ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নারীর ক্ষমতায়নে ডব্লিউইওর সম্মাননা

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ৩ জানুয়ারি ২০২০

 নারীর ক্ষমতায়নে  ডব্লিউইওর সম্মাননা

সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরিতে নারী পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব উন্নয়নের আবশ্যকীয় পূর্ব শর্ত। অর্ধাংশ নারীরা যুগ ও সময়ের দাবিতে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হলে দৃশ্যমান উন্নয়ন স্পষ্ট হয় না। ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিতে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় সফলতাই নির্দেশ করে নারীদের পিছিয়ে পড়ার সঙ্গত কারণ এখন নেই বললেই চলে। নতুন নতুন সম্ভাবনা যেমন তৈরি হচ্ছে পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সতেনতা এবং নিজেকে গড়ে তোলার অনমনীয় দৃঢ়তায় বাংলাদেশ এগিয়েও যাচ্ছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীদের সফল কৃতিত্বও নজর কাড়া হচ্ছে। সরকারী প্রণোদনা ছাড়াও সক্ষম এবং কৃতী নারীরা অন্যদের এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয় কর্মপ্রবাহ প্রতিনিয়তই তৈরি করে দিচ্ছে। সমাজের বিত্তবান, সফল এবং ক্ষমতাধর নারী ব্যক্তিত্ব বিভিন্নভাবে এগিয়েও আসছেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং পিছিয়ে পড়া নারীদের নিজ পায়ে দাঁড়ানোর মতো অর্থনৈতিকও ব্যক্তিক সফলতাকে আয়ত্তে নিয়ে আসার কর্মস্পৃহায়। ফলে অনেক সফল নারী ব্যক্তিত্ব শুধুমাত্র নিজেই স্বাবলম্বী কিংবা অর্থবিত্তে এগিয়ে নেই বরং চারপাশের অগণিত নারী কর্মযোদ্ধারও জীবন গঠনে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। এই রকমই একজন সচেতন নারী উদ্যোক্তা নিজের সফলতাকে কাজে লাগিয়ে অন্য নারীদেরও সম্ভাবনায় ভবিষ্যত গড়তে প্রতিনিয়তই কর্মউদ্দীপনা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর নাম নাজমা মাসুদ। এই লড়াকু নারীর জীবনটা অতি অল্প বয়স থেকেই সহজ, স্বাভাবিক এবং নির্বিঘœ ছিল না। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ’৭১-এর দুঃসহ স্মৃতি মনে নেই তবে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে নিহত বাবা-মায়ের মৃত্যু এখনও তাকে তাড়িত করে। বয়সটা ছিল মাত্র ৩ মাস। লোকমুখে শুনে বড় হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের নির্মম ঘটনাপঞ্জি। সেখানে পিতা-মাতার দুঃসহ মৃত্যুর করুণ আখ্যান আজও প্রতিমুহূর্তে হৃদয়ে ঝড় তোলে। সঙ্গত কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা এই শহীদ কন্যা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় দেশপ্রেমকে সর্বক্ষণিক অনুপ্রেরণায় অন্তরে ধারণ করে আছেন। পাশাপাশি চলেছে জীবনযুদ্ধ। নিজেকে তৈরি করার লড়াকু অভিগমন। নিজের জবানিতে আছে অতি বাল্যকাল থেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার অনুপ্রেরণা ভেতরে অনুক্ষণ কাজ করত। তেমন অভীষ্ট লক্ষ্যে লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য স্পৃহাও দারুণভাবে আলোড়ন তুলত। সেই স্বপ্নের ছোট্ট বীজটি ক্রমান্বয়ে চারা হয়েছে পরবর্তীতে অবিচল সাহস আর কর্মযোগে বিরাট গাছে রূপ নিতে আরও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডঊঙ-এর শুভযাত্রা সেভাবেই শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালের এই বিজয় মাসেই নতুন প্রাতিষ্ঠানটি গুটি গুটি পায়ে তার নবযাত্রার পথকে ক্রমান্বয়েই সামনের দিকে চালিতে করেছে। নিজে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন পাশাপাশি অন্যদেরও উৎসাহ-উদ্দীপনাই সঙ্গে আর্থিক সহযোগিতা দিতেও পিছপা হননি। এই প্রতিষ্ঠানের নারীরা নিজেদের পণ্য উৎপাদনে হরেক রকম অনুষ্ঠানে তা প্রদর্শন করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে সক্ষম হন। হস্তচালিত এসব শিল্পের যে আকর্ষণ এবং বাহারি পণ্যের যে চমৎকারিত্ব তাতে ক্রেতা সাধারণকে বিমুগ্ধ করার মতো এক অনবদ্য উপস্থাপনা। বিভিন্ন নারীর তৈরি কাজ করা থ্রি পিস, বুটিকের শাড়ি, দেশীয় উপাদানে বাহারি অলঙ্কারের দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন, শতীবস্ত্র ব্যাগের অনিন্দ্য সুন্দর শৈল্পিক কারু কাজ ছাড়াও আরও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর সৃষ্টি দ্যোতনা যা নারীদের শিল্প নৈপুণ্যের এক অবিস্মরণীয় সংযোজন। এসব পণ্য শুধু দেশের ক্রেতারা কেনে তা কিন্তু নয় বাইরে থেকে আসা বিদেশীদেরও প্রচুর চাহিদা যা রফতানি শিল্পকেও অনেকভাবে এগিয়ে দেয়। নাজমা মাসুদ লক্ষ্য রাখেন যাতে বিভিন্ন ব্যবসায়িক উৎসবে উদ্যোক্তা নারীরা নিজেদের স্টলে বসে তাদের তৈরি পণ্য ক্রেতাদের সামনে হাজির করতে পারেন। নাজমা মাসুদ নিজেই ফ্রিতে স্টল দিয়ে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রির সুযোগ-সুবিধা করে দেন। এই বিজ্ঞ নারী ক্ষমতায়নের দিশারী মিসেস মাসুদ মনে করেন পুরনো চিন্তা-চেতনা আর দৃষ্টিভঙ্গিকে সময়ের চাহিদায় পাল্টাতে হবে। নারীরা শুধু সফল মা, কন্যা, বধূ কিংবা ঘরনীই নন তারা পারেন আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে সংসারে উপার্জনক্ষম মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে। ক্ষুদ্র পারিবারিক বদ্ধ বৃত্ত থেকে নারীরা আজ তাদের সক্ষমতা ও ক্ষমতায়নে শক্তি অর্জন করে পুরুষের সমগামী হতে বিচক্ষণতার নতুন সম্ভাবনাও নিয়ে আসছে। গত অর্ধশত বছরের অর্থনীতির চাকা আজ নবোদ্যামে গতিশীল হয়ে অর্ধাংশ নারীকেও প্রয়োজনীয় কর্মউদ্দীপনায় উৎসাহিত করছে। ব্যবসা মানেই পুঁজি বিনিয়োগ আর ঝুঁকিপূর্ণ পেশার এক অবিস্মরণীয় মিলনযোগ্য। এক সময়ে যা সাহসী পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর যুগের চাহিদায় নারীরা দুঃসাহসিক মনোবলে ব্যবসা বাণিজ্যের মতো ঝুঁকিযুক্ত পোশাকেও অযতেœ নিয়ে আসতে সময় নিচ্ছে না। নাজমা মাসুদ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন একজন সফল ও কৃতী উদ্যোক্তা আরও অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরি করতে উদ্দীপকের ভূমিকায় নামতে পারেন। ক্ষমতা আর সার্থকতা শুধু নিজের মধ্যেই আঁকড়ে ধরলে চলবে না- তাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলেই সফলতা বহুগুণ বিস্তৃত হবে। ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এই নারী ব্যবসায়িক সংগঠন তার লড়াই, সংগ্রামের অভিযাত্রায় ২ বছর পার করেছে। সব মিলিয়ে উদ্যোক্তার সংখ্যা এখন প্রায়ই ২০০। এখন এই ব্যবসা বাণিজ্য শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই আন্তর্জাতিক বলয়েও এর অভিগামিতা সামনের দিনগুলোতে আরু সম্প্রসারিত এবং বাণিজ্যিকভাবে সক্ষমতার পরিচয় তুলে ধরতে পারদর্শী হবে। এই সংগঠনটির মূল বার্তা ‘আমরা নারী আমরা পারি’ এই মহৎ উদ্দেশ্যে নারী উদ্যোক্তারা স্থানীয় দেশজ পণ্য উৎপাদনে নিজেদের এক বিশিষ্ট স্থানে তৈরি করতে সর্বদাই প্রয়োজনীয় কর্মযোগে নিয়োজিত আছে। নাজমা মাসুদ নিজ সংগঠনের সফল নারীদের সম্মাননা দিয়ে যেমন আনন্দ পান একইভাবে সমাজের অন্য কর্মে নিয়াজিত সফল নারীদেরও পুরস্কৃত করতে উদ্যোগীর ভূমিকা পালন করেন।
×