ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলন কান্তি দে

যাত্রাশিল্পে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০

যাত্রাশিল্পে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ

‘হ্যাঁ, আমি মুজিব বলছি। আমার ছয় দফার মধ্যে বেজে ওঠে বাঙালীর ঐকতান, ছয় দফা বাঙালীর মুক্তি সনদ, ছয় দফা বাঙালীর বেঁচে থাকার অস্তিত্ব। তাই আমার ছয় দফা নিয়ে ব্যঙ্গ করলে বাংলার দামাল ছেলেরা তোমাদের চ্যাংদোলা করে বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলে দেবে।’ এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবন নিয়ে লেখা ‘বাংলার মহানায়ক’ যাত্রাপালার একটি সংলাপ। বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক মোট ৮টি পালা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রায় ২৫টি পালা এ যাবত রচিত হয়েছে বাংলাদেশে। তবে দু-একটি ছাড়া অধিকাংশ যাত্রাপালারই সচিত্র রিপোর্ট কিংবা ফিচার পত্রপত্রিকায় তেমন আসেনি। যাত্রা ও সংবাদপত্রের মধ্যে একটি সুন্দর যোগাযোগ না থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের পালা সম্পর্কিত খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা নেই আমাদের সংস্কৃতিতে। আমাদের এখানে প্রথিতযশা নাট্যকাররা যখন যাত্রাপালা লিখছেন না, তখন এই সাহিত্যকর্মে অনেকটা দায়ভার নিয়েই এগিয়ে আসতে দেখা যায় যাত্রা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। রাতজাগা মানুষদের কালি ও কলমে বেশকিছু মুক্তিযুদ্ধের যাত্রাপালা আমরা পেয়েছি। এ তালিকায় রয়েছে- একুশে পদকপ্রাপ্ত জ্যোৎস্না বিশ্বাসের ‘রক্তস্নাত ৭১’, বাগেরহাটের পরিতোষ ব্রহ্মচারীর ‘নদীর নাম মধুমতি’, ‘রক্তে ধোয়া নয়া আবাদ’, নরসিংদীর জালালউদ্দীনের ‘রক্তে রাঙা বাংলাদেশ’, ‘খুলনার ডুমুরিয়ার সিদ্দিক মাস্টারের ‘সুন্দরবনের জোড়া বাঘ’, যশোরের সাধন মুখার্জীর ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’, সিরাজগঞ্জের আবদুস সামাদের ‘একাত্তরেরর জল্লাদ’, নেত্রকোনার রাখাল বিশ্বাসের ‘একাত্তরের সৈনিক’, একই জেলার শফিকুল ইসলাম খানের ‘সন্ত্রাসের দুই ডানা’, এম এ মজিদের ‘সোনার বাংলা’, নিরাপদ মণ্ডলের ‘মুক্তিফৌজ’, বিপিন সরকারের ‘মুক্তিসেনা’, দীলিপ সরকারের ‘বাংলার বিজয়’, নজরুল ইসলাম সাজুর ‘বাংলার মুক্তি’ এবং মিলন কান্তি দের ‘এই দেশ এই মাটি।’ যাত্রার লোকজনের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের দুজন প্রতিনিধিও যাত্রাপালাকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এদের একজন কবি-প্রাবন্ধিক-গবেষক ড. আমিনুর রহমান সুলতান, তিনি লিখেছেন- ‘বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা।’ পালাটি ২০১৬ সালের ২ আগস্ট দেশ অপেরার পরিবেশনায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথম মঞ্চায়ন হয়। আরেকজন মহসিন হোসাইন, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। তার ‘নীলকরের ছায়ামূর্তি’, ‘মীরজাফরের আর্তনাদ।’ পালাগুলো বিগত শতাব্দীর ’৮০-এর দশকে জোনাকী অপেরা ও নরনারায়ণ অপেরায় মঞ্চস্থ হয়েছিল। বিষয়বস্তুর দিক থেকে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, কাল্পনিক, সামাজিক, যুদ্ধ, জাগরণ-এভাবে যাত্রার পালাবদলে এক সময় দেখা গেল ‘বাঙালীর শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে’ যাত্রামঞ্চে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম যাত্রাপালা রচনা করেন যশোরের চণ্ডী অপেরার মালিক সাধন মুখার্জী। ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে এটি যশোর খুলনা ফরিদপুরে পুনঃপুন মঞ্চস্থ হয়। ২০১১ সালে লেখা দুটি পালার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’, লিখেছেন ফরিদপুরের সদরপুর থানার বাবুরচর গ্রামের খন্দকার হারুন-উর-রশীদ। ‘বাংলার মহানায়ক’ নামে আরেকটি পালার রচয়িতা বর্তমান লেখক। দেশ অপেরার ব্যানারে এর কয়েকটি বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয় মঞ্চে (২০১১), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যোৎসবে (২০১২), নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও লোকজ মেলায় ও শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে (২০১৬), চট্টগ্রামে উত্তর কাট্টলী মোস্তফা-হাকীম ডিগ্রি কলেজে ও যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ ময়মনসিংহ জেলা শাখা আয়োজিত নির্মল যাত্রা উৎসবে (২০১৭)। উপন্যাসের মতো করে বঙ্গবন্ধুর জীবন কাহিনী ‘ফাদার অব দ্য নেশান’ লিখেছেন অধ্যাপক ড. এএইচ খান। এই বইটি অবলম্বন করে এবং আরও কিছু গ্রন্থের সহায়তায় রচিত ‘বাংলার মহানায়ক’ যাত্রাপালা ২০১৫ সালে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়। এর ভূমিকা লিখেছেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। ২০১৯ সালে রচিত আরও ৪টি পালা হচ্ছে আমিনুর রহমান সুলতানের ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’, এমএ মজিদের ‘রক্তাক্ত ৭১’, জাহাঙ্গীর হোসেনর ‘একাত্তরের মহানায়ক’ এবং বর্তমান লেখকের ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে।’ এর মধ্যে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু গত বছর শিল্পকলা একাডেমির যাত্রা উৎসবে অভিনীত হয় এবং এ বছর অক্টোবরে চিরন্তন প্রকাশ বইটি প্রকাশ করে। গত বছর অক্টোবরে ময়মনসিংহ জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় মঞ্চায়ন হয় বঙ্গবন্ধুর ডাকে যাত্রাপালা। এ বছর একুশে বইমেলায় বিভাস প্রকাশনী থেকে বের হয় শফিকুল ইসলাম খানের পালা ‘জাতির পিতার আত্মদান।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পশ্চিম বাংলায় বিভিন্ন পালাকারের রচিত ৭টি যাত্রাপালার সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে- মন্মথ রায়ের ‘আমি মুজিব নই’, নরেশ চক্রবর্তীর ‘সংগ্রামী মুজিব’, সত্য প্রকাশ দত্তের ‘বঙ্গবন্ধু মুজিবুর’, ছবি বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গবন্ধুর ডাক।’ ১৯৭২ সালে এই সিরিজের দুটি পালা হচ্ছে ব্রজেন্দ্র কুমার দের মুজিবের ডাক ও অরুণ রায়ের ‘আমি মুজিব বলছি।’ ১৯৯৬ সালে অভিনেতা-পালাকার মৃণাল কর লিখেছেন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’ যাত্রাপালাকাররা মনে করেন, এখনই তো সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমস্ত অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধু বিষয়ক যাত্রাপালার আয়োজন করতে হবে শহর-বন্দর গ্রামে। উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। এখনই সময় বাঙালী জাতির মুক্তিদাতা মহামানবের ওই অবিনাশী কণ্ঠ আমাদের ধারণ করা কি নাটকে, কি যাত্রায়!
×