ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিরপুরে জয়ের সুবাস পাচ্ছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 মিরপুরে জয়ের সুবাস পাচ্ছে বাংলাদেশ

মিথুন আশরাফ ॥ এক দ্বিশতক। আরেক শতকেই জিম্বাবুইয়ের সব আশা যেন শেষ হয়ে গেল। একের পর এক টেস্ট হারের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার চেষ্টায় নতুন শুরুর আশা করেছে টাইগাররা। মুশফিকুর রহীমের অপরাজিত ২০৩ রান ও মুমিনুল হকের ১৩২ রানের অসাধারণ ইনিংসে সেই শুরু বোধ হয় হয়েই গেল। জিম্বাবুইয়ের চেয়ে প্রথম ইনিংসে ২৮৬ রানে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। তাতে ম্যাচ জয়ের আশা ভালভাবেই তৈরি হয়ে গেছে। আজ চতুর্থদিনেই ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল। জিম্বাবুইয়ে যে ২ উইকেট হারিয়েও ফেলেছে। মিরপুর টেস্টে প্রথম দিনের শেষ বিকেল থেকেই দাপট দেখানো শুরু করে দেয় বাংলাদেশ। সেই দাপট দ্বিতীয় দিনেও থাকে। তৃতীয়দিনেও বজায় থাকে। টেস্টে একটি দল যখন টানা দুইদিন ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ রাখে, তখন সেই টেস্টে জয় আসে। বাংলাদেশেরও সেই সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে গেছে। বড় সংগ্রহ যে বাংলাদেশ করবে, তা দ্বিতীয় দিনেই বোঝা হয়ে যায়। সেই সংগ্রহ হয়েছেও। প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট হারিয়ে ৫৬০ রান করে ইনিংস ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ স্কোর গড়েছে। জিম্বাবুইয়ে প্রথম ইনিংসে ২৬৫ রান করায় বাংলাদেশের ইনিংস ঘোষণাতেই ২৯৫ রানে এগিয়েও যায় মুমিনুল হকের দল। দুই সেঞ্চুরিয়ান মুশফিক-মুমিনুলের চতুর্থ উইকেটে ২২২ রানের জুটিতেই তা সম্ভব হয়। এরপর জিম্বাবুইয়ে ব্যাট হাতে নেমে প্রথম ওভারেই নাঈম হাসানের স্পিন জাদুর সামনে পড়ে ২ উইকেট হারিয়ে বসে। রানের খাতা খোলার আগেই ওপেনার প্রিন্স মাসভাউরে ও নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে নামা ডোনাল্ড তিরিপানোকে টানা দুই বলে আউট করে দিয়ে হ্যাটট্রিকের আশাও জাগান নাঈম। তা হয়নি। তবে শেষ ৫ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ৯ রান করে দিন শেষ করে জিম্বাবুইয়ে। তাতে করে তৃতীয়দিন শেষে ২৮৬ রানে এগিয়ে থাকে বাংলাদেশ। আজ চতুর্থদিনে ওপেনার কেভিন কাসুজা (৮*) ও ব্রেন্ডন টেইলর (১*) দলকে বাঁচাতে ব্যাট হাতে নামবেন। জিম্বাবুইয়েকে এমন অবস্থায় ফেলা যায় আসলে মুশফিক ও মুমিনুলের জোড়া শতকে। দ্বিতীয়দিন মুমিনুল ৭৯ রানে অপরাজিত থাকেন। মুশফিক ৩২ রানে অপরাজিত থাকেন। দলের রান প্রথম ইনিংসে দ্বিতীয় দিনে ৩ উইকেটে ২৪০ রান ছিল। জিম্বাবুইয়ের চেয়ে ২৫ রানে পিছিয়ে ছিল স্বাগতিকরা। তবে চালকের আসনে বাংলাদেশই ছিল। উইকেট যেভাবে রান করার জন্য ব্যাটসম্যানদের অনুকূলে থাকে, তাতে বাংলাদেশ যে রানের পাহাড় গড়ে জিম্বাবুইয়েকে বিপদে ফেলবে, সেই আলামত দ্বিতীয় দিনেই মিলে। তৃতীয় দিন প্রথম সেশনে বাংলাদেশের কোন উইকেটই ফেলতে পারেনি জিম্বাবুইয়ে বোলাররা। বল শুধু করেই গেছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। মুমিনুল-মুশফিক মিলে যে বড় কিছু করার জন্যই নামেন। প্রথম সেশনেই দলের রান ৩৫১ হয়ে যায়। তৃতীয়দিনের অষ্টম ওভারেই জিম্বাবুইয়ের প্রথম ইনিংসে গড়া ২৬৫ রান অতিক্রম করে ফেলে বাংলাদেশ। প্রথম ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই মুমিনুল শতক করে ফেলেন। ১৫৬ বলে ১০০ রান করে টেস্ট ক্যারিয়ারের নবম শতক তুলে নেন। মুমিনুলের আগেই ৯৫ বলে অর্ধশতক করে ফেলেন মুশফিক। দুইজন মিলে শতরানের জুটি গড়ে ২০০ রানের জুটি গড়ার দিকেও এগিয়ে যেতে থাকেন। যেভাবে খেলতে থাকেন মুমিনুল-মুশফিক, বোঝাই যায় বড় জুটি হবে। মুমিনুল শতক করেছেন। কোন ভুল শট না খেললে মুশফিকও তাই করবেন। মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির আগেই মুশফিকেরও সেঞ্চুরি হয়ে যেতে পারত। কিন্তু কোন ঝুঁকি নেননি মুশফিক। ৯৯ রানে মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার পর আবার দ্বিতীয় সেশনে ব্যাট করতে নেমেই শতক করে ফেলেন মুশফিক। ১৬০ বলে ১০০ রান করে ক্যারিয়ারের সপ্তম টেস্ট শতক তুলে নেন মুশফিক। দুইজন মিলে দলকে ৪০০ রানের কাছেও নিয়ে যেতে থাকেন। একেবারে কাছেও চলে যান। যখন দলের ৩৭২ রান হয়, তখন মুমিনুল-মুশফিক মিলে ২০০ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। দলকে অনায়াসেই ৪০০ রানে নিয়ে যাবেন, তাই ভাবা হয়েছে। কিন্তু যখন দলের ৩৯৪ রান হয়, তখনই মুমিনুল আউট হয়ে যান। এ্যান্সলি এনডিলোভুর স্পিন বোলিংটিতে একটু এগিয়ে এসে মাথার ওপর দিয়ে বল নিতে চান মুমিনুল। কিন্তু এনডিলোভু দুর্দান্তভাবে ক্যাচ ধরে ফেলেন। তাতে ২৩৪ বলে ১৪ চারে ১৩২ রান করে থামেন মুমিনুল। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ওপেনার তামিমের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৯ টেস্ট সেঞ্চুরি আছে এখন মুমিনুলের। মুশফিকের সঙ্গে তার ২২২ রানের জুটিও ভেঙ্গে যায়। যে জুটি এ পর্যন্ত টেস্টে তিনটি ২০০ রানের জুটি উপহার দেয়। এ দুই ব্যাটসম্যান চতুর্থ উইকেটে ২০১৮ সালের নবেম্বরে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে মিরপুরে ২৬৬ রানের জুটি গড়েছিলেন। যা চতুর্থ উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি হয়ে থাকে। মিরপুরে সেরা জুটিও সেটি। এবার দুইজন মিলে ২২২ রানের দ্বিতীয় সেরা জুটি গড়েন। এ জুটিই বাংলাদেশকে বড় সংগ্রহের পথে নিয়ে যায়। মুমিনুল আউটের পর মুশফিকের দিকেই বিশেষ নজর থাকে। মুশফিক দ্বিশতক করতে পারেন কিনা, সেদিকেই দৃষ্টি থাকে। তবে সঙ্গে মোহাম্মদ মিঠুন, লিটন কুমার দাসরাও এমন ব্যাটিং নির্ভর উইকেটে কী করেন, তা নিয়েও ভাবা হয়। মিঠুন ব্যাট হাতে নামেন আর ১৭ রান করে সাজঘরে ফিরেন। লিটন এসে মুশফিককে ভালই সঙ্গ দিতে থাকেন। মুশফিক একদিকে রান তুলতে থাকেন। আরেকদিকে লিটন উইকেট আঁকড়ে থাকেন। দলের রান ৪৫০ হয়ে যায়। মুশফিকও ১৫০ রান করে ফেলেন। একটা সময় ৫০০ রানও হয়ে যায়। দশমবারের মতো ৫০০ বা তার বেশি রান স্কোরবোর্ডে যোগ করতে পারে বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে তৃতীয়বারের মতো ৫০০ রানের স্কোর গড়ে বাংলাদেশ। গত বছর নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারিতে ৪২৯ রান করার পর টানা ১০ ইনিংসে বাংলাদেশ ২৫০ রানও স্কোরবোর্ডে জমা করতে পারেনি। এমনকি ৫ ইনিংসে ২০০ রানও করতে পারেনি। এক বছর পর আবার বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে বড় স্কোর দেখার মিলল। মুশফিক আবারও ২০০ রান করার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। ২০১৮ সালের নবেম্বরে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধেই দেশের হয়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ অপরাজিত ২১৯ রান করেছিলেন মুশফিক। এর এক বছর পর আবার শতক পেলেন। সেই শতককে তৃতীয়বারের মতো দ্বিতশতকে পরিণত করার দিকেই এগিয়ে যেতে থাকেন মুশফিক। তবে লিটন (৫৩) অর্ধশতক করার পরই আউট হয়ে যান। তবে আউট হওয়ার আগে মুশফিকের সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেটে ১১১ রানের জুটি গড়েন। যা দলকে ৫০০ রানে নিয়ে যেতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রথম ইনিংসে জিম্বাবুইয়ে যে রান করে বাংলাদেশ যখন ৫৩০ রান করে ফেলে তখনই সেই ২৬৫ রানে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। তখন বাংলাদেশ দল কখন ইনিংস ঘোষণা করে দেবে? সেই প্রশ্নই উঠে। কিন্তু মুশফিক যে দ্বিশতকের কাছে থাকেন, তিনি এই রান না করার আগে যে ইনিংস ঘোষণা হবে না, তাও বোঝা যায়। শেষপর্যন্ত যেমন সেঞ্চুরি করার সময়, দেড় শ’ রান করার সময় বাউন্ডারি হাঁকান। ক্যারিয়ারের তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি করার সময়ও বাউন্ডারি হাঁকিয়ে এ মাইলফলকে পা রাখেন মুশফিক। ৩১৫ বলে দ্বিশতক করতেই ড্রেসিংরুম থেকে অধিনায়ক মুমিনুল ইনিংস ঘোষণার সিদ্ধান্ত বুঝিয়ে দেন। ১৫৪ ওভারটি শেষ হতেই ইনিংস ঘোষণা হয়ে যায়। বাংলাদেশ ৫৬০ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। মুশফিক ৩১৮ বলে ২৮ চারে অপরাজিত ২০৩ রান করে মাঠ ছাড়েন। আর তাইজুল অপরাজিত ১৪ রান করেন। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে গলে ২০০ রানের ইনিংস খেলার পর জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের নবেম্বরে মিরপুর টেস্টে দ্বিশতক করেছিলেন মুশফিক। ২১৯ রান করেছিলেন। এরপর মাঝপথে ১০ ইনিংসে কোন শতক পাননি মুশফিক। যখন জিম্বাবুইয়েকে আবার পেলেন শতককে আবার দ্বিশতকে পরিণত করলেন। দ্বিশতকের পর আবার দ্বিশতক করলেন মুশফিক। তার এই অসাধারণ ইনিংসের পর ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। এরপর জিম্বাবুইয়ের ব্যাটসম্যানরা ব্যাটিংয়ে নামেন। প্রথম ওভারেই নাঈম হাসান টানা দুই বলে ২ উইকেট শিকার করে নেন। শেষপর্যন্ত তৃতীয় দিনে ২ উইকেট হারিয়ে শেষ ৫ ওভারে ৯ রান করে জিম্বাবুইয়ে। বাংলাদেশের চেয়ে আরও ২৮৬ রানে পিছিয়ে আছে সফরকারীরা। প্রথম ইনিংসে যেভাবে বাংলাদেশ বোলাররা বোলিং করেছেন। জিম্বাবুইয়ের দ্বিতীয় ইনিংসে যে আরও তুখোড় বোলিং হবে, তা শেষদিকেই বোঝা গেছে। তা আজ বজায় থাকলে পঞ্চমদিনে আর খেলা গড়াবে না। বাংলাদেশের জয় মিলে যাবে।
×