ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খোকন আহম্মেদ হীরা

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল

নির্যাতিত-নিপীরিত, শোষিত-অনুন্নত, শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাৎপদ, সামাজিকভাবে অবহেলিত, দরিদ্র-অর্থক্লিষ্ট ও রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এবং অধিকার আদায়ের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে তার ছিল গভীর সম্পর্ক। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারত-বাংলা প্রদেশের সাধারণ আসন বরিশালের বৃহত্তর বাকেরগঞ্জের পূর্ব-উত্তর এলাকায় ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রথম এমএলএ। অবিভক্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার বিচার ও পূর্তমন্ত্রী, ভারতের অন্তর্বর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী এবং পাকিস্তান সরকারের আইন ও শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। তিনিই প্রথম শাসনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেছেন। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত মৈস্তারকান্দি গ্রামের যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়ায় তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে ‘মহাপ্রাণ’ খেতাবে ভূষিত করেছেন। এ মহাপ্রাণ ব্যক্তির ১১৬তম জন্মজয়ন্তী উৎসব ছিল ২৯ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে গৌরনদীর মৈস্তারকান্দি গ্রামের ‘মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদ’-এর উদ্যোগে ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। মহৎ কাজের জন্য যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। তাই তো তিনি তার একটি বাণীতে লিখেছিলেন- ‘যদি আজ কেহ নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারে যে, আমার জীবনের বিনিময়ে আট কোটি তফসিলীর সার্বভৌম মুক্তি আসিবে। তবে আমি সে মৃত্যুকে তিলে তিলে বরণ করিতে পারিব। যদি সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে অথবা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আমাকে নিক্ষেপ করিলে সে মুক্তি মেলে, তবে আমি দুর্বার আকাক্সক্ষা লইয়া তাহাতেই ঝাঁপাইয়া পড়িব।’ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের ইতিহাস ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ জানান, ১৯০৪ সালের ২৯ জানুয়ারি মৈস্তারকান্দি গ্রামের কৃষক রাম দয়াল মন্ডল ও সন্ধ্যা দেবীর ঘর আলোকিত করে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। স্থানীয় বালাবাড়িতে গ্রাম্য পাঠশালার মাধ্যমে তার বাল্য শিক্ষার জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে চতুর্থ শ্রেণীতে বার্থী তারা ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯২৪ সালে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিকুলেশন) পাস করেন। ওই বছরই বরিশাল বিএম কলেজে আইএ ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে আইএ এবং ১৯২৯ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে কলকাতা আইন কলেজ থেকে এলএলবি পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে প্রথমে কলকাতায় এবং একই বছর বরিশালে আইনজীবী হিসেবে তিনি যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত ভারতের আইনসভার একটি মাত্র সাধারণ আসনে তফসিলী জাতির একমাত্র প্রার্থী হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এমএলএ নির্বাচিত হন। এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পুনরায় এমএলএ নির্বাচিত হয়ে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার বিচার ও পূর্তমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব পালন করেন। শেষ ভাগে অবিভক্ত ভারতের অন্তর্বর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ছিল গভীর সম্পর্ক। সবশেষে সোহরাওয়ার্দীর অনেক অনুরোধের পর ১৯৪৭ সালে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভার আইন ও শ্রমমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই প্রথম শাসনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫০ সালে দেশের রায়ট শেষে তিনি (যোগেন্দ্রনাথ) রায়ট উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করেন। একপর্যায়ে তিনি তার স্বজাতি, অনুন্নত জনসাধারণের জানমাল ও অধিকার রক্ষায় ব্যর্থতা প্রকাশ করে রাজধানী করাচীতে ফিরে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু তার এ পদত্যাগের বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি হননি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। একপর্যায়ে বীরের বেশে পাকিস্তান থেকে রেলযোগে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ভারতে ফিরে তিনি আট পৃষ্ঠায় কারণ উল্লেখ করে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে পাকিস্তান সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেন। তৎকালীন সময়ে ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় এ রিপোর্টটি ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে শরণার্থীদের কল্যাণে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ১৯৬৮ সালে ভারতের চব্বিশ পরগনার স্বজাতি বন্ধুর বাড়িতে খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তড়িঘড়ি করে ফেরার সময় পথিমধ্যে মহাপ্রয়াণ ঘটে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের। চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গা এলাকায় সমাহিত করা হয় যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে। তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে মহাপ্রাণের খেতাবে ভূষিত করেন। মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের অন্যতম সদস্য ডাঃ মনোতোষ সরকার বলেন, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের একমাত্র পুত্র জগদ্বীশ মন্ডল (৮৯) পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতেই বসবাস করছেন। মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথের জন্মভূমিতে এখন তার পৌত্রদ্বয় (নাতিরা) বসবাস করছেন। যোগেন্দ্রনাথের বড় ভাই মহানন্দ মন্ডলের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ, তার পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ম-ল ওরফে ঝন্টু ও প্রদ্বীপ কুমার মন্ডৈল ওরফে মন্টু তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মৈস্তারকান্দি গ্রামে বসবাস করছেন। দিনমজুরের কাজ করেই চলছে ঝন্টু ও মন্টুর সংসার। তিনি আরও জানান, জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে স্থানীয় সেবা আশ্রম প্রাঙ্গণে ২৯ জানুয়ারি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের প্রতিকৃতিতে পূষ্পার্ঘ অর্পণ ও মাল্যদান, শ্রীমদ্ভগবত গীতা পাঠ, দুপুরে ভক্তি গীতির অনুষ্ঠান, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জিবনী ও সংগ্রামী কার্যক্রমের ওপর আলোচনা সভা এবং কবি গান। স্থানীয় মনোজ কুমার গোমস্তা, লক্ষ্মী কান্ত বৈদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা শামসুল হক সরদারসহ অনেকেই জানান, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এতদঞ্চলে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে অসংখ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। কর্মস্থলের সুযোগ করে দিয়েছেন সহস্রাধিক বেকার-যুবককে। এ ছাড়াও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পার্শ¦বর্তী বেজগাতি-বাশাইল ভায়া মৈস্তারকান্দির জনগুরুত্বপূর্ণ খালটি খনন করা হয়েছে যোগেন্দ্রনাথের সময়েই। গ্রামবাসী মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান মৈস্তারকান্দি গ্রামে মহাপ্রাণের নামানুসারে স্মৃতি জাদুঘর, পাঠাগার, গবেষণা কেন্দ্র ও একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি করেছেন। লেখক : সাংবাদিক
×