং চিকিৎসক, ইংল্যান্ড [email protected]
×