ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্যোগে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও অন্যরা

প্রকাশিত: ২০:০২, ৮ জুলাই ২০২০

দুর্যোগে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও অন্যরা

সমগ্র বিশ্বে কোভিড-১৯ মহামারীরূপে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। কবে নাগাদ এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন অবিষ্কার হবে অথবা এই মহামারীর অবসান হবে তা বলা দুষ্কর। সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য বা আশার বাণী গবেষক বা বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। অর্থাৎ কোভিড-১৯ নিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসী একটা অনিশ্চতার মধ্যেই আছে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরূপভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বেকার হয়ে পড়ছেন বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষ। বাংলাদেশের অবস্থাও তদ্রুপ, ছাঁটাই হচ্ছেন অনেক প্রাইভেট কোম্পানির লোকজন, ফলে তাদের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে। সোজাকথা মহামারী এখন আতঙ্কের আরেক নাম; একটি ভয়ানক শব্দ হিসেবে মানুষের কানে বাজছে। চলতি বছরের মহামারী কতটা ভয়ানক এবং আতঙ্কের তা বিগত কয়েকমাসের হিং¯্রতায় উপলব্ধি করতে পেরেছেন বিশ্ববাসী। মহামারীর নাম শুনলে বাংলাদেশের মানুষের তুলনায় বিশ্ববাসী খুববেশি আতঙ্কিত হচ্ছেন এখন। তার কারণ হচ্ছে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে মৃত্যু এবং সংক্রমণের হার অনেকটাই কম। শুধু বাংলাদেশই নয়, উপমহাদেশীয় অঞ্চলে মোটামুটি এর প্রাদুর্ভাব খানিকটা কম বলা যেতে পারে। তবে উপমহাদেশীয় অঞ্চলের লোকজন মহামারীর চেয়ে বেশি আতঙ্কিত হচ্ছেন এখন খাদ্যসঙ্কট নিয়ে। শুধু তাই নয়, সামনে দুর্ভিক্ষের হাতছানি টের পাচ্ছেন উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মানুষ। কারণ এতদঅঞ্চলের মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, মহামারীর মোকাবেলায় যেখানে ধনী দেশ হিমশিম খাচ্ছে সেখানে স্বল্পোন্নোত বা উন্নয়নশীল অথবা দরিদ্র দেশের পরিণাম কি হতে পারে! তবে সত্যি কথা বলতে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেও করোনাকালের দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই বরং হিম্মত দেখিয়ে আসছে। আমরা দেখেছি, সরকার হতদরিদ্রদের বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী চালু করেছেন কয়েকভাবেই। সেটি হচ্ছে ভিজিএফ এবং ওএমএস। যার মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে সরকার। উল্লেখ্য, কয়েক ভাগেই ভাগ করা হয়েছে উক্ত খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীকে। হতদরিদ্রের জন্য ভিজিএফ অপরদিকে যারা একটু সচ্ছল তাদের জন্য স্বল্পমূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে প্রকল্পটি আমাদের কাছে ওএমএস নামে পরিচিত। ওএমএস বা টিসিবি নামের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী চালুর ফলে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন, এটি সত্য। কিন্তু সেই দরিদ্রকল্যাণমুখী প্রকল্পটিকে বন্ধ করে দিতে সরকারকে বাধ্য করেছেন কিছু মানুষ নামধারী পিশাচের কর্মকান্ডে। সেই খাদ্যশস্য এখন রেশনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষ প্রণোদনা দেওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেয়া, রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়াসহ করোনা সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। মহামারী মোকাবেলায় বা সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিশেষ করে সেনা, বিজিবি, পুলিশ, ডাক্তার ও পৌরসভা-সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োজিত করেছেন সরকার। সম্পৃক্ত করেছে জনপ্রতিনিধিদেরও। অর্থাৎ যাকে যেখানে যেভাবে প্রয়োজন সেই আঙ্গিকে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। সেই ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি সরকার সেবাদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মৃত্যু এবং রোগাক্রান্তের জন্য বিশেষ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও রেখেছে। ফলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা আরও উজ্জীবিত হয়েছেন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে। জীবনবাজি রেখে অনেকে করোনাক্রান্তদের পাশে এগিয়ে যাচ্ছেন। পিছিয়ে নেই জনপ্রতিনিধিরা, পিছিয়ে নেই সম্পদশালীরাও। আমরা দেখেছি সরকারের পাশাপাশি দেশের বিত্তবান কিংবা পাড়া-মহল্লার সম্পদশালীরা সাধ্যানুযায়ী ত্রাণ বিতরণ করে যাচ্ছেন। তার মধ্যে দৃষ্টান্ত রেখেছেন একজন ভিক্ষুকও। তিনি ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে উপার্জনকৃত জমানো ১০ হাজার টাকা দান করে আলোচিত এবং আলোকিত মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সমাজের বিত্তবানদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন একজন খ্যাত মানুষ হলেও তথাকথিত সাদামনের মানুষদের চেয়েও মানসিকতায় তিনি উর্ধে। ভাবতেই অবাক লাগছে, তিনি নিজের ঘর মেরামত করার জন্য জমানো অর্থকড়ি মানবকল্যাণে দান করেছেন, সশ্রদ্ধ সালাম এই মানুষটিকে তাই। পাশাপাশি আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি প্রধানমন্ত্রীকেও, যিনি মানবসেবার স্বীকৃতিদানে কৃপণতা দেখাননি। এলাকার তরুণদেরকেও দেখা যাচ্ছে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকলেও তারা নিজ উদ্যোগে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। যেটি দৃষ্টান্তের মধ্যে পড়ে। আবার এমনও দেখা গেছে করোনাক্রান্ত মা-বাবাকে রাস্তায়, হাসপাতালে কিংবা বনজঙ্গলে ফেলে রেখে পালিয়েছেন সন্তান। এই মানুষের সংখ্যা যৎসামান্য হলেও এরা আরেক তালিকার মধ্যে পড়ে। অবশ্য এ সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু একেবারেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেননি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। আমরা দেখেছি স্বজনরা করোনাক্রান্ত মৃতব্যক্তিকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে গেলেও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ঠিকই দাফনের ব্যবস্থা করেছেন। এটি সম্ভব হয়েছে শুধু সরকারের দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণেই। করোনাকালীন আমরা দেখেছি ডাক্তার-নার্সদের ভূমিকাও। সম্মুখ থেকেই সেবা দিচ্ছেন তারা। সেবা দিতে গিয়ে নিজেরাও করোনাক্রান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ সুস্থ হলেও প্রায় অর্ধশত চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন। ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে করোনাক্রান্ত হয়ে পৌরসভা-সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী এবং জনপ্রতিনিধিরাও প্রাণ হারিয়েছেন। সেনা-পুলিশের ভূমিকাও প্রশংসনীয়। মহামারীর মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের অনেকেই। করোনাক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানো দেশের সকল বীর যোদ্ধার প্রতি রইল আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম। পাশাপাশি আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি যারা ত্রাণসামগ্রী হরিলুট অথবা চুরি করেছে। এখন কথা হচ্ছে, প্রণোদনা এবং ক্ষতিপূরণ নিয়ে। যার অনিয়ম নিয়েও কিছু কিছু কথা আমাদের কানে আসছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া। বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই না করতে পারলে অর্থ মন্ত্রণালয় বেকায়দায় পড়ে যাবে। কাজেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজেরাই উদ্যোগী হবেন যাচাই-বাছাই করতে এটি আমাদের পরামর্শ। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যেহেতু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন, অর্থাৎ ডাক্তার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তেমনি পৌরসভা-সিটি কর্পোরেশনও ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে সেবা প্রদান করছেন। এখানে যেন বিভেদ সৃষ্টি না হয়। সবাইকে যেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবেই অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেটি সরকার মনে রাখবেন। এই ক্ষেত্রে যেন ভাবা না হয়, এই বিভাগ রাজস্ব আর এই বিভাগ আধা-শ্বায়ত্তশাসিত। তাহলে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, সেবার গতিও হ্রাস পাবে। কে কোন সংস্থার লোক সেটি না খুঁজে বরং কে সরকারের নির্দেশে সেবা দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন আর কে করোনাক্রান্ত হয়েছেন সেটি নিরূপণ করে ব্যবস্থা নিবেন। তাহলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পাশাপাশি সেবাদানের গতি বাড়বে বৈ কমবে না। লেখক : কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ
×