ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাজউদ্দীন-বিতর্ক ॥ ইতিহাসের আলোকে (৩)

প্রকাশিত: ২১:০৬, ১২ আগস্ট ২০২০

তাজউদ্দীন-বিতর্ক ॥ ইতিহাসের আলোকে (৩)

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের একটা কৌশল ছিলÑডিভাইড এ্যান্ড রুল। ভাগ করো এবং শাসন করো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কৌশল টাকা দিয়ে একটি দেশের বুদ্ধিজীবী, এলিট শ্রেণী এবং সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের কিনে ফেলো। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দেশটির অর্থমন্ত্রীর পদে কাউকে বসিয়ে সে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো। এজন্যে পাকিস্তানে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর পর সব অর্থমন্ত্রীই ছিলেন বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনে নিযুক্ত। পাকিস্তানে অর্থমন্ত্রীর পদটি খালি হলেই বলা হতো, ওয়াশিংটন কাকে চাকরিটা দেয় তা দেখা যাক। বাংলাদেশে তাজউদ্দীন আহমদই ছিলেন সেই অর্থমন্ত্রী, যিনি বিশ্বব্যাংকের কোন অনুমোদন ছাড়াই কেবল বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনে অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাজউদ্দীন প্রণীত বাজেটে বিশ্বব্যাংকের বা পশ্চিমা দেশগুলোর কোন সাহায্য পাওয়ার প্রস্তাব ছিল না। নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্যরে সাহায্যে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গঠনের কথা বলা হয়েছিল। বাজেটে ঘাটতি পূরণে সম্ভাব্য পশ্চিমা সাহায্য যোগ করা হয়নি, যদিও পশ্চিমা সাহায্য এসেছিল প্রচুর। লুটপাটও হয়েছিল প্রচুর। দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে পশ্চিমা সাহায্যকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন ভোজবাজি। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, তাজউদ্দীনের পর বিশ্বব্যাংকের খবরদারি অগ্রাহ্য করার সাহস দেখিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা ব্রিজ প্রকল্পে তিনি বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ও চোখ রাঙানি দুটোই অগ্রাহ্য করেছেন। নিজস্ব সম্পদে ব্রিজটি তৈরির কথা বলেছেন। এই ব্যাপারে তার অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা এই দুজনের সঙ্গেই তার মতভেদ হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের আনুগত্য মানার জন্য তাদের পরামর্শ তিনি মানেননি। স্বাধীন বাংলাদেশেও অর্থমন্ত্রী পদ থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে সরানোর জন্য যে চক্রান্ত হয়, তার পেছনে আমেরিকারও হাত ছিল দীর্ঘ। বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালেই তার পরিকল্পনা কমিশনের ‘হার্ভার্ড-সোস্যালিস্ট’ সদস্যরা কেন বিভিন্ন অজুহাতে কেউ আমেরিকায়, কেউ ব্রিটেনে পালিয়েছিলেন, ড. কামাল হোসেন কেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই দীর্ঘকালের জন্য অক্সফোর্ডে চলে গিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে যদি প্রকৃত অনুসন্ধান হতো তাহলে ইতিহাসের অনেক সত্য বেরিয়ে আসত। যে নাফিল্ড অর্গাইজেশনের অর্থ সাহায্যে (রিসার্চ, স্টাডি ইত্যাদি নামে) এই ‘হার্ভার্ড সোস্যালিস্টরা’ বিদেশে পালাতে ও আরাম-আয়েশে কাটাতে পেরেছিলেন, তারও একটা অনুসন্ধান হলে দেখা যেত নাফিল্ড কাদের সংস্থা এবং সিআইএ’র সঙ্গে তার সম্পর্ক কি? আমি বাংলাদেশ ও ভারতের গভীর মিত্রতায় বিশ্বাসী। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপলব্ধি করছি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সাহায্য যেমন সবচাইতে বড় সহায়ক হয়েছে, আবার এই স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তা আমাদের জন্য গলার ফাঁসও হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী এবং তার সরকার ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। কিন্তু তাদের বাইরে ভারতের ব্যুরোক্রাসি, বিগ মিডিয়া ও বিগ বিজনেসের একটা অংশ ছিল, যারা এই স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন, বাংলাদেশকে তারা ‘অধীনতামূলক মিত্রতায়’ বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন বলে আমার ধারণা। তাই তারা মুজিব নেতৃত্বকে অপসারণ করে কাশ্মীরের বখশি গোলাম মোহাম্মদের মতো একজনকে খুঁজছিলেন, যাকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসিয়ে তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারবেন। তাজউদ্দীন আহমদকে তারা বখশি গোলাম মোহাম্মদ বানাবেন ভেবেছিলেন। সফল হননি। বাংলাদেশে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রচার শুরু করেন এনায়েতুল্লা খান মিন্টু। তার লেখা উদ্ধৃত করে কুলদীপ নায়ার ও কয়েকজন নামী ভারতীয় কলামিস্ট ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রভৃতি বড় বড় পত্রিকায় মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে কলাম লেখা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় নির্দিষ্ট করেছিলেন বাঙালী। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা তার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রচার শুরু করে বাংলাদেশের বাঙালীরা বাঙালী নয়, তারা বাংলাদেশী। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পর এই বাংলাদেশী পরিচয়কেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের খোলস পরিয়ে আবার সাম্প্রদায়িকতার ছুরিতে বাঙালির পরিচয়কে বিভক্ত করে ফেলেন। এ সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি, ‘আমরা বাংলাদেশি না বাঙালি?’ তাই এখানে তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তাজউদ্দীন আহমদ তাকে নিয়ে এই ষড়যন্ত্র টের পান মন্ত্রিত্ব হারাবার পর, যখন তাকে তার মিত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরামর্শ দেন। এই সময় বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন প্রবীণ কূটনীতিক সুবিমল দত্ত। তার দত্ত পদবিটা সঠিকভাবে লিখলাম কিনা জানি না। স্মরণ করতে পারছি না। তিনি জওয়াহের লাল নেহেরুর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। নেহেরু তাকে রাশিয়ায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী এই পিতৃবন্ধুকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। তাই প্রথম ভারতীয় দূত করে তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। তাকে চোখে জল নিয়ে ঢাকা থেকে বিদায় নিতে দেখেছি। তার কাছে বাংলাদেশবিরোধী অনেক অবিশ্বাস্য ষড়যন্ত্রের কথা শুনেছি। তার কাছেই শুনেছি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য পাঁচটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে তিনি তা জানিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা গ্রাহ্য করেননি। এমন কি জিয়াউর রহমানের পাকিস্তান ও আমেরিকান ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পর্কে ডাবল লাল ক্রসমার্কা (বিশেষ গোপনীয়) ফাইলও তারা পাঠিয়েছিলেন। সুবিমল বাবু তখন ছিলেন আশি বছরের কাছাকাছি মানুষ। তিনি আমাকে একদিন জানান, ‘তাজউদ্দীন আহমদকে সামনে খাড়া করে ভারতের একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াশীল মহল বঙ্গবন্ধুবিরোধী চক্রান্ত শুরু করেছে। ইন্দিরা গান্ধী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তাজউদ্দীন সাহেবকে যেন সতর্ক করি। আমি তা করেছি। তাজউদ্দীন সাহেবও এ ধরনের চক্রান্তের খবর পেয়েছেন। বাংলাদেশে তার একটি বন্ধুমহল এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত। তারা তাকে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমিও জানতাম তাজউদ্দীন ভাই মনের দুঃখে বনে যাবেন, তবু বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতায় যাবেন না। আমি কয়েকদিন পর তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় যাই। দেখি তার ড্রয়িং রুমে বঙ্গবন্ধুর লাইফসাইজ একটি ছবি পীচবোর্ডে লাগিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো। বললাম, তাজউদ্দীন ভাই, বঙ্গবন্ধুর এত বড় ছবি ড্রয়িং রুমে রেখেছেন? আমার এখনও মনে আছে তাজউদ্দীন চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি লাইন বললেন, ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই।’ তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, আমার রাজনৈতিক জীবনের সবটাই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে কাটিয়েছি। এমন একটা দিন ছিল না যেদিন তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়নি অথবা দেখা হয়নি। এই প্রথম মন্ত্রিত্ব হারানোর পর কালেভদ্রে তার সঙ্গে দেখা হয় অথবা কথা হয়। তাই এই ছবিটা কাছে রাখি। আমাদের সংগ্রামের দিনগুলো স্মরণ করি। ক্ষমতা আমাদের পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সেদিন তার সেই ভারাক্রান্ত চোখ মুখ দেখে কি কারও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইতেন? আমার স্পষ্ট মনে আছে, বাংলাদেশে যখন সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ছিটকে পড়া নকশালপন্থী এবং তাদের নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি ভয়ানক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এবং অন্যদিকে দুর্নীতিবাজদের তা-বে মানুষ সন্ত্রস্ত, তখন একদিন বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি গণভবনে গিয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন মুখোমুখি বসে আছেন। আমি শুনলাম বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনকে বলছেন তাজউদ্দীন তুমি আবার ফিরে আসো। তুমি সরকার চালাও। আমি এদের বিরুদ্ধে লাল ঘোড়া দাবড়াব। তাজউদ্দীন মৃদু হেসে বললেন, সময় হলে ডাক দেবেন, আমি আসব। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শের ওপর কতটা নির্ভরশীল ছিলেন তার একটা উদাহরণ দেই। তাজউদ্দীন তখন মন্ত্রী নন। ছাত্রলীগে শেখ মনি ও সিরাজুল আলমের গ্রুপের বিবাদে চূড়ান্ত ভাঙ্গন ধরেছে। দুই ছাত্রলীগ একই দিনে একই সময় দুই স্থানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সম্মেলন আহ্বান করে এবং বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি বলে ঘোষণা করে। আমি যথারীতি ৩২ নম্বরে গেছি। আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, বলতো চৌধুরী এখন কি করি? দুই ছাত্রলীগই আমাকে তাদের সম্মেলন উদ্বোধন করার জন্য ডেকেছে। আমি এখন কি করি? পরামর্শের জন্য তাজউদ্দীনকে ডেকে পাঠিয়েছি। দেখলাম বঙ্গবন্ধু বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, তার গায়ে দীর্ঘহাতা পাঞ্জাবি। ওপরে কালো মুজিব কোট। হাতে পাইপ। বললাম, মুজিব ভাই, আপনার দুই ছাত্রলীগের সম্মেলনেই যাওয়া উচিত। ওদের মধ্যে ঐক্য নেই কিন্তু আপনি এখনও ওদের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক। আপনাকে কেন্দ্র করেই ওরা আবার ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। বঙ্গবন্ধু কিছু বলার আগেই তাজউদ্দীন ভাই ঘরে এসে ঢুকলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি ঠিক সময় মতো এসেছো। ছাত্র লীগের দুই অংশই আমাকে ডেকেছে। এখন কি করি? গাফ্ফার বলছে আমার দুই সম্মেলনেই যাওয়া উচিত। তুমি কি বলো? তাজউদ্দীন দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, না, আপনি শেখ মনির ছাত্রলীগের অধিবেশনেই যাবেন। ওদের সম্মেলনেই যাবেন। লীডার আপনাকে ডিসাইসিভ হতে হবে। যে সিরাজুল আলমের গোষ্ঠী দেশে সঠিকভাবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হতেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দেয়, তারা ধ্বংসাত্মক শক্তি। এদের প্রশ্রয় দেয়া আপনার পক্ষে ঠিক হবে না। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমার পরামর্শই মেনে নিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তাজউদ্দীনের কাছে হেরে গেলে। আমি বলেছি, তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে হেরে যেতে আমি সব সময় প্রস্তুত। কিন্তু আমি এখনও মনে করি বঙ্গবন্ধু যদি ছাত্রলীগের এক অংশের সম্মেলনে না গিয়ে দুই অংশের সম্মেলনেই যেতেন তাহলে জাসদ তৈরি হতো না। সিরাজুল আলম খানের অবাস্তব বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব যুব সমাজের একাংশকে মাতিয়ে তুলত না এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি তৈরিতে জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল না জেনে ফ্যাসিবাদীদের চক্রান্তে নিজেদের অজান্তে পা ঢোকাতো না। ডালিম-ফারুকের দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে আর ট্যাঙ্কের ওপর দাঁড়িয়ে নেচেছে জাসদের নেতা। আমি এ প্রসঙ্গ এ জন্যই টানলাম যে, তাজউদ্দীন যখন মন্ত্রী নন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বিবাদের নানা গল্প বাজারে ছড়ানো হচ্ছে, তখনও তাদের মধ্যে কতটা বন্ধুত্ব ছিল, বঙ্গবন্ধু তার পরামর্শের ওপর কতটা নির্ভর করতেন তা দেখানো। [শেষ অংশ আগামী বুধবার] লন্ডন, ১১ আগস্ট, মঙ্গলবার, ২০২০ ॥
×