ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বর্ণার স্বর্ণালি স্বপ্ন...

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ১৪ মার্চ ২০২০

স্বর্ণার স্বর্ণালি স্বপ্ন...

রুমেল খান ॥ ফাল্গুনের শেষ দিবস। শুক্রবারের পড়ন্ত বিকেল। কমলাপুর স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে (প্রেসবক্স না বলে ধ্বংসস্তূপ বলাই শ্রেয়, কারণ প্রেসবক্সে পুনঃনির্মাণের কাজ চলছে) প্লাস্টিকের গোটাকয়েক চেয়ার। তারই দুটিতে বসে মহিলা ফুটবল লীগের খেলা গভীর মনোযোগ সহকারে দেখছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন এবং সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু। মাঠে খেলছে স্পার্টান এমকে গ্যালাক্টিকো সিলেট এফসি বনাম বেগম আনোয়ারা স্পোর্টিং ক্লাব। খেলার বিরতির সময় দেখা গেল দুই দলের ফুটবলাররা নিজেদের ডাগআউটের সামনে গা এলিয়ে দিয়ে এ্যাস্ট্রো টার্ফের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ খাচ্ছেন। আনোয়ারার ২০ নম্বর জার্সিধারী এক খেলোয়াড়কে দেখা গেল পায়ে বরফ লাগিয়ে ঘষতে। কিন্তু পা থেকে বুট খোলেনি সে। ডাগআউট খেকে প্রেসবক্সের দূরত্ব খুবই কম। ডাক দিলেই শোনা যাবে। ছোটন হাঁক দিলেন, ‘ওই স্বর্ণা, বুট খুলে তারপর পায়ে বরফ ঘষ।’ এই প্রতিবেদককে জানালেন, ‘এই মেয়েটিকে চিনে রাখুন। বয়স খুবই কম। আমার জানামতে, এই লীগের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার। যদিও আমাদের বাফুফের ক্যাম্পের কেউ নয় তবে ওর খেলা আগেই দেখেছি বেশ ভাল খেলে।’ খেলা শেষে কাছে গিয়ে পরখ করতেই ছোটনের কথার সত্যতা পাওয়া গেল। ভেবে বেশ অবাক হতে হলো, এত কম বয়সে সে এত সাবলীল ফুটবল খেলছে কিভাবে। স্বর্ণা আখতার। বয়স মাত্র ১১। প্রাইমারী স্কুলের গ-ি পেরিয়ে এ বছর পা রেখেছে হাইস্কুলে (ক্লাস সিক্সে)। কিশোরগঞ্জের জাফরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। স্বর্ণার বাবা আনোয়ার হোসেন ফারুক ঢাকার গুলিস্তানে একটি ইলেকট্রিক্যাল দোকানে ভ্যানগাড়ির মালামাল বহন ও ডেলিভারি করে সংসার চালান। মা আয়েশা আখতার গৃহিণী। স্বর্ণারা ২ বোন, ১ ভাই। স্বর্ণা সবার ছোট। স্বর্ণা বাদে সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। স্বর্ণার ফুটবলে আসার গল্পটা এ রকমÑ ‘গ্রামে আমাদের পাশের বাড়ির প্রতিবেশী এক কবির চাচা (আপন নয়) আছেন। ওনার কাছে একটা ফুটা বল (চুপসে যাওয়া) ছিল। ওটা দিয়ে আমি খেলতাম। তখন পড়ি মাত্র ক্লাস টুতে। একদিন আমার আব্বা আমার খেলা দেখে বলল, প্রাইমারী স্কুলে মেয়েদের ফুটবল খেলা হবে। আমি যেন তাতে নাম দিই। এভাবেই ফুটবলে আসা।’ ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল খেলার অভিজ্ঞতা আছে স্বর্ণার। জেলা পর্যায়ে সে খেলেছে ঢাকার কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম এবং বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। চতুর্থ রাউন্ডে গিয়ে স্বর্ণার স্কুল টাঙ্গাইলের একটি স্কুলের কাছে হেরে বিদায় নেয়। ওই পর্বে একটি দৃষ্টিনন্দন গোল করেছিল স্বর্ণা। ওই আসরে স্ট্রাইকার পজিশনে খেললেও এবারের মহিলা ফুটবল লীগে বেগম আনোয়ারা স্পোর্টিং ক্লাবে লেফট উইঙ্গার পজিশনে খেলছে স্বর্ণা। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘পজিশন ভিন্ন হলেও খেলতে আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না। বেশ ভালমতোই মানিয়ে নিয়েছি।’ ভবিষ্যত লক্ষ্য কী? স্বর্ণার জবাব, ‘আমার বাবা চান আমি যেন পুলিশে চাকরি করি। আমার ইচ্ছা চাকরি করার পাশাপাশি ফুটবল খেলাটাও চালিয়ে যাওয়া। স্বর্ণার প্রিয় খেলোয়াড় মারিয়া মান্দা এবং লিওনেল মেসি। প্রথমজনের সঙ্গে এই লীগে খেলেছে স্বর্ণা। তবে এখনও কোন কথা হয়নি। ভবিষ্যতে মারিয়া মান্দার মতো জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখে স্বর্ণা। এ জন্য যত পরিশ্রম বা কষ্ট করতে হয় তা করতে কোন আপত্তি নেই তার। এই লীগের প্রতিটি খেলা স্টেডিয়ামে এসে দেখছেন জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। কেউ ভাল খেললে তার নাম ও জার্সি নম্বর নিজের খাতায় টুকে রাখেন তিনি। উদ্দেশ্য- লীগ শেষে ওই খেলোয়াড়কে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাকা। এই লীগে ভাল পারফর্মেন্স করে কোচ ছোটনের গুডবুকে নিজের নাম এন্ট্রি করাতে চায় স্বর্ণা। এই লীগে এ পর্যন্ত ৩টি ম্যাচ খেলেছে স্বর্ণা। এখনও কোন গোল পায়নি অবশ্য। লীগে কতটি গোল করতে চাও- এই প্রশ্নের জবাবে তার ভাষ্য, ‘তেমন কোন লক্ষ্য নেই। তবে ভাল খেলতে চাই এবং প্রতি ম্যাচে গোল করতে চাই।’
×