ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা ॥ প্রেরণায় বঙ্গমাতা

প্রকাশিত: ২০:০৫, ৮ আগস্ট ২০২০

শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা ॥ প্রেরণায় বঙ্গমাতা

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব; তিনি বিপ্লবী মিছিলে নেতৃত্ব দেননি! তখনকার প্রেক্ষাপটে হয়ত এমন দৃশ্য কল্পনারও বাইরে। তিনি মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরিবাঈয়ের মতো কোন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেননি। জওহর লাল নেহরুর ধর্মপত্নী কমলা নেহরুকেও রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারেননি। তবে শেখ ফজিলাতুন্নেছা আড়ালে থেকে তার গার্হস্থ্য জীবনের কর্তব্য পালন আর মন-মস্তিষ্কে স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগিতা করে গেছেন আজীবন। খোকা থেকে শেখ মুজিব। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু। আবার বঙ্গবন্ধু থেকে আমরা পেয়েছি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। এর পেছনে সলতের মতো জ্বেলে জ্বেলে আজীবন স্বামীকে সাহস জুগিয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, দিয়েছেন অনুপ্রেরণা ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও- যা অনস্বীকার্য। পড়াশোনায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বড় ডিগ্রীধারী নন, কিন্তু মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে বিশাল বড় হৃদয়ের অধিকারী। দলীয় কর্মী অথবা সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ, তার কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ কখনও খালি হাতে ফেরত গেছেন এমনটা কখনও শোনা যায়নি। তিনি ছিলেন সূক্ষ্ম প্রতিভাসম্পন্ন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল একজন নারী। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লেখার ক্ষেত্রেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তার। শেখ মুজিব তার আত্মজীবনীতেও সহধর্মিণীর সেই অবদানের কথা স্মরণও করেছেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে বঙ্গমাতা পরিবারও সামলেছেন বেশ গুছিয়ে। সবকিছুর পরও তিনিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের রাজনীতির শ্রেষ্ঠ ছায়াসঙ্গী। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই সর্বাত্মক দিয়ে আওয়ামী লীগ ও নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছেন তিনি। আন্দোলনের সময়ও তিনি প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় দেখা করার সময় বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ শুনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের তা জানাতেন বেগম মুজিব। অন্যদিকে কারাগারে সাক্ষাত করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেও সহায়তা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে তখন বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচী সফলের ক্ষেত্রেও তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কলকাতায় অবস্থানকালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত স্বামী শেখ মুজিবের যখনই অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো তখনই পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় পাঠিয়ে দিতেন মহীয়সী এই নারী। আর বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় নিজের ঘরের আসবাবপত্র, অলঙ্কার বিক্রি করেও দল ও নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন তিনি। তাঁর বাড়িতে কোন বিলাসী আসবাবপত্র ছিল না, মনে ছিল না কোন অহংবোধ। তাঁর সদয় আচরণ ও বিনয়ে মুগ্ধ ছিল সবাই। সন্তানদের যেমন ভালবেসেছেন তেমন শাসনও করেছেন এই মমতাময়ী মা। পালন করে গেছেন পিতা-মাতা উভয়েরই কর্তব্য। কোমলে কঠোরে মিশ্রিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সাহসী নারী স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলেন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ বাঙালী সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য এবং পদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা করে পাকিস্তান সরকার। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে তিনিসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি দাবিতে রাস্তায় নামে বাঙালী জনতা। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা সংস্থা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও গ্রেফতারের হুমকি দেয়। কিন্তু তিনি বিচলিত না হয়ে তাঁর তীক্ষè বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মামলাটি আইনীভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে আইনজীবীদের পরামর্শ ও অর্থ জোগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে পিছু হটে আইয়ুব খানের সরকার। ওই সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। কিন্তু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বেঁকে বসেন বেগম মুজিব। এ বিষয়ে তার জোরালো আপত্তি। পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে বেগম মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন- প্যারোলে নয়, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। প্যারোলে মুক্তি না নেয়া নিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব তখন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য। ওই বছরই ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন বেগম মুজিব। তারা ওঠেন ঢাকার গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনের একটি বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হলে সরকারী বাসা পান, তারা ওঠেন মিন্টো রোডের সরকারী বাড়িতে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিলে অল্পদিনের নোটিসেই ছাড়তে হয় সেই বাড়ি। শুধু ওই ঘটনাই নয়। এ রকম অনেকবার বাসা পাল্টাতে হয়েছে তাদের। এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাড়ি করেন বঙ্গবন্ধু। এটি ছিল জাতির পিতা ও বঙ্গমাতার প্রিয় বাড়ি। এই বাড়ি নির্মাণেও বঙ্গমাতার অনেক কষ্ট ও শ্রম জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর নিজেদের বাড়িতে ওঠেন তারা। এরপর এই বাড়িটিই হয়ে ওঠে নেতাকর্মীদের আপন ঠিকানা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকেই পরিচালিত হয়েছে দলীয় ও মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনামূলক নানা কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময় এই বাড়িতে বঙ্গমাতার কাছে ছুটে আসা নেতাকর্মীদের শুধু বুদ্ধি-পরামর্শই নয়, যার যেমন প্রয়োজন সাধ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বঙ্গমাতার বুদ্ধিমত্তার ছাপ। ওইদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে গত বছর বঙ্গমাতার জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চ ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে! সবাই এসেছে- এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আব্বাকে সোজা বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, জেল খেটেছ। তুমি জানো- কী বলতে হবে, মানুষ কী শুনতে চায়? তোমার মনে যে কথা আসবে, সে কথাই বলবা। আজ এই ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনেও বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এই সময়টায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেকটা বন্দিদশায় কেটেছে তার। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর সেখান থেকেই লন্ডনে যান। এরপর ওখান থেকে প্রিয়তমা, অনুপ্রেরণাদায়ী শেখ ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে প্রথম কথা হয় শেখ মুজিবের। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এবার স্বামীর সঙ্গে শুরু হয় তার দেশ গড়ার কাজ। যুদ্ধবিধ্বস্ত জন্মভূমিকে শস্য-শ্যামলারূপে গড়ে তুলতে জাতির পিতার পাশে দাঁড়ান বঙ্গমাতা। এ ছাড়া অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে তিনি তাদের সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবন দেন। আন্তÍর্জাতিকভাবে দেশকে তুলে ধরতেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অবদান রেখেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর বেশ ভাল সখ্যতা ছিল। বিশ্ব নেতারা বাংলাদেশ সফরে এলেও বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকতেন অসম্ভব প্রাণশক্তিতে বলীয়ান এই মহীয়সী নারী। সহধর্মিণী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন। বঙ্গমাতার আদর্শে গড়ে উঠুক এদেশের নারীরা। তার আদর্শে আপন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত হোক বাংলাদেশ। ৯১তম জন্মদিনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি পরম শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখক : শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেলান্দহ, জামালপুর [email protected].
×