ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. শাহজাহান মন্ডল

মুজিববর্ষে সকল নথি ও সফ্টওয়্যারে জাতীয়তা ‘বাঙালী’ লেখা হোক

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ২৬ জানুয়ারি ২০২১

মুজিববর্ষে সকল নথি ও সফ্টওয়্যারে জাতীয়তা ‘বাঙালী’ লেখা হোক

এখন মুজিববর্ষ। ২০২০-’২১। স্বাধীনতার অর্ধশতক আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। ৯ বছর হয়ে গেল সংবিধানের ৬ (২) অনুচ্ছেদে সেই ২০১১ সালে যথার্থভাবে লেখা হয়েছে আমাদের জাতীয়তা ‘বাঙালী’। অথচ এখনও বিসিএস, বিজেএস ও অন্যান্য চাকরির কাগজে/অনলাইন ফরমে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কাগজে/অনলাইন ফরমে তা লিখতে দেয়া হচ্ছে না। এখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদার্পণের সময় নিজের অসত্য জাতীয় পরিচয় দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। আজীবন ছাত্র-ছাত্রীরা এবং তাদের মাধ্যমে পরিবারের অন্যরা ওই ভুল ও অসত্য পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠছেন। জজ-ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্য ক্যাডার/নন-ক্যাডার অফিসাররা নিজেদের অসত্য জাতীয় পরিচয় দিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করছেন। আমরা কি তবে আমাদের নিজকে চেনার সুযোগ পাব না? সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’ ‘শহড়ি ঃযুংবষভ’ উপদেশ কি বাঙালীর জন্য নয়? আমরা কি তবে শেকড়বিহীন জনমই পার করব? ভাবতে অবাক লাগে, বাঙালীর বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সরকারী নথিতে এখনও লিখতে দেয়া হয় না জাতীয়তা ‘বাঙালী’। ফলে সিংহ শাবক ভেড়ার পালে ঢুকে পড়লে যেমন নিজেকে মেষ শাবক ভাবে, নিজের শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, অকেজো হয়ে জীবন কাটায় তেমনি ‘বাঙালী’ জাতির লোকেরাও যেন শক্তিহীন, অজ্ঞ ও অকেজো। কারণ তাদের জাতীয় পরিচয় বিষয়ে এখনও তারা অন্ধকারে। কিন্তু প্রশ্ন- এ আঁধার কাটবে কি কোনদিন? ‘বাঙালী’ জাতির সন্তানরা যখন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একাত্তরে প্রাণ দিল, সম্ভ্রম দিল, এক সাগর রক্ত দিল তারপর এত বছর সময় কেটে গেল, তারপরও সরকারী চাকরি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফরমে এই ভুল কথা! ছাত্রদের কাছে নালিশ শুনেছি, ‘বাঙালী’ লিখলে নাকি অনলাইনের আবেদনপত্র ফেরত চলে আসে, এক্সেপ্টেড হয় না। আবেদনের সফ্টওয়্যার ফরমে ওভাবেই সেট-আপ দেয়া আছে। ওদেরইবা কত হতাশার কথা শুনব, যে কোন চাকরির সফ্টওয়্যার ফরমে একইভাবে সেট-আপ দেয়া। পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও একই ভুল ও সংবিধান পরিপন্থী কথা! অর্থাৎ দেশের বাইরে গোটা পৃথিবীতে যাচ্ছে ওই ভুল তথ্য। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাহলে দোষ দেয়া যায় কিভাবে? তাহলে কি লাভ হলো একাত্তরের যুদ্ধ করে, যুদ্ধাপরাধের বিচার করে? কি লাভ হলো পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করে আর অবাঙালী রাজনৈতিক শক্তিকে হঠাতে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ম্যান্ডেট দিয়ে? আমাদের জাতীয় পরিচয়ই যদি ঠিক করা না হয় তো দুঃখের কথা কোথায় বলি? কি লাভ আছে এই ভুল-অসত্য-বেআইনী ও অসাংবিধানিক তথ্য বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে? ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী আনে। এই সংশোধনী চেষ্টা করে সংবিধানকে ১৯৭২-এর চেতনায় ফিরিয়ে নিতে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের জাতীয়তা ‘বাঙালী’ লেখা ছিল। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘বাঙালী’ জাতীয়তাকে সংবিধান থেকে মুছে পাঠিয়ে দেন হিমাগারে। যদিও তদস্থলে সংবিধানে অন্য কিছু লেখার সাহস পাননি। বত্রিশ বছর পর বাঙালী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবনের লালিত আদর্শ ‘বাঙালী’ জাতীয়তাবাদকে আবারও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠা দেয়া হয় ২০১১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। দায়টা যেন ওই বাপ-বেটিরই, আর কারও নেই! কারণ, দেখা যাচ্ছে সংবিধান সংশোধন করলেও কাজ হচ্ছে না। প্রত্যেক রাষ্ট্রের সংবিধান হলো ওই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশের সংবিধানও তাই। বর্তমানে সংবিধানের ৬ (২) অনুচ্ছেদে এদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে ‘বাঙালী’ বলে পরিচিত করানো হয়েছে এবং নাগরিক হিসেবে ‘বাংলাদেশী’ বলে পরিচিত করানো হয়েছে। বিষয়টিকে ‘জাতীয়তা’ ও ‘নাগরিকত্ব’ এ দুভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। (১) জাতীয়তা হতে পারে ব্যুৎপত্তিগত, ভাষাগত, ধর্মগত ইত্যাদি। বাংলাদেশের একজন মুসলমান ও একজন হিন্দু নিজ নিজ ধর্মীয় জাতির অন্তর্ভুক্ত, তাদের ধর্মীয় জাতীয়তা হলো যথাক্রমে ‘মুসলমান’ ও ‘হিন্দু’; কিন্তু এজন্য মুসলমানকে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের বা হিন্দুকে কোন হিন্দু রাষ্ট্রের নাগরিক হতে হয়নি। ‘বাংলাদেশ’ নামক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়াই তাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের আগে ছিল না, কিন্তু ‘বাঙালী’ নামক জাতি ছিল। এ জাতি পাকিস্তান আমলে ছিল, ব্রিটিশ আমলে ছিল, তার পূর্বেও ছিল। ঠিক যেটুকু ভূখণ্ড নিয়ে আজকের বাংলাদেশ সেটুকু নিয়ে পৃথিবীর শেষলগ্ন পর্যন্ত এ রাষ্ট্র টিকে থাকবেই তার নিশ্চয়তা কি? কিন্তু ‘বাঙালী’ জাতির অস্তিত্ব সে তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী হতেই পারে। শিল্প-সভ্যতার এই যুগে কার্বন নিঃসরণের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রম উচ্চতা বৃদ্ধির দরুন এ রাষ্ট্রের ভূখণ্ড যদি কখনও বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যায়, যা আমরা কখনই কামনা করি না, তাহলে হয়ত ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের ভূখণ্ড থাকবে না, কিন্তু এদেশের মানুষগুলো অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়ে টিকে থাকতে পারবে। তখন ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের অনুপস্থিতির দরুন তাদের ‘বাংলাদেশী’ নাগরিকত্ব না থাকলেও বাঙালী ‘কালচার’ এবং বাংলা ভাষায় কথা বলার স্বভাব থাকবে তথা তাদের ‘বাঙালী’ জাতীয়তা থাকবে। পাশাপাশি তাদের থেকে যেতে পারে মুসলমানিত্ব কিংবা হিন্দুত্ব, তথা তাদের ধর্মগত জাতীয়তা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ইংল্যান্ডের শাসনাধীন। কিন্তু ওই সময়ে এখানকার বাঙালী বা তামিলরা ইংলিশ জাতির লোক হয়ে যায়নি, তারা জাতি হিসেবে ছিল, যথাক্রমে বাঙালী ও তামিল। এই ২০১৯ সালেও তাদের উত্তরসূরিরা বাঙালী ও তামিল। জাতীয়তা কোন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যিকভাবে অনুভব না করতেও পারে। এটি অনেক সময় কোন রাষ্ট্রের সীমানাও না মানতে পারে। ১৯৯০ সালে জার্মান জাতির লোকেরা দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক ছিল, কিন্তু তাদের ব্যুৎপত্তি ও ভাষাগত টান তথা ‘জার্মান-জাতীয়তা’ তাদের পূর্ব জার্মানির নাগরিকত্ব ও পশ্চিম জার্মানির নাগরিকত্ব বিসর্জন দিতে এবং জার্মান প্রাচীর ভেঙ্গে নতুন জার্মানি রাষ্ট্র গঠন করতে অতি সহজ সুযোগ করে দেয়। ঞৎবধঃু ড়হ ঃযব ঋরহধষ ঝবঃঃষবসবহঃ রিঃয জবংঢ়বপঃ ঃড় এবৎসধহু ১৯৯০ মোতাবেক পুনর্গঠিত হয় জার্মানি রাষ্ট্র। ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত মুসলমান জাতির লোকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাস করেও নিজেদের একই ‘মুসলমান জাতি’, ‘মুসলিম উম্মাহ’ মনে করে। তেমনি হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রীস্টানরাও পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাস করে, কিন্তু প্রত্যেকেই নিজেদের আপন আপন জাতির সদস্য মনে করে। অনুরূপভাবে ব্যুৎপত্তি বা ভাষারভিত্তিতে গঠিত বাঙালী জাতি প্রধানত বাংলাদেশ ও ভারত নামক দুই রাষ্ট্রে বসবাস করলেও তারা নিজেদের একই জাতির সদস্য মনে করে। আসলে জাতীয়তাবোধ একটি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। কিন্তু নাগরিকত্ব একটি আইনগত অবস্থা। একটি মানবগোষ্ঠীর মধ্যে একই ধরনের স্বার্থের বন্ধন, ধ্যান-ধারণার সাদৃশ্য, অতীতের স্মৃতি-ঐতিহ্যের প্রতি সমান অনুরাগ কিংবা কোন একই আদর্শ থাকলে সেই মানবগোষ্ঠী একটি জাতি হতে পারে। এসব উপাদানের বিচারে তথা ব্যুৎপত্তিগত বা ভাষাগত বিচারে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জাতি হলো বাঙালী আর সংখ্যালঘু জাতি হলো সাতান্নটি, যেমন চাকমা, মগ, মুরং, খাসিয়া, সাঁওতাল, তঞ্চংগ্যা ইত্যাদি। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জাতি হলো মুসলমান, ধর্মীয় সংখ্যালঘু জাতি হলো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও শিখরা। তবে তারা সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু যাই হোক না কেন, সন্দেহ নেই যে, প্রত্যেকেই একেকটি জাতি। কিন্তু এই সংখ্যাগুরু বাঙালী জাতি আর সংখ্যালঘু জাতি আইন মোতাবেক সকলেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক। জাতীয়তা প্রাণীর রক্তের মতো, নিঃশেষে ফেলে দেয়া যায় না। কিন্তু নাগরিকত্ব পোশাকের মতো, যে কোন সময় চেইঞ্জ করা যায়। আপনি ইচ্ছে করলেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন। তখন আইনের তাগিদেই আমেরিকা আপনার দেখভাল করবে, বাংলাদেশ নয়। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ব্যুৎপত্তিগত/ভাষাগত ‘বাঙালী জাতীয়তা’ ত্যাগ করতে পারবেন না। আপনি বড়জোর কয়েকদিন মাছ-ভাত না খেয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ফাস্ট ফুড খেয়ে হয়ত চলতে পারবেন, কিন্ত মাছ-ভাতের জন্য প্রাণটা আপনার ছোঁ ছোঁ করতেই থাকবে। চুরি করে হলেও মাছ-ভাত খেয়ে আপনি শান্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবেন। আবার লোক দেখানোর জন্য ইংরেজীতে অনর্গল কথা বলবেন হয়ত, কিন্তু আপনার মাকে যতক্ষণ বাংলায় ‘মা’ না ডাকবেন ততক্ষণ শান্তি পাবেন না, আপনার মা-ও আপনার মুখে ওই ‘মা’ ডাক না শোনা পর্যন্ত প্রশান্তি পাবেন না। এটিই আমার-আপনার ‘বাঙালী জাতীয়তা’। ধর্মীয় জাতীয়তা অবশ্য এতখানি সলিড বস্তু নয়। আইনের মাধ্যমে পোশাকের মতো এটিও নাগরিকত্বের মতো চেইঞ্জ করা সম্ভব। কোন হিন্দু মুসলিম হতে পারে, কোন বৌদ্ধ খ্রীস্টান হতে পারে। একটা এফিডেভিটই যথেষ্ট। কিন্তু কোন বাঙালী কখনই ইংরেজ বা সাঁওতাল বা চাকমা হতে পারে না। তেমনি কোন ইংরেজ বা সাঁওতাল বা চাকমা কখনই বাঙালী হতে পারে না। এফিডেভিট বা আইনের প্রয়োগ এখানে কোন কাজে আসে না। অতএব, আমাদের মেধায়-মননে-ব্রেনে সবচেয়ে গভীরে প্রথিত ব্যুৎপত্তিগত/ভাষাগত/সাংস্কৃতিক যে জাতীয়তা সেটিরই নাম ‘বাঙালী’। (২) এবার নাগরিকত্ব। তাহলে বক্তব্যটা আরেকটু পরিষ্কার হতে পারে। নাগরিকত্ব হলো রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রে বসবাসরত মানুষের আইনগত সম্পর্ক। এই আইনগত সম্পর্কের কারণে নাগরিকগণ কিছু দায়-দায়িত্ব পালন করেন এবং তদ্বিপরীতে কিছু অধিকার ভোগ করেন। তারা সরকারকে ট্যাক্স দেন, রাষ্ট্রের আইন-কানুন মেনে চলেন, প্রতিনিধি নির্বাচন করে সরকার পরিচালনায় অংশ নেন এবং রাষ্ট্র কোন দায়িত্ব অর্পণ করলে তা পালন করেন। বিপরীতক্রমে তারা রাষ্ট্রের দেয়া সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করেন, যেমন সরকারী চিকিৎসা সুবিধা ভোগ করেন এবং বিশেষ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সরকারের দেয়া অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সুবিধা গ্রহণ করেন। কোন নাগরিক বিদেশ গেলে সেখানে তার অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কেও রাষ্ট্র সচেতন থাকে এবং সেখানে কোন অসুবিধায় পড়লে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই তো গত ২০১৯-এর মে মাসে তিউনিশিয়া থেকে সাগরে প্রাণ হারানো কয়েকজন হতভাগ্য বাংলাদেশী নাগরিককে সরকার দেশে আনার ব্যবস্থা করে। ২০১১ সালের শেষের দিকে সৌদী আরবে আটজন বাংলাদেশীর শিরñেদের প্রেক্ষিতে দেশে সরকারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষিতে সেদেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরও পাঁচজন বাংলাদেশীকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সফল হয়। একজন মানুষ জন্মসূত্রে বা অনুমোদনসূত্রে যেভাবেই নাগরিকত্ব অর্জন করুন না কেন তিনি উল্লিখিত দায়-দায়িত্ব পালন করে থাকেন এবং অধিকার বা সুবিধাসমূহ গ্রহণ করে থাকেন। কোন ব্যক্তির নাগরিক হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্র নামক একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তাকে আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রদান করে। রাষ্ট্র না থাকলে তার নাগরিকত্বের প্রশ্ন ওঠে না। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তার নাগরিকত্বের পূর্বশর্ত। কিন্তু রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তার জাতীয়তার পূর্বশর্ত না-ও হতে পারে। কারণ রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিরও জাতীয়তা থাকতে পারে। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব না থাকলেও জাতি থাকতে পারে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সেদেশের সরকার নাগরিকত্ব না দিলেও তারা রোহিঙ্গা জাতির লোক হিসেবে বাংলাদেশের কক্সবাজারে ও ভাসানচরে বসবাস করছে। এবার একটু কর্তব্যের কথা বলতে চাই। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ (২)-এ এদেশের সমস্ত জনগণকে জাতি হিসেবে ‘বাঙালী’ বলাটা ৯৮% যথার্থ, পুরোপুরি নয়। চাকমারা চাকমাই, সাঁওতালরা সাঁওতালই। তারা কখনই ‘বাঙালী’ নয়। বাঙালীরাও কখনও চাকমা বা সাঁওতাল নয়। তবে এটিই সত্য যে, বাংলাদেশের জনগণের ৯৮% ‘জাতি হিসেবে বাঙালী’ এবং অতি অল্পাংশ (মাত্র ২%) জাতি হিসেবে অবাঙালী। বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। ষোড়শ শতাব্দীর সুইডেন ও ডেনমার্কের মতো এক জাতির এক রাষ্ট্র নয়, জাতীয় রাষ্ট্র নয়। তবে ৯৮টি আমের গাছ ও ২টি অন্যান্য গাছ নিয়ে যে বাগান তাকে আমবাগান বলাটা ইগনোরেবল ভ্রান্তি। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত জনগণকে জাতি হিসেবে ‘বাঙালী’ বলাটাও ইগনোরেবল ভ্রান্তি। সংবিধানে বাংলাদেশের সমস্ত জনগণকে ‘জাতি হিসেবে বাঙালী’ বলার মাধ্যমে চাকমা, মগ, মুরং, খাসিয়া, সাঁওতাল, তঞ্চংগাদেরও ‘জাতি হিসেবে বাঙালী’ বলে পরিচিত করানো হয়েছে। এতে অবশ্য পাহাড় ও সমতলের জাতি বা ‘উপজাতিদের’ মনে কিঞ্চিৎ হলেও কষ্টের সঞ্চার হয়েছে বলে শোনা যায়। এটিকে প্রশমিত করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম দায়িত্ব। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে ওই সাতান্নটি উপজাতির লোকদের জন্য একটি মাত্র শব্দ ‘অবাঙালী’ উল্লেখ করা যায়। ঠিক যেমন সংবিধানে ‘ইসলাম’ ধর্মের পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের কথা বলা হয়েছে। কারণ শেখ হাসিনাই ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের ‘সেটলার-অগ্নি’ নির্বাপনে ত্রাতা ও প্রবক্তার ভূমিকা পালন করেন। পাহাড়ে এখন যেটুকু শান্তি সেটুকু শেখ হাসিনারই অবদান। প্রধানমন্ত্রী এ কাজটুকু করলেও আরও বেশি সঠিক হয়, তাদের মনে স্বস্তি আসে, বাঙালীরাও তাদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে। সামান্য যে মানসিক দূরত্ব রয়েছে তা ঘুচে যায়। যেহেতু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে আমাদের জাতীয়তা ‘বাঙালী’ সেহেতু অবশ্যই নথিপত্র সংশোধন করা হোক। বিসিএস, বিজেএস বা যে কোন চাকরির কাগজ/অনলাইন ফরম, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-ইনস্টিটিউটে ভর্তির কাগজ/ অনলাইন ফরম, কোন শপথ নেয়া পদের আবেদনপত্র বা অনুমোদনপত্র, বাংলাদেশের পাসপোর্ট যা-ই হোক না কেন, প্রয়োজনে সফ্টওয়্যার নতুনভাবে সেট-আপ দিয়ে সবগুলোতেই লেখা হোক ‘জাতীয়তা বাঙালী’। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারেন। সরকারী গেজেট নোটিফিকেশন দ্বারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে আদেশ দেয়া হোক তাদের নথিপত্র সংশোধন করতে এবং জাতীয়তা ‘বাঙালী’ লিখতে, এমনকি তা না লিখলে কোন কাগজ বা নথি অগ্রহণ না করতে। সেখানে লেখা হতে পারে ‘নাগরিকত্ব বংলাদেশী’ কিন্তু ‘জাতীয়তা বাঙালী’। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোন শক্তি সুযোগ পেলে কখনই আর লিখতে দেবে না ‘জাতীয়তা বাঙালী’। মনে রাখতে হবে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ আর ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’। যার যার জাতীয়তা তার তারই থাক। বহুজাতিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। ‘বাঙালী জাতীয়তা’ চিরন্তন হোক। চেয়ে রইলাম সেদিনের প্রত্যাশায়। জয় বাংলা। লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, সাবেক ডিন, আইন অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ
×