ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

অনলাইনে পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ৯ অক্টোবর ২০২০

অনলাইনে পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি

করোনাকালীন অনলাইনে এবং টিভির মাধ্যমে পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে। তবে দুর্নীতিমুক্তভাবে অনলাইনে পরীক্ষা নিতে হলে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ জন্য প্রয়োজনে আইনের সংশোধন দরকার। ধনী দরিদ্র্যের বৈষম্যের কারণে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করতে সক্ষম হচ্ছে না। আবার কার্যক্রমে যেখানে প্রাকটিক্যাল করতে হয়, সেখানে ল্যাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা দরকার। বর্তমানে শিক্ষার সবচেয়ে বেশি ঘাত-প্রতিঘাত ঘটেছে করোনার জন্য। বৈশ্বিক এ মহামারী দেশে-বিদেশে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এইচএসসি পরীক্ষা স্বাস্থ্যগত কারণে নেয়া সম্ভব হয়নি। এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে আজ সমগ্র বিশ্বকে। করোনার প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই অনলাইন এডুকেশনের কথা বলেছিলাম। সরকার ইউজিসির মাধ্যমে অনলাইন এডুকেশন চালু করেছে। আবার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ টিভির মাধ্যমে পাঠ্যক্রম চালু করেছে। অনলাইন এডুকেশনে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বেশ কিছু যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল, তারা এগিয়ে আছে। কেননা অনলাইন কেবল অভ্যাস নয়, সঙ্গে প্রয়োজনীয় মোবাইল/ল্যাপটপ এবং ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। এখন এমনও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার আছে টাকা ভরলে আপসে টাকা কেটে নেয়। এদের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বরাবর কমপ্লেন করে লাভ না হওয়ায় ভোক্তা অধিকারেও অনলাইনে কমপ্লেন কারও লাভ হয়নি। ওলিগোপলিস্টিক নেচারের ব্যবসায় লিপ্ত রয়েছে এদেশের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা। তবে টেলিটকের ইন্টারনেট সার্ভিস সংস্থা অযথা টাকা কাটে না। কিন্তু সমস্যা হলো যেদিন বৃষ্টি হয় এবং কিছুক্ষণ কারেন্ট না থাকলে টেলিটকের ইন্টারনেট সার্ভিস ঠিকমতো কাজ করে না। সরকার অবশ্য টেলিটকের মাধ্যমে ইন্টারনেট সার্ভিস সস্তায় ছাত্রছাত্রীদের দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। আবার মোবাইল ফোন কেনার জন্য ঋণ দেয়ারও উদ্যোগ নিয়েছে। মুজিববর্ষ শেষ হওয়ার পূর্বেই গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা চালু হলে জাতির পিতার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সম্প্রতি বলেছেন, ই-লার্নিং পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের পছন্দ মাফিক পড়াশোনার সুযোগ পায় এবং একটি বিশেষ প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠতে পারে এবং ভবিষ্যতে শিক্ষার গতি প্রকৃতি আরও বিস্তৃত হয়, সে জন্য পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী ২০১০ সালে প্রণীত বর্তমান শিক্ষানীতিকে আরও আধুনিকায়নের ঘোষণা দেন। কেননা, করোনাভাইরাস শুরু না হলে বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতির ট্রেডিশনাল পদ্ধতির সংস্কার এত জরুরী হয়ে উঠত না। তিনি যুগোপযোগী শিক্ষার জন্য ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির পাশাপাশি ই-লার্নিংভিত্তিক পাঠ ও পঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন, যাতে করে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক বৈশ্বিক মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীরা গড়ে উঠতে পারেন। ই-লার্নিংকে অবশ্যই প্রযুক্তিবান্ধব বলে অভিহিত করা যায়। তবে অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। কেননা সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও যারা অপেক্ষাকৃত গরিব তাদের পক্ষে অনলাইনে ক্লাস করা কষ্টসাধ্য। সরকার এ বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করছে। তবে যারা মোবাইল প্রস্তুতকারী কোম্পানি সিম্ফনি, ওয়ালটন এদের উচিত স্বল্পমূল্যে একদম গরিব শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন বিতরণ করা। আধুনিক পাঠ ও পঠনের মনমানসিকতা পরিবর্তনের দিকেও গুরুত্বারোপ করা উচিত। শিক্ষা আসলে মানুষকে সর্বজনীন এবং মাহাত্ম্যের পরিচয় দিয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থী যে স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্নকে বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্রম প্রসারমান করতে সচেষ্ট থাকে। অনলাইন পদ্ধতি অবশ্যই বর্তমান বৈশ্বিক মহামারীতে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ অবস্থা। অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু অনলাইনে পরীক্ষাও নিচ্ছে। ইউজিসির গুণগতমান পরীক্ষার ব্যাপারে দেখা উচিত। শিক্ষা ব্যবস্থার আজ অনেক বেশি অনলাইনমুখী হয়ে উঠেছে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সৌহার্দ্যপ্রীতির সম্পর্ক, তা আজ কোভিডের কারণে অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। কোভিডের ক্ষতিকারক দিক হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা এবং ঘৃণ্য শিশু ও নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়া। এটি একটি জঘন্য মনোবৃত্তির পরিচায়ক। আসলে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনেকের মনমানসিকতা মানবিক পর্যায়ের হয়ে উঠছে না। সরকার ৪ অক্টোবর থেকে একাদশ শ্রেণীতে অনলাইনে ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে- এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। অনলাইন ক্লাসে মাদকবিরোধী বক্তব্য রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি শিশু ও নারী নির্যাতন এবং সাইবার ক্রাইম বিরোধী বক্তব্য রাখা দরকার। অনলাইনে পরীক্ষার ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এক্ষেত্রে অনলাইনে পরীক্ষা দেয়ার সময় দুষ্ট প্রকৃতির শিক্ষার্থীরা যেন অপব্যবহারের সুযোগ না নিতে পারে, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য বেশ কিছু শিক্ষার্র্থী বাহ্যিক উপস্থিতিতে কিংবা অনলাইনে পরীক্ষার সময়ে প্রতারণার জন্য নিত্য নতুন কলাকৌশল নেয়, যা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অনলাইন পরীক্ষা নকলমুক্ত করার জন্য সুরক্ষিত ব্রাউজার ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। যখন অনলাইন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে তখন একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্রাউজারে অন্য উইন্ডোজ বা ট্যাপে যাতে পরীক্ষার্থী খুলতে না পারে, সে জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। একজন পরীক্ষার্থীর উত্তর বা বাইরে থেকে নকল সরবরাহ করা বন্ধ করতে হবে। শেয়ার আইটি এ্যাপস বন্ধ করা উচিত। সিকিউরড ব্রাউজারের প্রযুক্তি অনলাইন পরীক্ষা চলার সময়ে পরীক্ষার্থীদের অন্য কোন উইন্ডোজ খুলতে বাধা দিয়ে থাকে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে পরীক্ষার্থীরা কেবল তাদের পরীক্ষার উইন্ডোজ এ্যাক্সেস করার সুযোগ পায়। কোন ধরনের অনুলিপি, কিংবা কোথাও থেকে এনে উত্তর বসিয়ে দেয়া অথবা স্ক্রিনশর্ট যাতে স্বল্প সুযোগে কী বোর্ডের সহায়তায় উত্তর দেয়ার জন্য ঢুকতে না পরে, সে জন্য প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত যাতে কোন পরীক্ষার্থী ভিন্ন কোন উইন্ডোজ খোলার প্রয়াস যখনই করবেন, তখনই যেন সতর্কতার সঙ্কেত প্রজ¦লিত হয় এবং বাধ্য হয়ে পরীক্ষার্থী কেবল তার পরীক্ষার উইন্ডোজ ব্যবহার করেন। কেউ যদি অসুদপায় করতে চান তাত করে ভিন্ন উইন্ডোজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পরীক্ষা দেয়া থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বহিষ্কৃত হতে পারেন। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন অবশ্যই উপযুক্ত ডিভাইস যেমন, ডেস্কটপ পিসি, ল্যাপটপ, ইমেইল ফোন, ট্যাবলেট এবং আন ইন্টারেপেটেড ইন্টারনেট এ্যাক্সেসের পাশাপাশি কম্পিউটার প্যারিফারি ওয়েবক্যাম ভিডিও এবং মাইকের কার্যকারিতা। এক্ষেত্রে অবশ্যই পরীক্ষার্থীর পরিচয়পত্র সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করতে হয়-যা দূরবর্তী স্থান থেকে প্রক্টর দক্ষতা ও কার্যকারিতার সঙ্গে যাচাই করে দেখতে পারেন। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল পরীক্ষার্থীরা অনলাইনে পরীক্ষা দিতে উপস্থিত হতে পারেন। পরীক্ষার্থীর ছবি এবং ভিডিওসমূহ সংযুক্ত করে একটি ওয়েব ক্যামেরা ব্যবহার করে গ্রহণ করা যেতে পারে। অটো প্রক্টেরিংয়ের ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর মোবাইল ফোনের মূল ঘটনাসমূহকে ট্র্যাক করতে হয়। পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় সন্দেহজনকভবে ঘটনার অডিও ভিডিও ধারণ করে অন্যায়কারী পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ব্যবস্থা করা উচিত। বস্তুত অনলাইন কার্যক্রমে পড়াশোনা করা সম্ভব। অনলাইনে পরীক্ষাও নেয়া সম্ভব। কিন্তু তার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধমূলক ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নইলে কেবল অনলাইনে পরীক্ষা নিয়ে ডিগ্রী দিলে যদি কোন ধরনের নকলমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার ব্যবস্থা না থাকে কিংবা প্রক্টেরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকে, তবে একজন অনলাইন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে মনে করি কতিপয় অসাধু পরীক্ষার্থীর জন্য আমাদের ভাল ছাত্র সমাজকে কলুষিত করতে পারে। ডিগ্রীপ্রাপ্তরা যারা সততার সঙ্গে পরীক্ষা দেবেন তারাও অন্যায়কারীদের কারণে সমস্যার মুখে পড়বেন। যখন শিক্ষানীতিতে অনলাইনে পাঠ্যক্রম চালুর ব্যবস্থা থাকবে তখন অবশ্যই কিভাবে অনলাইনে নকলমুক্তভাবে পরীক্ষা নেয়া যায় সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। নচেত নকলসহ পরীক্ষা দিলে কতিপয়ের জন্য অধিকাংশ পরীক্ষার্থীকে কালিমামুক্তভবে সনদ পেতে অসুবিধা হতে পারে। এ কারণে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ প্যানেল দ্বারা অনলাইন পরীক্ষা নকলমুক্তভাবে নিতে হবে এবং শাস্তিমূলক বিধানও অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। ‘আবার ওপেন বুক এক্সাম’ পদ্ধতিও চালু করা যেতে পারে, যার বিধান নতুন শিক্ষানীতিতে রাখা যেতে পারে। তবে ওপেন বুক এক্সামের মাধ্যমে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান, যা বই ঘাঁটলেও নিজের মেধা, মনন ও ধীশক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে আমাদের প্রচলিত মুখস্থ বিদ্যার অবসান ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দায়িত্বশীল আচরণ অধিক হারে প্রয়োজন। তারা যখন পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন তখন তারা পরীক্ষার্থীর বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং মৌলিক চিন্তা-ভাবনা এবং সমস্যা হলে সমাধানের পথ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। অনলাইন পরীক্ষাতেও ‘ওপেন বুক এক্সাম’-এর ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে, যাতে করে কেউ কোন পরীক্ষার্থী সম্পর্কে ভিন্ন অবমূল্যায়নের সুযোগ না পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই মন্তব্য করেছেন, এই দৈব দুর্বিপাকে তার সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে উত্তরণে সাহায্য করছে। এ জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যাতে করে বৈশ্বিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নত করা যায়। তিনি দেশে টিভি এবং অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতির প্রশংসা করেন। ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের কথাও বলেন। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও আইটি এক্সপার্ট [email protected]
×