ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়াবে

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ১ মার্চ ২০২০

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়াবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাওয়া দেশের রফতানি খাতের ওপর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তখন বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। বিদ্যুত উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়ম, সিস্টেম লস ও অদক্ষতার কারণে যে ক্ষতি তা পোষাতে গ্রাহকের ওপর বাড়তি দামের বোঝা চাপানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, গত চার বছরে ধাপে ধাপে পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যয় ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়ে গেল। উল্টোদিকে বাজারে পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা অন্য যে কোন পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সহ্য করার মতো সক্ষমতা পোশাক শিল্পের নেই। রফতানি আয়ে ফের ধাক্কা : রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের রফতানি আয় ছিল ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলারের বেশি, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১০ শতাংশ বেশি। এই আয়ের ৮৪ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে চলতি অর্থবছরে রফতানি প্রবৃদ্ধি উল্টো পথে হাঁটছে। প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২ হাজার ২৯২ কোটি ডলারের ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ কম। বৃহস্পতিবার খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের নতুন যে মূল্যহার ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে সø্যাব অনুযায়ী ক্ষুদ্র শিল্পে বিদ্যুত বিল ১৬ হাজার ৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭ হাজার ৩৬০ টাকা, মাঝারি শিল্পের ৩ লাখ ২৬ হাজার থেকে ৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ও বৃহৎ শিল্পে এক কোটি ৬২ লাখ ৪০ হাজার থেকে এক কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হবে বলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসির চেয়ারম্যান একটি হিসাব দিয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর পরই বিএনপি ও বামদলগুলোসহ বিভিন্ন অঙ্গন থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মূল্য বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব। বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়ে চাহিদার তুলনায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পরও দাম না কমে উল্টো বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বেঙ্গল প্লাস্টিকস ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কর্ণধার জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধি প্লাস্টিক শিল্পে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই মুহূর্তে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটটা খানিকটা ‘ভোলাটাইল’। এর সঙ্গে যোগ হলো বিদ্যুতের বাড়তি দাম। এখন উৎপাদনের খরচ বাড়বে, ফলে প্লাস্টিক পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা পণ্যের মূল্য ও কোয়ালিটির ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছি। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেবে। কারণ উৎপাদন খরচ বাড়ার বিপরীতে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে না, বরং কমছে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে আউট হয়ে যাবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর স্তরে স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ করে আসছেন ভোক্তা নেতারা। বিষয়টি সরাসরি না উল্লেখ না করলেও কোম্পানির অনিয়ম, সিস্টেম লস ও অদক্ষতার প্রভাবে এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এই সাবেক সহ-সভাপতি। বেঙ্গল প্লাস্টিকস ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কর্ণধার জসিম উদ্দিনবেঙ্গল প্লাস্টিকস ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কর্ণধার জসিম উদ্দিনজসিম বলেন, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জসহ অন্যান্য ব্যয় যেভাবে ধরা হয় তাতে যথেষ্ট শিথিলতা রয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে এর প্রভাব রয়েছে। যখন আমাদের বিদ্যুত ছিল না, তখন বলা হতো উৎপাদন বাড়লে দাম ধীরে ধীরে কমে আসবে। অর্থনীতির হিসাবও তাই বলে। এখন আমাদের কনজাম্পশনের চেয়েও উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। তার পরেও কেন দামটা বাড়ল? এই প্রশ্ন এখন খুবই প্রাসঙ্গিক। সরকার ‘কোয়ালিটি বিদ্যুত’ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূরণ না করেই কিছু দিন পর পর দাম বাড়িয়ে চলেছে মন্তব্য করেন এই উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, এখনও কোয়ালিটি বিদ্যুত নেই। উৎপাদন বাড়লেও বিতরণ লাইনগুলোর সক্ষমতা নেই। তাই বড় কারখানাগুলোতে লোডশেডিং ম্যানেজমেন্টের জন্য জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। দেশের অন্যতম রফতানি খাত চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তা সমতা লেদার কমপ্লেক্সের নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, এই শিল্পের উৎপাদন ব্যাপকহারে বিদ্যুতনির্ভর। তাই নতুন করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে এ খাতের উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে যাবে। নিজের কারখানার চিত্র তুলে ধরে তিনি তিনি বলেন, আমরা হিসাব করে দেখেছি, সব ধরনের চার্জ মিলিয়ে এতদিন প্রতি ইউনিট ৮ টাকা ৫০ পয়সা হারে বিদ্যুতের বিল দিয়ে এসেছি। মাসে গড়ে চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা বিল দিতে হয়েছে। এখন এর সঙ্গে প্রায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বর্ধিত মূল্য যোগ হচ্ছে। আমরা এর প্রভাব ক্যালকুলেশনের জন্য হিসাব-নিকাশ করছি।
×