ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

বাংলাদেশ জেলহত্যা ॥ ১৯৭৫

প্রকাশিত: ২১:১৮, ৪ নভেম্বর ২০২০

বাংলাদেশ জেলহত্যা ॥ ১৯৭৫

(গতকালের পর) শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ধারণা করেছিলেন যে, কোন পাল্টা অভ্যুত্থান হলে সেটি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। সে ধরনের পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা কিছুটা ভেবেও রেখেছিলেন। ওই ধরনের ক্যু হলে তখনকার আওয়ামী লীগে যাতে কোন ধরনের লিডারশিপ না থাকে সেটাই তারা বোধহয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করেছিল। হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিল, যদি সেই চারজন রাজনীতিবিদকে হত্যা করা হয়, তাহলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবে না। বইতে আরও উল্লেখ করা হয়, অক্টোবরের মাঝামাঝি কর্নেল সাফায়াত জামিল নিশ্চিত হলেন যে, সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজরদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান না বা আরও সময় নিতে চান। আর যে পরিস্থিতি চলছে তা এভাবে চলতে থাকলে সেনাবাহিনীতে ‘ডিসিপ্লিন’ বলতে কিছুই থাকবে না। সাফায়াত জামিল এসব নিয়ে পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে পরামর্শ করতে শুরু করলেন। অক্টোবরের শেষ দিকে এমন পরিস্থিতি হলো তাতে মনে হতো, সমগ্র সশস্ত্রবাহিনী ফারুক রশিদ ও ডালিমের কথায় চলত, আর সে সঙ্গে সমস্ত দেশ কয়েকটি ট্যাঙ্ক আর কিছু সেনা অফিসারের হাতে জিম্মি। ফলে অক্টোবরের শেষ দিকে নিশ্চিত হলাম যে, সাফায়াত জামিল প্রয়োজন বোধে খালেদ মোশাররফকে নিয়েই কিছু করতে যাচ্ছেন। ২ নবেম্বর ১৯৭৫। খালেদ মোশাররফ টাঙ্গাইল থেকে ফিরে আসার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার সাফায়াত জামিল আর তার অধীনস্থ পদাতিক ইউনিটগুলো নিয়ে সূচনা করলেন পাল্টা অভ্যুত্থান। বঙ্গভবনে নিয়োজিত ১ম বেঙ্গলের কোম্পানিটি পশ্চাদপসারণ করে সেনানিবাসে চলে এসেছে এবং সেনাপ্রধান মেজল জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়েছে। ৪ বেঙ্গলের এক কোম্পানিকে সুসজ্জিত করে পাঠানো হয় বঙ্গভবনের ট্যাঙ্কগুলোর গতিরোধ করে প্রয়োজনে নিষ্ক্রিয় করার জন্য। এ সবই করা হয় রক্তপাত এড়ানো এবং ফারুক-রশিদদের ওপর স্থায়ুচাপ সৃষ্টির জন্য। ৩ নবেম্বর ফজরের সময় থেকেই শুরু হয় খালেদ মোশাররফ আর রশিদের মধ্যে স্থায়ুযুদ্ধ। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। খালেদ মোশাররফ ৪ দফা শর্ত দিয়ে দেন আর সেগুলো বঙ্গভবনে পাঠানো হয়। শর্তগুলো ছিল- ১. বঙ্গভবনে অবস্থানরত সামরিক অফিসারদের (অভ্যুত্থানে জড়িত) নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ২. জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে অপসারণ করে নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ ৩. মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নিয়োগ দেয়া। তবে এসব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে মোশতাককেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল এবং ৪. এ পর্যন্ত মোশতাক সরকার যে সমস্ত নতুন নীতি নির্ধারণ করেছে ও বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে তা রহিতকরণ। এসব দাবি-দাওয়া খালেদ মোশাররফ রশীদের মাধ্যমে মোশতাককে জানাতে থাকে। আর রশীদ বেশ কিছু সময়ক্ষেপণ করে রাষ্ট্রপতির অপারগতা জানাতে থাকে। হঠাৎ দৃশ্যপটে পরিবর্তন কয়েক ঘণ্টা বাগ্বিতণ্ডার পর সকাল ৯টার দিকে বঙ্গভবন থেকে স্বয়ং খন্দকার মোশতাক খালেদ মোশাররফের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য কথা বলেন। কথা শেষ হওয়ার পর খালেদ মোশাররফ জানান, শক্তি প্রদর্শনী কাজে লেগেছে। মোশতাক আহমেদ শর্তগুলো মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন, রক্তপাত এড়াবার জন্য এবং ফারুক রশিদ আর তাদের সঙ্গীরা যারা দেশত্যাগ করতে চাইবে তাদের নির্দ্বিধায় দেশ ছেড়ে যেতে দিতে হবে। এসব উল্লেখ করে বাইয়ে আরও বলা হয়, হঠাৎ দৃশ্যপটে কেন পরিবর্তন হলো? কেনইবা যুদ্ধংদেহী ফারুক আর রশীদের এ মত পরিবর্তন। সেদিন সেনানিবাসে বসে কেউই জানতে পারল না এ মত পরিবর্তনের পেছনে ছিল জেলে আওয়ামী লীগের চার জন সিনিয়র নেতা হত্যা। আর এ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় রশীদ আর খন্দকার মোশতাকের সজ্ঞানে ও সম্মতিতে। ২ নবেম্বর রাতে পাল্টা অভ্যুত্থান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই এ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে। এ জঘন্য ঘটনায় আওয়ামী লীগের যে চার নেতা প্রাণ হারান তারা হলেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান আর তাজউদ্দীন আহমেদ। ৩ নবেম্বর সকালে এ ঘটনা খন্দকার মোশতাক ও রশীদ ছাড়া আর একজন ব্যক্তি জেনেছিলেন তিনি হলেন মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। খলিলকে সংবাদটি দেয় আইজি পুলিশ এবং সঙ্গে সঙ্গেই খলিলুর রহমান রাষ্ট্রপতির সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে জানাতে বলেন। চাষী খবরটি মোশতাক আহমেদকে দিতেই রাষ্ট্রপতির অভিব্যক্তি থেকে তিনি বুঝতে পারেন এ হত্যা সম্বন্ধে রাষ্ট্রপতি ওয়াকিফহাল। (চলবে) লেখক : সাংবাদিক
×