ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি উত্তোলনে ধস

প্রকাশিত: ১১:৪৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি উত্তোলনে ধস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংকের ঋণ সহজলভ্য না হওয়ায় বিশ্বব্যাপী পুঁজি উত্তোলনে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্বে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে শেয়ারবাজারের ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও চলতি বছরে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহে ধস নেমেছে। যা বিগত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। যাতে শেয়ারবাজারের আকার বৃদ্ধিতে নেতিবাচক ভূমিকা পড়েছে। একইসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ব্রোকারেজ হাউস, সাধারণ বিনিয়োগকারী, মার্চেন্ট ব্যাংক ও সরকার ক্ষতিতে কবলে পড়েছে। তবে এই ক্ষতির পেছনে কোম্পানিগুলোর দুর্বল আর্থিক হিসাব নিয়ে আইপিওতে আসতে চাওয়ার প্রবণতাকে দুষছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষসহ অন্যরা। বিগত ১১ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে সর্বনিম্ন অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বছরে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে ৬৪১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। যার পরিমাণ ২০১৮ সালেও ছিল ৬৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ কমেছে ১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। তবে এই ব্যবধানটা অনেক বড় হতে পারত, যদি রিং সাইন একাই ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন না করত। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে এবং অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজার সেভাবে এগোচ্ছে না। এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে শেয়ারবাজারের অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার। এক্ষেত্রে বেশি বেশি করে ভাল কোম্পানি শেয়ারবাজারে আনতে হবে। বিএসইসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ একটি বড় বাধা। কিন্তু কোন ডায়নামিক উদ্যোক্তা শেয়ারবাজার থেকে ফান্ড সংগ্রহের জন্য ২ বছর অপেক্ষা করবে না। তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ দেয়ার জন্য বসে রয়েছে। এমতাবস্থায় তারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে কোম্পানিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই ভাল কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য এই সমস্যার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তার প্রয়োজন। চলতি বছরে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে ৫টি কোম্পানি ২৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। আর বুক বিল্ডিংয়ে ৩টি কোম্পানি ৩০৭ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এই ২ পদ্ধতিতে ৮টি কোম্পানি মোট ৫৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। আগেরবছরে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে ১১টি কোম্পানি ২৬৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। আর বুক বিল্ডিংয়ে ২টি কোম্পানি ২৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এই ২ পদ্ধতিতে ১৩টি কোম্পানি মোট ৫৪৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) ভাল ও মন্দ উভয় কোম্পানি আসে। ডিসক্লোজারস ভিত্তির আইপিওতে অনেক ফাঁকফোকড় থাকার সুযোগে কিছু দুর্বল কোম্পানি শেয়ারবাজারে চলে এসেছে। তাই বলে আইপিও বাজারে আসা বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ করতে হবে মন্দ আর্থিক প্রতিবেদন। তবে আশার কথা হচ্ছে, ডিএসই এরইমধ্যে একটি আইপিও রিভিউ টিম গঠন করেছে। এই রিভিউ কমিটির প্রধানতম কাজ হবে প্রসপেক্টাসে প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যাদি ও আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে অবজারবেশন দেয়া। যা পরবর্তীতে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদে মাধ্যমে কমিশনে প্রেরণ করা হবে। যা বিএসইসির আইপিও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তিনি আরও বলেন, আমরা কথায় কথায় শেয়ারবাজারে ভাল মানের আইপিও আসছে না বলে থাকি। আসলে ভাল মানের আইপিও বলতে কিছু নেই। আইপিওতে যেসব কোম্পানি আসে তাদের আর্থিক প্রতিবেদনের মান নিয়ে আমরা বলতে পারি। প্রসপেক্টাসে যে আর্থিক প্রতিবেদন থাকে, সেটা কোম্পানি তৈরি করে। ইস্যু ম্যানেজার তা নিয়ে আসে এবং অডিটর সেটায় স্বাক্ষর করে। এএএ ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান বলেন, অনেকে বাজারের মন্দার জন্য আইপিওকে দায়ী করে। কিন্তু প্রায় ৮ মাস ধরে আইপিও বন্ধ থাকলেও বাজারের কোন উন্নতি হয়নি। বরং আরও বেশি তলানিতে গিয়েছে। তাই শেয়ারবাজারের স্বার্থে আইপিও চলমান রাখা দরকার। এতে যোগ্য বিনিয়োগকারীরাসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আইপিও শেয়ারে যেমন কয়েকগুণ লাভবান হয়, একইভাবে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কমিশন বাবদ আয় বাড়ে। এছাড়া তালিকাভুক্তির কারণে স্টক এক্সচেঞ্জ বড় ধরনের ফি পেয়ে থাকে। আর নতুন শেয়ারের আগমনে বাজারে ভাইব্রেন্ট তৈরি হয়। তথ্য উপাত্ত বিশ্লষণে দেখা গেছে, গত ২০১৯ সালে শেয়ারবাজার থেকে সবচেয়ে কম টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বছরটিতে নির্ধারিত মূল্যে ২৪৫ কোটি টাকা, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩০৭ কোটি টাকা রাইটের মাধ্যমে ৯০ কোটি টাকা এবং সবমিলে ৬৪২ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে নির্ধারিত মূল্যে ২৬৬ কোটি টাকা, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ২৮০ কোটি টাকা, রাইট শেয়ারের ১০৯.৪০ কোটি টাকা এবং সবমিলে ৬৫৫.৪০ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৭ সালে ১৩৩ কোটি টাকা নির্ধারিত মূল্যে, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৫৬.২৫ কোটি টাকা এবং রাইট শেয়ারের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ২৭৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সবমিলে ১ হাজার ৪৪২ কোটি ৩৯ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বছরটিতে। ২০১৬ সালে ১৭৪.৭০ কোটি টাকা উত্তোলিত হয়েছিল নির্ধারিত মূল্যে, ৪০৯.৪৪ কোটি টাকা বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে; রাইট আবেদনের মাধ্যমে ৩৫২ কোটি এবং মোট ৯৫০ কোটি ১২ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে নির্ধারিত মূল্যে ৪৩৮ কোটি ১২ লাখ টাকা, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ২৩৭ কোটি ৬০ টাকা এবং বছরটিতে কোন রাইট শেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়নি। সবমিলে বছরটিতে ৬৭৫.৭২ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে ১২শ’ কোটি ৮১ লাখ টাকা, রাইট শেয়ারের মাধ্যমে ২ হাজার ৬৩ কোটি ৪ লাখ টাকা এবং সবমিলে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা উত্তোল করা হয়েছে। যেটি গত ৬ বছরের মধ্য সর্বোচ্চ। ২০১৩ সালে মোট ৯১০ কোটি ৮১ লাখ টাকা, ২০১২ সালে ১ হাজার ৮৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১১ সালে ৩ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বিগত ১১ বছরের মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ২০১০ সালে সবচেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ওই বছরে মোট ৩ হাজার ৩৯০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়। এরপরের অবস্থানে থাকা ২০১১ সালে ৩ হাজার ২৩৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়। ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, দেশে ট্র্যাক রেকর্ড ভাল এমন ১ শত’র বেশি কোম্পানি আছে। এসব কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের মূলধন জিডিপির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এমনকি পাকিস্তানের থেকেও পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা রয়েছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে শেয়ারবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানো দরকার হলেও তা ২০১৯ সালে আরও কমেছে।
×