ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মরণে

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মরণে

৩১ জানুয়ারি ২০২০ দেশ ও জাতির কীর্তিমান সন্তান, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর শততম জন্মদিন। বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী বাঙালী জাতির মহান সন্তান বিচারপতি চৌধুরী ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের নাগবারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একাত্তরে তিনি পৃথিবীর দেশে দেশে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধিরূপে সম্পন্ন করেছেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ওই সময় তিনি সমগ্র বিশ্বে শতধা বিভক্ত বাঙালী জাতির ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হন। মানবাধিকার সম্মেলন উপলক্ষে জেনেভায় অবস্থানকারী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র একদিন পর ২৭ মার্চ লন্ডনে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে চারণ কবির মতো দেশে দেশে ঘুরে তিনি বাঙালীদের সংগঠিত এবং স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করেন। তার সেই ভূমিকাই তাকে ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে। একাত্তরে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে বিচারপতি চৌধুরী জেনেভায় ছিলেন। তিনি তখন বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার সদস্য। জেনেভায় মানবাধিকার সম্মেলন চলাকালে ২৬ মার্চ ১৯৭১ শুক্রবার বিবিসির মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করেছে। এই খবর শুনে মর্মাহত, চিন্তিত, বিচলিত বিচারপতি চৌধুরী অধিবেশন চলা অবস্থায় মানবাধিকার সংস্থার তৎকালীন সভাপতি আঁদ্রে আগিলাকে জানানÑ ‘আমার দেশ আক্রান্ত। বাংলার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। আমার দেশ সংক্রান্ত গভীর দুঃখজনক সংবাদ জেনে অধিবেশনে অংশ নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ ওইদিন মধ্যাহ্নে জেনেভা ত্যাগ করে বিকেলের দিকে তিনি লন্ডন পৌঁছেন। লন্ডন পৌঁছেও দেশে আসলে কি ঘটছে তা জানা সম্ভব হচ্ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দুজন কর্মকর্তাকে তিনি চিনতেন। তাদের একজন হচ্ছেনÑ ইয়ান সাদারল্যান্ড। তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান। অপরজনের নাম এন জে ব্যারিংটন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড হিউমের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। পরদিন ২৭ মার্চ শনিবার ছুটির দিন বিচারপতি চৌধুরী তাদের দুজনকে অফিসে যেতে অনুরোধ করেন। তারা অনুরোধ রক্ষা করেন। বিচারপতি চৌধুরী উপস্থিত হলে তারা জানান, ‘ঢাকা থেকে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।’ উদ্বিগ্ন আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকার খবরের প্রতীক্ষায় বসে থাকেন। আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে গিয়ে ২৬ মার্চ শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণের কথা শোনেন। ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে আওয়ামী লীগকে বেআইনী এবং শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে তাকে যথাযথ শাস্তি দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। ২৭ মার্চের পত্রিকায় ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের বিবরণী এবং ঢাকায় পাকি সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর প্রকাশিত হয়। কোন কোন পত্রিকা লেখে, এই হামলার পরিণতি ভয়াবহ হবে। করাচী থেকে কেনেথ ক্লার্কের প্রেরিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, ‘জিন্নাহর একতার স্বপ্ন রক্তে ধুয়ে-মুছে গেছে।’ ওই দিনের লন্ডন টাইমে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্বর হত্যাযজ্ঞের খবর তখনও বিশ্ববাসী জানতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী ঘোষণার পরিণতি এবং লন্ডন টাইমস পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর দেখে বিচারপতি চৌধুরী তার করণীয় সম্পর্কে মনে মনে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন। ঢাকাসহ তার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের খবর না পাওয়া পর্যন্ত তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। বেশিক্ষণ বসে থাকতে হলো না। সাদারল্যান্ডের কক্ষে বসে থাকার কিছু সময় পর ঢাকা থেকে একটি টেলেক্স যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। টেলেক্সটি পড়ে, সাদারল্যান্ড বেদনা ও সহানুভূতি ভরা মুখে ধীরে ধীরে বলেন, ‘ঢাকার খবর খুব খারাপ। বহু লোক প্রাণ হারিয়েছেন। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র-ছাত্রী হতাহত হয়েছেন।’ পড়া শেষে বলেন, ‘২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকায় ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার একটি ভয়াবহ রাত যাপন করেছেন। দূতাবাসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি সান্ধ্য আইন শিথিলের পর অল্প সময়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ইকবাল হলের সিঁড়ি বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখেছেন। জগন্নাথ হলের সামনে গণসমাধি খনন করে সেখানে নিহত ছাত্র-শিক্ষকদের শবদেহ ছুড়ে ফেলা হয়। আর যেসব ছাত্রকে গুলির ভয় দেখিয়ে গণকবরের সামনে আনতে বাধ্য করা হয়। তাদেরও পরে গুলি করে সেই কবরেই ফেলা হয়।’ বাংলাদেশের হাজারো নিরীহ মানুষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক হত্যার খবর শুনে ক্ষোভে, দুঃখে, বেদনায় ও অপমানে আবু সাঈদ চৌধুরী বিহ্বল হয়ে পড়েন। ওই মুহূর্তেই তিনি তার জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিলেন। টেলেক্স শুনে সাদারল্যান্ডকে তিনি ক্রোধ ও ক্ষোভের সঙ্গে স্পষ্ট করে বললেন, ‘এই মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক রইল না। আমি দেশ থেকে দেশান্তরে যাব আর পাকিস্তানী সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতার কথা বিশ্ববাসীকে জানাব। তারা আমার ছেলে-মেয়েদের হত্যা করেছে। এর প্রতিবিধান চাই।’ ওই সময়কার অনুভূতির কথা বিচারপতি চৌধুরী তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’তে লিখেছেন : আমার কেবলই মনে হতে থাকল, আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বলেছি আমি তোমাদেরকে নিজের ছেলে ও মেয়ের মতো ভালবাসি। সে কারণেই পরীক্ষার তারিখ বদলাব না। সে তো আমার অন্তরের কথা ছিল। এর সত্যতা প্রমাণের দিন আজ উপস্থিত। পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কথা বলার সময় আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। শুধু বাঙালী বলে অবাঙালীরা তাদের হত্যা করবে, আমার জাতীয় সম্মানে আঘাত লাগল। যে মানুষ নিজেকে বাঙালী মনে করে তার একটি মাত্র কর্তব্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো, আর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা। মনে পড়ল দুটি ঘটনা। জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সরকারের নির্মমতম হত্যাকা-ের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ আর স্যার জন হার্বাটের চক্রান্তে মন্ত্রিসভার অবসান ঘটলে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি গ্রাম থেকে গ্রামে, ঘর থেকে ঘরে যেয়ে এই অন্যায়ের কথা দেশবাসীকে জানাব।Ñ আমিও বললাম, বিশ্ববাসীকে এই গণহত্যার কথা জানাব, চাইব প্রতিকার। বাংলাদেশকে স্বাধীন হতেই হবে।’ (পৃ. ৪)। ছাত্র-ছাত্রীদের কথা ভাবতে ভাবতে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাদারল্যান্ডের টেবিলের সামনে বসেই মনে মনে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, ‘আজ আমার একটি মাত্র কর্তব্য দেশ স্বাধীন করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করা। করতেই হবে।’ এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিচারপতি চৌধুরী কোন রাজনীতিবিদ বা কোন দলের নেতা ছিলেন না। তিনি আওয়ামী লীগেরও কোন নেতা ছিলেন না। ছিলেন না জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। তিনি ছিলেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। অথচ তিনি কত বড় একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে জীবনের বিনিময়ে হলেও প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার ঘোষণা দিয়ে ফেললেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর ২৭ মার্চ বিদেশে বসে দেশের আক্রান্ত জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দেন বিচারপতি চৌধুরী। ২৭ মার্চ কেউ জানত না স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু কোথায়? তিনি কি জীবিত না মৃত? নাকি তিনি আত্মগোপনে। পাকিস্তানী ঘাতকচক্র কি নেতাকে গ্রেফতার করেছে? তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ দলের প্রথম সারির নেতারা কোথায়? তারা কি জীবিত না মৃত, না গ্রেফতার হয়েছেন। দেশ ও জাতির ওই সঙ্কটময় মুহূর্তে বিচারপতি চৌধুরীর দেশের পক্ষে সংগ্রাম করার ঘোষণাকে শুধু ঐতিহাসিক বললেও কম বলা হবে। এটা ছিল দুর্ধর্ষ পাকি সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। শুধুমাত্র ওই একটি মাত্র সিদ্ধান্তের জন্য ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাঙালী জাতির হৃদয়ে তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট লন্ডনে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে আকস্মিকভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বহুগুণে গুণান্বিত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আজন্ম গণতন্ত্রের অনুসারী ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্যকালে তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এখন জাতীয় বীরদের সম্মান করার সময় এসেছে। সেক্টর কমান্ডার জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী সর্ষিনার পীরকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী জাতীয় বীর আবু সাঈদ চৌধুরীর নামে গত ৪৯ বছরে একটি রাস্তারও নামকরণ করা হয়নি। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের বিদেশে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে তিনি ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা তো খুঁজে খুঁজে বের করে এনে অনেককেই প্রাপ্য মর্যাদা দিচ্ছেন। বর্তমান সরকারের মেয়াদে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবু সাঈদ চৌধুরীকে উপযুক্ত সম্মানে ভূষিত করা হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। শততম জন্মদিনে জাতীয় বীর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে অভিবাদন জানাচ্ছি এবং তার পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্র বিষয়ক গবেষক [email protected]
×