ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় এক মাসে ২১ ব্যাংকের বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ৫ এপ্রিল ২০২০

করোনায় এক মাসে ২১ ব্যাংকের বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অতিমারী করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে সারাবিশ্বের পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও। করোনা পরবর্তী বিশ্বের পুঁজিবাজার কেমন যাবে এমন আশঙ্কায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির হারও বাড়িয়েছেন। এটির প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতেরই। যদিও বিগত কয়েক বছর ধরেই দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের প্রভাবে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে সূচক, লেনদেন, বাজার মূলধন ও বিও হিসাবের পাশাপাশি বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আশঙ্কাহারে কমেছে। তবে করোনার প্রভাবে শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক পতন ঠেকাতে গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কোম্পানিগুলোর শেয়ার ও ইউনিট দরের সার্কিট ব্রেকারের ফ্লোর প্রাইসের (যে দরের নিচে নামতে পারবে না) সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেয়া পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা। দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেই পুঁজিবাজার আবারও চাঙ্গা হবে এমনটাই প্রত্যাশা বিনিয়োগকারীদের। এদিকে দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা অবস্থা বিরাজ করায় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকেই এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ কমাতে শুরু করেছেন বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারী। এ সময়ের মধ্যে তিন-চার মাস ছাড়া অধিকাংশ সময়েই বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের পুঁজিবাজার করোনা আক্রান্ত। এই পরিস্থিতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের গতিবিধি অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য বলে মনে করছেন অনেকেই। পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় ২০১৯ সালে ব্যাংক খাতসহ অধিকাংশ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংক খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ স্থিতিশীল রেখেছিলেন বিদেশীরা। দীর্ঘ মন্দা পরিস্থিতি বিরাজের পর বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পরিবর্তে স্থিতিশীল হওয়া পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাবে সারাবিশ্বে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়ায় ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকহারে কমেছে। বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৩০টি। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক বাদে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ২৯টি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকহারে কমেছে। ডিএসই ও সিএসইতে এ খাতে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ২১টিতে, বিনিয়োগ স্থিতিশীল রয়েছে ৫টিতে এবং বিনিয়োগ নেই ৪টিতে। আর সিএসইতে বিদেশী বিনিয়োগ নেই ৩টি ব্যাংকে। সে হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ব্যাংকের শেয়ারেও বিদেশী বিনিয়োগ বাড়েনি, বরং কমেছে। এর আগে জানুয়ারি মাসে পুঁজিবাজারে ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ স্থিতিশীল ছিল ১৩টিতে, বিনিয়োগ বেড়েছিল ৪টিতে, বিনিয়োগ কমেছিল ৮টিতে এবং বিনিয়োগ নেই ৩টি ব্যাংকে। জানুয়ারি মাসের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেনি ২টি ব্যাংক। সেই হিসেবে জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকহারে কমেছে। বিশেষ করে জানুয়ারিতে ৪টি ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লে, ফেব্রুয়ারিতে একটিও নেই। আর জানুয়ারিতে ১০টি ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ স্থিতিশীল থাকলেও, ফেব্রুয়ারিতে তা ৫টিতে নেমে এসেছে। আর জানুয়ারিতে ৩টি ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল না। তবে ফেব্রুয়ারিতে তা আরও বেড়ে ৪টিতে দাঁড়িয়েছে। দেশের পুঁজিবাজারে মূলভিত্তি সম্পন্ন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক খাতকে গণ্য করা হয়ে থাকে। সে হিসেবে এ খাতে বিনিয়োগ তুলনামূলক ঝুঁকি কম। কিন্তু ২০১০ সালে মহাধসের পর থেকেই এ খাতের কোম্পানিগুলো থেকে বিমুখ রয়েছেন সব বিনিয়োগকারী। এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় দেশে পোর্টফোলিও বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না বিদেশীরা। তারা হয়তো বিনিয়োগের আরও ভাল জায়গা খুঁজচ্ছেন। বর্তমানে পরিস্থিতিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা দিশেহারা। ফলে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরেই আমাদের পুঁজিবাজারে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে করোনার প্রভাব বিরাজ করছে। সেই হিসেবে বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হলেই আবার বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করছি। ডিএসইর ওয়েবসাইট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.২৫ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ২.৬১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৩৬ শতাংশে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.৬৯ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৪৩.৯২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩.২৩ শতাংশে। সিটি ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.০৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৯.৫৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৫৪ শতাংশে। ইস্টার্ন ব্যাংকে (ইবিএল) বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.০৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ০.৪০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ০.৩২ শতাংশে। এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংকে (এক্সিম) বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.১১ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৩.৫৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৪৮ শতাংশে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.১৬ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৪.২৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ৪.০৮ শতাংশে। আইএফআইসি ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.০২ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১.০২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ১ শতাংশে। ইসলামী ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.০৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ২৩.৫৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.৫৪ শতাংশে। যমুনা ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.১৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১.৮২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ১.৬৯ শতাংশে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.১০ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৫.৫৬ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৪৬ শতাংশে। ন্যাশনাল ব্যাংকের বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.১৮ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১.৮৩ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৬৫ শতাংশে। ন্যাশনাল ক্রেডিট এ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংকে (এনসিসি) বিনিয়োগ কমেছে ০.১১ শতাংশ। জানুয়ারিতে মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১.২২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.১১ শতাংশে। ওয়ান ব্যাংকে বিনিয়োগ কমেছে ০.৫৪ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৩.২৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৭০ শতাংশে। প্রিমিয়ার ব্যাংকে বিনিয়োগ কমেছে ০.৩৬ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৪.৬৩ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.২৭ শতাংশে। প্রাইম ব্যাংকে বিনিয়োগ কমেছে ০.০১ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৩.৫২ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৫১ শতাংশে। পূবালী ব্যাংকে বিনিয়োগ কমেছে ০.০৪ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ০.৭৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ০.৭১ শতাংশে। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.০৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ০.৩০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ০.২৬ শতাংশে। সাউথইস্ট ব্যাংকের বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.১২ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৫.২৭ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.১৫ শতাংশে। ট্রাস্ট ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.০৫ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১.১১ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.০৬ শতাংশে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.১২ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১.৪০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.২৮ শতাংশ। উত্তরা ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ০.১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ২.৯৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৮১ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারির মতোই ফেব্রুয়ারিতে বিনিয়োগ স্থিতিশীল রয়েছে এবি ব্যাংকে ১.০৩ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ায় ০.৩৭ শতাংশ, ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ০.০২ শতাংশ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে ১.৩৮ শতাংশ ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ১.২৬ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। আর বিদেশী বিনিয়োগ না থাকা ব্যাংকগুলো হলো : ঢাকা ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক।
×