ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভোগ্যপণ্যের দামে কারসাজি

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

ভোগ্যপণ্যের দামে কারসাজি

বাংলাদেশ উন্নয়নের অভিগামিতায় হরেকরকম কর্মপ্রকল্প সম্প্রসারিত করলেও নানামাত্রিক বিপত্তিকেও পাশ কাটানো সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কৃষিপ্রধান ভূমিনির্ভর দক্ষিণ এশিয়ার এই সমৃদ্ধ অঞ্চলটি তার উৎপাদন স্বয়ম্ভরতায় বিশ্ব সীমায়ও নিজের অবস্থানকে শক্ত করেছে। ধান, সবজি, মাছ এবং ফলমূল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান আজ নজরকাড়া। অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের যাবতীয় পণ্যসামগ্রীর চাহিদা যেমন সরবরাহ তেমন দৃশ্যমান। নিত্যনৈমিত্তিক খাদ্যসামগ্রীর ঘাটতি নেই বললেই চলে। তবে শীত মৌসুমের আগ মুহূর্তে কৃষকের ঘরে ঘরে ফসল ওঠার সময় পর্যন্ত কিছু পণ্যের দাম সামান্য উর্ধগতি হলেও একেবারে সহনীয় পর্যায়ে। মাত্রাতিরিক্ত ঘাটতি কিংবা মূল্যের অস্বাভাবিক উর্ধগতি কোনটাই সেভাবে কাম্য নয়, গ্রহণযোগ্যতাও পায় না। আমাদের কৃষিপণ্যের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারেও। আমরা দেশের ফলনযোগ্য হরেকরকম খাদ্য বিদেশে রফতানিও করে থাকি। সুতরাং ঘাটতির আশঙ্কা যেমন থাকে না নির্দিষ্ট কোন দ্রব্যের, চরম উর্ধগতিও ভোক্তা শ্রেণীর নাগালের বাইরে চলে যায় না। সম্প্রতি পেঁয়াজ নিয়ে যে অশুভ কারসাজি তা ভোক্তা শ্রেণীকে বিভিন্নভাবে আতঙ্কিতই শুধু নয়, কিভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যটি সর্বতোভাবে পরিহার করা যায় তা নিয়ে ভাবনার শেষ-পরিশেষও ছিল না। কারণ সঙ্কট ছিল সেটা বলা যাবে কিনা মুশকিল, বেশি টাকা দিলে পাওয়া তো যাচ্ছিল। ঘাটতি হলে টাকা দিয়েও তা হাতের নাগালে পৌঁছার কথা নয়। পেঁয়াজের এমন অগ্নিমূল্যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসই শুধু নয়, হরেকরকম কৌতুক রসনা, রম্য রচনাও পাশাপাশি চলছিল। পেঁয়াজ নিয়ে এমন তেলেসমাতি স্মরণকালের এক চমকপ্রদ ঘটনা। ৪০ টাকার পেঁয়াজ যখন ৮০ টাকায় ওঠে তখনই ভোক্তা শ্রেণী বিপাকে পড়ে যায়। বিশেষ করে অতি সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত যারা এই বিশেষ খাদ্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল তারা মূলত এক চরম বিড়ম্বনার শিকার হয়। বৃহত্তর এই শ্রেণীর আর্থিক সঙ্গতি কম আবার সর্বাধিক প্রচলিত সুস্বাদু এই খাদ্যের প্রতি আগ্রহ সে মাত্রায় অনেক বেশি। আমাদের মতো সাধারণ মধ্যবিত্তের আওতায় যারা তারা সচেতনভাবেই চিন্তা করতে শুরু করল পেঁয়াজ কম খাওয়া কিংবা একেবারেই বন্ধ করে দেয়া। পেঁয়াজ যখন দিনে দিনে লাফ দিয়ে প্রায় ২৫০-এর অঙ্কে পৌঁছাল সে অবধি মানুষ নাকি ২০ টাকায় ২টা কিংবা ১০০ টাকায় ৫টা পেঁয়াজ কিনে নিত্যদিনের চাহিদাও মেটায় বলে গণমাধ্যমের খবর হয়ে আসে। যাই হোক, পুরো প্রক্রিয়া যে দেশের এক অংশের অশুভ কারসাজি কিংবা শক্ত সিন্ডিকেটের মুনাফা লাভের অসৎ উদ্দেশ্য তাও ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পেতে থাকে। ভারতের মহারাষ্ট্রে বন্যার কারণে সে দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি হলে তারা বাইরে রফতানি বন্ধ করে দেয়। তেমন সঙ্কটও আসলে বাংলাদেশকে বিপন্ন করেছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখার বিষয়। আবার মাঝখানে আঘাত হানা বুলবুলও কি কোনভাবে দায়ী পেঁয়াজকে লাগামহীন করে সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে নিয়ে যেতে? কারণ পেঁয়াজ সঙ্কটের পরবর্তী পর্যায়ে প্রত্যক্ষ করা গেছে বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীর হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে বস্তাবন্দী করে গুদামে ফেলে রাখা, যা এখন পচনশীল অবস্থায় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী কিনে নিচ্ছে নতুবা বস্তাপচা পেঁয়াজ নদীগর্ভে বিলীন করে দেয়া হচ্ছে। আবার এখন বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আসাও শুরু হয়ে গেছে। তার ওপর নতুন পেঁয়াজ পাতা বাজারে দেখা যাওয়া সব মিলিয়ে পেঁয়াজ সঙ্কট ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হবে। তবে যারা মাঝখানে নিজেদের সমৃদ্ধ আখের গোছাতে এমন জনবিরোধী কর্মযজ্ঞে শামিল হয় তাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ইতোমধ্যে পেঁয়াজ ঘাটতির চরম দুঃসময়ে অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা গেছে, যাদের পকেটে প্রচুর অর্থ সংগৃহীত হয়েছে। মাঝপথে এমন সংবাদও গণমাধ্যমকে হতচকিত করে কয়েক শ’কোটি টাকা কতিপয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমান সরকারের শুদ্ধি অভিযানে যেভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে সেখান থেকে অনুমান করা সঙ্গত যে, এসব কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী অর্থলিপ্সু ব্যবসায়ীও জনসম্মুখে অতি শীঘ্রই চিহ্নিত হবে। তবে জনগণ যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল তেমন দুঃসময়কে কিভাবে ফিরিয়ে দেয়া যাবে নতুন পরিস্থিতিতে সে ভাবনাও সংশ্লিষ্টরা ভাবতেই পারে। পেঁয়াজের ওপর এই আগ্রাসী চৌর্যবৃত্তির অস্থিরতা কাটতে না কাটতেই নতুন করে লবণ নিয়ে সঙ্কট তৈরি হওয়ার গুজব রটে যায়। তবে এবার সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাৎক্ষণিক নজরদারি ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে সাময়িক টানাপোড়েন চললেও একদিনের বেশি তা স্থায়ী হতে ব্যর্থ হয়। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে দৃশ্যমান হয় কিভাবে লবণের কারবারে মানুষের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। কেউ কেউ ৫ থেকে দশ কেজি লবণ কিনতে কসুর করল না। তবে লবণের গুজবে সাধারণ মানুষ সন্ত্রস্ত না হলেই পারত। কারণ গণসচেতনতার অভাবেই জনস্বার্থবিরোধী উদ্দেশ্যগুলো তার লক্ষ্যমাত্রাকে ধরতে পারে। ৫ কেজি লবণ একটি পরিবার কত মাসে শেষ করতে পারবে তেমন ভাবনা যদি ভোক্তা শ্রেণীকে তাৎক্ষণিকভাবে তাড়িত করতে পারত তা হলে গুজব কোনভাবেই তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হতো। সবার আগে প্রয়োজন সাধারণ মানুষের বিবেচনা, বিচারবৃদ্ধি, অভীষ্ট পণ্যটির চাহিদাইবা কতখানি, সচেতন দায়বদ্ধতায় অনাকাক্সিক্ষত সঙ্কটকে মোকাবেলা করার উপস্থিত মনোবল। তা হলে ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোন পদক্ষেপ নিতেই হতো না। জনগণই রুখে দাঁড়াবে এমন সব অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগকে মোকাবেলা করতে। নিজের মুক্তির পথ নিজেকেই খুঁজতে হবে অনমনীয় চেতনায়। লবণ গুজবের পরপরই মালিক এবং সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে এ বছর লবণের বাম্পার ফলন হয়েছে। আগামী তিন মাসের লবণও যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ আছে। সুতরাং লবণ সঙ্কটের বিন্দুমাত্র কোন সুযোগ তৈরির আশঙ্কা একেবারেই ক্ষীণ। এ অঘটনগুলো মনে করিয়ে দেয় সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশে ১৯৭৪ সালের সেই মহাসঙ্কট। দুর্ভিক্ষের করাল আবর্তে ফেলে দেয়া এমন সব অশুভ কারসাজি যে কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীর দুরভিসন্ধি তার প্রমাণও জনসম্মুখে চলে আসে। কিন্তু তেমন দুঃসময় পার হওয়ার ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে স্বাধীনতারিরোধীরা নৃশংসভাবে খুন করে। ফলে তথাকথিত দুর্ভিক্ষের চাইতেও দেশকে পড়তে হয় অস্তিত্বের সঙ্কটে। স্বাধীনতার স্থপতিকে চিরতরে মুছে ফেলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লাঞ্ছিত করা থেকে শুরু করে লাল সবুজের পতাকায় যাদের কোন আস্থাই ছিল না তাদের হাতে পুরো দেশ কব্জা হয়ে যাওয়া সুদীর্ঘ একুশ বছরের এক মর্মান্তিক দুর্দশা। সেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে জাতিকে আরও কত দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তেমন দুঃসহ স্মৃতিও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আজও তার সমস্ত সাংঘর্ষিক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনা নিয়ে সক্রিয় এবং সতর্ক। সুতরাং কোন ধরনের গুজব, রটনা কিংবা অকৃত্রিম সঙ্কটে জনগণকেই সচেতন দায়বদ্ধতায় রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধিকে সংহতভাবে সুরক্ষা দিতে না পারলে সমস্ত অর্জন তার মর্যাদা হারাতে সময় নেবে না। অতন্দ্র প্রহরীর দায়বদ্ধতায় শুধু সরকার, সামরিক কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকলে চলবে না, জনগণকেই দেশ ও তার সম্পদের অপার সম্ভাবনাকে প্রতিনিয়ত সুরক্ষা দিয়ে যেতে হবে। সম্প্রতি ভোলায় ঘটে যাওয়া ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করে যে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা তেমন স্পর্শকাতর দুরভিসন্ধি থেকেও দেশ ও জনগণকে বাঁচাতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জাতি আমরা। ’৪৭-এর দেশ বিভাগ এক অবর্ণনীয় দুর্যোগ। তেমন অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে ৩০ লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই সর্বমানুষের স্বাধীনতাকে কোন নির্দিষ্ট বলয়ে আটকে দেয়া যাবে না। যা সুসংহত সম্প্রীতিকে দুর্বল করে দিতে সময় নেয় না। শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষের ভোগান্তিকে পুঁজি করে যারা মুনাফাবৃত্তিকে জিইয়ে রাখে তারা কখনও জনগোষ্ঠীর বন্ধু হতে পারে না। আর সেসব হীন চক্রান্তকারীকে সচেতন মানুষেরই চেনা-জানা সব থেকে জরুরী। কারণ জনগণই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান অংশ শুধু নয়, শাসক শ্রেণীরও ক্ষমতার উৎস। বঙ্গবন্ধু নিজেই বিশ্বাস করতেন সাধারণ দেশপ্রেমিক গোষ্ঠীই ক্ষমতার সর্ববিধ উৎস। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও পিতার এমন আদর্শিক চেতনাকে আজ অবধি লালন ধারণ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেষ্টা করে যাচ্ছেন উন্নত ও আধুনিক সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার জায়গা করে দেয়া। সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সমস্ত অসঙ্গতিকে সমূলে উৎখাত করে বাসযোগ্য একটি নিরাপদ, দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ উপহার দেয়া। সঙ্গত কারণে জনশক্তিকেও অপপ্রচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। লেখক : সাংবাদিক
×