ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ আঙ্গুল

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ৬ মার্চ ২০২০

গল্প ॥ আঙ্গুল

মাথায় ঝাকড়া চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকটা আমাদের হাই ফকির। ছোটবেলায় তাকে ঘিরে অজস্র মধ্যবয়সী মহিলাকে দেখেছি। আমরা ছোট বলে তার বেড়া ডিঙিয়ে অনেক সময় শিশুসুলভ কৌতূহল নিয়ে তার ঢেরার ভেতর ঢুকে গেছি। কাউকে তেমন কোন সম্ভাবনাময় যৌনতা কিংবা অশালীনতায় দেখিনি। তবু মনের ভেতর একটা তৃষ্ণা ছিল, যদি দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামের মুরুব্বিদের বিশ্বাস ছিল, হাই ফকির মহিলাদের শিষ্য বানানোর নামে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়। তার ঢেরা বা আস্তানা গুড়িয়ে দিতে হবে- এমন হুংকারে প্রায় শুক্রবারেই মসজিদ গরম হতো। আমাদের মসজিদের ইমাম খুব কড়া ছিলেন। কেউ নামাজে না এলে তাকে ঘাড় ধরে মসজিদে নিয়ে আসতেন। কিন্তু একদিন তাকে মসজিদ ছাড়তে হয়েছিল, নাবালিকা মেয়েকে দিয়ে শরীর টেপার অভিযোগে। আমরা এর বেশি কিছু জানতে পারিনি। তবে ওই ইমাম চলে যাওয়ায় আমরা যারা নামাজ-কালাম পড়ি না, তারা বেশি খুশি হয়েছিলাম। যাক বাবা, এখন থেকে টঙের দোকানে বসে আরাম করে শাহিন আলমের ছবি দেখতে পারব। হঠাৎ মসজিদের মাইকে নতুন কণ্ঠস্বরে ঘোষিত এক ঘোষণার আওয়াজ পথ ভুল করে ঢুকে পড়া এক অর্বাচীন পথিকের মতো আমাদের কানে বাজতেই বুঝতে পারি, না মসজিদে নতুন ইমামের আগমন ঘটেছে। আমরা যারা টঙের দোকানে বসে শাহিন আলমের ছবি দেখার লোভে লাল চায়ের নোংরা কাপে চুমুক দিতাম উদাম নায়িকার গতর মনে করে, তারা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকি। একি! ওই ইমামও আবার আমাদের ধরে ধরে মসজিদে নিয়ে যাবে না তো? কিন্তু না, সে রকম কোন সমস্যায় পড়িনি। ওই ইমাম সাহেব চা-পায়ী ছিলেন। আসরের নামাজ শেষে এক কাপ চা না গিললে তার পেটের ভাত হজম হতো না বলেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম। লোকটা সুরুত সুরুত করে চায়ের কাপে চুমুক দিতেন। যখনই হুজুর দোকানের দিকে আসতে থাকতেন, তখনই আমাদের দর্শকদের মধ্যে কেউ গলা খাকড়ি দিয়ে দোকান মালিক মানিক মিয়াকে জানিয়ে দিত, হুজুর আসছে। তখনই সুনসান নীরবতা নেমে আসত মানিক মিয়ার ভাই ভাই স্টোরে। যদিও মানিক মিয়ার দোকানের নাম, ভাই ভাই স্টোর। কোনদিন দেখিনি তার ভাই, রতনের সঙ্গে মানিকের কোনরূপ ভাল সম্পর্ক। এই দুই ভাইয়ের মধ্যে শত্রুতা এবং রেষারেষি ছাড়া আর কিছু ছিল বলে আমাদের মনে পড়ে না। তবু বিচিত্র কারণে দোকানের নাম ফলকে অকারণেই অভ্যাসবশত জ্বলজ্বল করত ‘ভাই ভাই স্টোর।’ ইমাম সাহেব আমাদেরকে জ্বালাতন করতেন না। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেয়ার আগে কেবল বলতেন, ‘মেয়া ভাইয়েরা, খালি টিভি দেখলে চলত না। মসজিদে আইসেন।’ আমরা শবে বরাত, শবে কদর ছাড়া মসজিদের দিকে পা বাড়াতাম না। তবু কেউ যদি খাসি কেটে মসজিদে শিরনি দিত, এমন সংবাদ পেলেই আমরা নির্বিকারভাবে মসজিদে গিয়ে সুড়সুড় করে ঢুকে পড়তাম। যেহেতু আমরা নিয়মিত মুসল্লি ছিলাম না, তাই আমাদের নামাজ পড়বার তেমন গোছানো প্রস্তুতি থাকত না। সবার পাঞ্জাবি ছিল না। কেউ এক ঈদের পাঞ্জাবি পাঁচ বছর ধরে চালিয়ে দিত। টুপির অবস্থাও সে রকম ছিল, আমাদের ঘরের মেঝের মতো- ইঁদুরে খাওয়া। সেসবে আমাদের ভ্রুক্ষেপ ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল কেবল শিরনি খাওয়া। আমাদের মতো অনাহুত এই বিশেষ মুসল্লি সমাজ নিয়ে অনেক নিয়মিত মুসল্লির কোন বিকার ছিল না। তারা ধরেই নিত- এরা খাইতে এসেছে। আবার বেশিরভাগ মুসল্লিই টিপ্পনি কেটে বলত, ‘কী? আইয়া পড়ছস শিরনি খাইতে?’ আমাদের প্রতি সবচেয়ে বেশি বিরক্ত ছিলেন মসজিদ সভাপতি গোলাপ মেম্বার। আমাদের দেখলেই তিনি রাগে গজ গজ করতেন। বিড়বিড় করে বলতেন, ‘ফকিরের বাচ্চারা, খাওনের গন্ধ পাইলেই মসজিদে আইসা পড়ে।’ আমরা কেউ ব্যাপারটাকে আমলে নিতাম না। যেন শুনিইনি এমন ভাব করতাম। আমাদের তেমন কোন পেশা ছিল না। স্কুলে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আমাদের বাবারা বেশিরভাগই পরের খেতে কামলা দিত। কোমড়ের কাইতনে লুঙ্গি গুঁজতে পারলেই আমাদের হাতে দুধ ছাড়ন্ত বকনা বাছুর কি ষাঁড় বাছুর ধরিয়ে দিত। আমাদের কাজ ছিল অনাবাদি জমির বুকে যৌবনদৃপ্ত ঘাসভূমির অরণ্যে গরু চরানো। আমরা সবাই সকাল হলেই দলবেঁধে গরু নিয়ে মাঠে যেতাম। খালপাড়ের ইদল গাছ (পরে জেনেছি তার নাম নাকি হিজল গাছ!) সেই ইদল গাছের নিচে একমাত্র ছায়াঘেরা জায়গায় বিশ্রাম নিতাম। কিংবা তীব্র রোদ ও তাপে কিলবিল করা রক্ত মাথায় উঠলে লুঙ্গিখানা খালের পাড়ে রেখে পানিতে ঝাঁপ দিতাম। যদিও সমবয়েসীদের কারটা কত বড়, কে কত দ্রুত গতিতে হিসু করে কদ্দূর নিতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা ছিল খুব সাধারণ একটা খেলার মতো। আমাদের মধ্যে কারও নষ্টামির চিন্তা ছিল না। একবার আমাদের দলের এক সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল বিলের ওপারের এক মেয়েকে নিয়ে ধানক্ষেতে ঢুকে পড়ার। কিন্তু যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তারটা দাঁড়াতোই না তখন। এমন ব্যর্থতায় সে আমাদের থেকে দূরে থাকত। পরে জানা গেছে আমাদেরই এক সদস্য, আবু শামা, মেয়েটির পাজামা খুলে শুইয়ে পড়েছিল। মেয়েটি ছিল মা মরা এক ভিক্ষুকের মেয়ে। ভর সন্ধ্যায়, যখন সব চাষা, ঘাস-কাটুরে ঘরে ফিরে এসেছিল, কুয়াশারা সেই সুযোগে আস্তে করে মাটির দিকে নামতে শুরু করলো। আর সেই নির্জন সন্ধ্যায় আবু শামা ঝোঁপ বুঝে কোপ মারল। কেউ টেরই পায়নি। বরং উত্থান অক্ষম রজব আলির নামে কী কুৎসাটাই না রটল! সেই রজব আলিকে আর কখনও মাঠে দেখিনি। এই ঘটনার পরে আমি আর মাঠে গরু চরাতে যেতাম না। হাই ফকির নাকি এক মহিলার সঙ্গে ধরা খেয়েছে। এজন্য তাকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। মসজিদের নতুন কমিটি গঠন হলে পুরাতনেরা আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে জোট বেঁধে আরেক মসজিদ গড়ে তুলেছে। তখন এক মহল্লায় দুই মসজিদ হওয়ায় প্রথম প্রথম নাকি গ্রামের মানুষের লজ্জায় মাথা কাটা গিয়েছিল বলে হা-হুতাশ করেছিল। কিন্তু আমি কোন মাতবরের কল্লা ছাড়া ধর দেখিনি, আগের চেয়ে কোন অংশেই কম ঔদ্ধত্য দেখিনি। এই ইমামও বদলি হলো। ওই ইমাম নাকি এক ছেলের লুঙ্গি খুলে ফেলেছিল। তাই তাকে বাদ দেয়া হয়। উত্তরপাড়ার গেদু চেয়ারম্যানের বাড়িতে আমাকে বছইরে কামলা হিসেবে নিয়োগ দিলে আমার জীবনে নতুন ঘটনা মোড় নেয়। তখন মাত্রই রমেশ নাপিতের দোকানে যাওয়া আসা করি। মাঝে মাঝে রাতে দেখি লুঙ্গি ভিজে যায়। ব্যাপারটা খুব নোংরা ও খারাপ মনে হতে লাগে। দিনে দেখা নায়িকারা রাতে সত্যি করে আসে কিন্তু ঘুম ভাঙলেই বুঝতে পারি, ঘটনা ঘটে গেছে। আমাদের বাড়িটা ছিল গাঁয়ের দক্ষিণপাড়ায়। উত্তরপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে কোন রকমের জানাশোনা ছিল না। যে কারণে কারও সঙ্গেই কোনরূপ বন্ধুত্ব হলো না। আরও গায়ে দাগ লেগে গেল, ‘এই ছেলে, গেদু চেয়ারম্যানের কামলা ছ্যারা।’ আমি সেখানে ব্রাত্য জন। চেয়ারম্যানের বাড়িতে আমার মতোই আরেক কাজের বেটি থাকত। মধ্যবয়স্কা। তার স্বামী তাকে তালাক দিয়েছিল সন্তান জন্ম দিতে না পারার পাপে। তার এক বৃদ্ধা মা ছাড়া কেউ ছিল না। তাই সে চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নিয়েছিল। তার সঙ্গেই আমার যত সখ্য ও ভাব বিনিময়। বুঝতে পারি, সেও আমার স্বগোত্রীয়। তাকে আমার কখনও অন্যকিছু মনে হতো না। তাকে আমার মায়ের মতোই মনে হতো। সেই বিশ্বাসেই তার কাছে একদিন গিয়ে বললাম, ‘জমিলা ফুজি, রাইত হইলে আমার কিতা জানি হয়! আমার লুঙ্গি ভিইজ্যা যায়।’ জমিলা নামক ওই কাজের মহিলা সহকর্মীর এহেন বিপদের কথা শুনে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে কয়, ‘নারে সোরাবদ্দি, তোর তো পুরুষত্ব ক্ষয় অইয়া যাইতাছে। তুই তো বিয়া করতে পারবি না।’ শুনে তো আমার মাথা নষ্ট। রজব আলিরটা দাঁড়ায় না। তাই সে বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু আমারটা তো সকাল বিকেল দাঁড়ায়। আমি কেন বিয়ে করতে পারব না! জমিলা ফুজির কাছ থেকে জানতে পারলাম একে স্বপ্নদোষ বলে। স্বপ্নদোষ হলে পুরুষ মানুষের আর কিছু থাকে না। তাই সে বিয়ে করতে পারে না। মহিলা আমাকে আরও ভড়কে দেয়, ‘এই জন্যই তো কই, আমাগো সোরাবদ্দির শইলডা ভাইঙা যাইতাছে ক্যারে?’ সেই জমিলা একদিন কবিরাজ হয়ে এলো। সে জানালো এক নাম না জানা গাছের কথা । এই গাছকে সে চেনে। সেই গাছের মূলের রস খেলে নাকি স্বপ্নদোষ সারে। আমারও মনের মধ্যে এক ধরনের বাতিক ঢুকে গেছে, -‘হায় হায়, আমার বোধহয় রজব আলির মতো খাড়ই তো না কদ্দিন পর। ‘আমি ব্যাকুলভাবে জমিলা ফুজির কাছে যাই। সে বেচারি আমাকে এক কথা দুই কথা শোনায়, ভয় দেখায়, ‘পুরুষ মানুষের ওইটা অইল আসল। ওইটা না থাকলে আসলে কোন দামই নাই।’ আমি লুঙ্গির খুট গলে নিচে হাত ঢুকিয়ে নাড়াচড়া করি। নাহ ওটা ঠিকই আছে। সাড়া দিচ্ছে। তবু তাকে সেই গাছের মূল এনে দিতে তাগাদা দিই। একদিন সে আমায় রাতের বেলায় যেতে বলে। তারপর যা ঘটে যায়, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যেহেতু আমার প্রথম কৌমার্য হারানো, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধরাশায়ী হই। জমিলা আমাকে আবার জাগিয়ে তুলবার প্রয়াসে তলপেটে হাত দেয়, মুখভরা দুর্গন্ধ নিয়ে আমার গালে, গলায চুমু খায়, ‘ভাবিস না, সোরাবদ্দি। তোর ভাল্লাগলে আমি পত্যেকদিনই আইমু। গেদু বুইড়াটার আসলে কিছু নাই। এক দুই মিনিটেই কাম সাইরা যায়। তবু শালা প্রত্যেক দিন রাইতে শহরের গাইনপাড়াত যায়।’ বুঝতে পারলাম, জমিলার সঙ্গে আমিই প্রথম না, গেদু চেয়ারম্যানও নিয়মিত তার ঘরে যায়। এখন আর আমার দক্ষিণপাড়ায় যাওয়া হয় না। আব্বার নাকি ম্যালা ঋণ। তিন লাখের উপরে। তাই সে আর গ্রামে থাকবে না। ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাবে। আমার আব্বার প্রতি কোন টান ছিল না। আব্বাকে দেখতাম, স্বাধীন বিড়ির পাছায় মুখ লাগিয়ে কী স্বাধীনভাবে ধূমপান করছে। আর রাতে মায়ের সঙ্গে ধুমসে ঝগড়া করছে। আব্বা মাকে মেরেছে, আর মা হুঁশ হারায়নি এমন দিন খুব কমই হয়েছে। মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। মা মারা গিয়েছিল আব্বার বিশ্বস্ত গামছার ফাঁসে। কিন্তু সকালবেলা গ্রামবাসী জানতে পারল, মায়ের গায়ে গরম বাতাস লেগেছে, শয়তানের বদ আছরে তার মৃত্যু হয়েছে। যদিও মায়ের মৃত্যুতে আব্বার চোখ থেকে গাভীর চনার মতো অঝোর ধারায় জল ঝরছিল সেদিন, কিন্তু তাতে কোন মায়া কিংবা মমতার লেশমাত্র ছিল না। নিদারুণ পরিহাস খেলা করছিল তার চোখেমুখে। মায়ের মৃত্যুর কদ্দিন বাদেই আব্বা আম্বিয়া ফুজিকে ঘরে তোলে। আম্বিয়া ফুজি। তার নাকি জামাইয়ের সাতে বনিবনা হতো না। তাই পোটলাপুটলি কাঁধে করে সন্ধ্যেবেলায় হাজির। সে আর কখনও তার শ্বশুরবাড়িমুখো হয়নি। মূলত তখন থেকেই শুরু। আব্বার সঙ্গে মায়ের ঝগড়া ঠিক তখন থেকেই শুরু। মায়ের ধারণা ছিল, আব্বার সঙ্গে আম্বিয়া ফুজির কিছু একটা ঘাপলা আছে। কী ঘাপলা আছে বুঝতাম না, তবে মাকে প্রায়ই দেখতাম- আব্বাহীন ঘরে আমাকে শুইয়ে রেখে আম্বিয়া ফুজির ঘরের পেছনে গিয়ে অবস্থান নিতে। একদিন টের পেয়ে আমিও মায়ের পিছু নিই। তেমন বিশেষ কিছু বুঝতাম না। কেবল ওই ঘর থেকে আব্বার আর আম্বিয়া ফুজির হাসাহাসির আওয়াজ এসেছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, তাদের মধ্যে দারুণ খুনসুটি চলছে। এনজিও থেকে নেয়া ঋণের বোঝার যে কঠিন ভার, তা আব্বার সরু-শীর্ণ কাঁধ আর বইতে পারছিল না। তাই ঢাকা যাওয়ার আগে একবার আমাকে ঢাকায় যাব কি-না জানতে এসেছিল। আমি মুখের ওপর না বলায় আব্বার আর রাগ করেনি। মূলত সেদিন থেকেই আমাকে আমি স্বাধীন ঘোষণা করি। সিদ্ধান্ত নিই জীবন আমার, আমাকেই চালাতে হবে। আমি গেদু চেয়ারম্যানের বাড়িতেই থেকে যাই। বস্তুত, আব্বা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই আমি পুরোদস্তুর পুরুষ হয়ে উঠি। কদ্দিন ধরে সন্ধ্যার পরে বাজারে যাই। চা খাই। আমার সমবয়েসী ফজলুও বাজারে আসে। দুজনের দেখা হয়। সে বিয়ে করবে ভাবছে। আমি তাকে তার আয় রোজগারের কথা জিজ্ঞেস করি। সে জানায়, ভাল একটা গৃহস্থের ঘরের মেয়ে বিয়ে করবে। আমার হাসি পায়। ফজলুর দাঁত গেজা। মুখ দিয়ে দুর্গন্ধ বের হয় এখনও। শুনেছি, কয়েকদিন ধরে সে সভাপতি গোলাপ মেম্বারের ইশকুল পড়ুয়া নাতনির পেছনে ঘুরছে। ভালবাসার প্রস্তাব নিয়ে সে একবার তার মুখোমুখি হয়েছিল। সাদা ধবধবা পিঠের ওই মেয়ে ফজলুর মুখে জুতো মেরে অপমান করেছে। কিন্তু ফজলুর চায় না মোবাইলে এখনও সেই মেয়ের গোসল করার ভিডিও রয়েছে। ওই ভিডিও আমিও দেখেছি। তেমন কিছুই দেখা যায় না। হালকা খেজুর দানার মতো বুক তার, পিঠের রংটাই কেবল ফর্সা; সিলভার কার্প মাছের মতো সাদা। আমার জন্য জমিলাই ভাল। তার বুকের মাই দুটাতে আমি সিথান দিতে পারি, ইচ্ছেমতো খাবলা দিতে পারি। ফজলুকে আমি পরামর্শ দিই, ‘ছোট মাইঅলা মেয়ে বিয়া করিস না। আরাম নাই।’ ফজলু আমার কাছাকাছি আসে। দুর্গন্ধযুক্ত মুখটা আমার কানের কাছে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কি তোর জমিলারেই বিয়া করবি?’ শরীরে তাগদে একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিয়া করলে জমিলাকেই করব। কেবল শোয়ার জন্য নয়, এমনিতেই তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়, খাতির জমে। অনেক কথা হয়। কীভাবে আবু শামা বিলের ওই পারের মেয়ের ইজ্জত লুটে রজব আলির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল, রজব আলিরটা কখনই দাঁড়াত না ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা প্রসঙ্গে জমিলাও মুখ খোলে। একটা সময় তার ভিক্ষুক মা, ভিক্ষায় সুবিধা করতে না পেরে নিজেই জমিলার ঘরে গেদু চেয়ারম্যানকে ডেকে এনেছিল, এসেছিল হাই ফকির। জমিলা এখন আগের চেয়ে বেশি সাজগোজ করে। মাথায় ডাবমার্কা নারিকেল তেল দেয়, মাঝে মাঝে শ্যাম্পু দেয়। আর আমার সঙ্গে শোয়ার সময় জর্দাঅলা মিষ্টিপান মুখে চিবাতে চিবাতে চিৎ হয়। একদিন তার সঙ্গে শুতে গেছি, মনটা ভাল ছিল। আলাপ জমতে জমতে জমিলার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে, ‘অহন তো আমার শইলে গিয়ার কইমা গেছে। আগে কতজন আইতো। তোগো দহিনপাড়ার হাই ফকির, তোরার পুরান মসজিদের সভাপতি কাছুম আলি, মেন্দু মুন্সি, সফির উদ্দি। এমুনকি তোর বাপেও....’ বলতেই আমার মাথা আউলাইয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমারটা বিদ্যুত গতিতে নেতিয়ে যায়। এতদিন যারে আমার প্রেমিকা মনে হতো, তাকে আমার জঘন্য লাগতে শুরু করে। কী এক বিশ্রী ঘ্রাণ ভেসে আসে তার শরীর থেকে। তার বুকে আমার থুতু ছিটাতে ইচ্ছে হয়। আমার হঠাৎ থেমে যাওয়া তাকে বিস্মিত করে। সে পাগলের মতো আমাকে জাগানোর জন্য চেষ্টা করে, ‘কিরে সোরাবদ্দি, তোর আইজ এমুন অইল ক্যান? তুই তো আর গেদু চাচার মতো টেম্পারলেস না। কর.... আরেকটু।’ আমি লুঙ্গিটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে পুকুরে নামি। আমার গায়ে তখনও বিচ্ছিরি গন্ধ লেগে আছে। আমার বমি আসে, যার সঙ্গে আমার আব্বা শুইছে, তার সঙ্গে আমি....। বিড়ির ধোয়ায় তৈরি সারামাসি কাশের দলাটাকে চা-স্টলের জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে ফেলতে ফজলু আবার জানতে চায়, ‘ক্যান? তুই না কইছিলি জমিলারে বিয়া করবি? অহন কি নিশা মইরা গেছে?’ আমি কোন উত্তর না দিয়েই লুঙ্গির খুঁট থেকে দশটাকার একটা বিচ্ছিরি নোট চাঅলার হাতে গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে আসি। ফজলু দুহাত মাথার পেছনে নিয়ে আমার চলে যাওয়া দেখে আর ঘোৎ ঘোৎ করে হাসে। পেছনে না তাকিয়েও তা বুঝতে পারি। দক্ষিণপাড়া, মানে যে মহল্লা আমার, আমাদের ফুলু, ফজলু, আবু শামাদের। সেই মহল্লার মসজিদের সভাপতি, গোলাপ মেম্বার, যার কি-না মেন্দি মাখানো রঙিন দাড়ি, তার নাতনির উদোম লাশ পাওয়া যায় মাইজুদ্দির পুকুরে। পাড়ায় থানা-পুলিশ এসে ভরে যায়। একে ওকে সন্দেহ করে। কাউকেই ঠাহর করতে পারে না। তবে ফজলুর প্রতি গোলাপ মেম্বারের সামান্য সন্দেহ আছে, এখনও সে মুখ খোলেনি। আমি ফজলুকে পরদিন মাঠে দেখা হলে জিজ্ঞেস করি, ‘কামডা ক্যাডা গডাইসে?’ ফজলু হাসতে হাসতে জবাব দেয়, ‘বোঝো না ক্যাডায়?’ আমি বললাম, ‘না বুঝি নাই। ভুংভাং রাইখ্যা আসল কথা ক। তুই হালা ক্যামনে পারলি মাইয়্যাডারে খাইয়া দিতে?’ ফজলু আমার পায়ে পড়ে চিৎকার দিয়্ েকাঁদে, ‘দোস্ত, আমি তো ওরে ভালবাসতাম, ওর ক্ষতি করুম ক্যান? ওর ক্ষতি তো করসে ওর দাদা, নয়া মসজিদের সভাপতি গোলাপ মেম্বর।’ পরের দিন শুনি পুলিশে ফজলুকে ধরে নিয়ে গেছে। তার মোবাইলে গোলাপ মেম্বারের নাতনির গোসলের ভিডিও পাওয়া গেছে। আমারও ভয় ভয় লাগছে। জমিলার কাছে যাই না সাত মাস। শুনেছি, সে নাকি পোয়াতি হয়েছে। গেদু চেয়ারম্যানের আঙ্গুলও যেমন কেন জানি আমার দিকেই...!
×