ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কলঙ্কিত দায়মুক্তি আইন-১৯৭৫

প্রকাশিত: ০৯:১২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কলঙ্কিত দায়মুক্তি আইন-১৯৭৫

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের নির্মম হত্যাকা-ের সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী উচ্চতর অর্থবিজ্ঞানে শিক্ষারত ছিলাম। ১৬ আগস্ট সকালে আমি চোখের পানি নিয়ে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড কেনেডির বস্টনের বাসস্থানে গিয়েছিলাম। আগ থেকে না বলে আসা সত্ত্বেও আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাত্রিবাস গায়ে নিয়েই আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আমি কিছু বলার আগেই বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার কথা উল্লেখ করে তিনি চোখের পানি সংবরণ করে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা একি করেছ, এ কেমন করে করতে পেরেছ? এর উত্তর আমি দিতে পারিনি। তার কথাগুলো শেষ করে তিনি বললেন যারা তোমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছে তারা জঘন্যতম দুরাত্মা। গণতন্ত্র ও সভ্যতার জারজ সন্তান। এদের এই জঘন্যতম অপরাধের বিচার তোমাদের করতেই হবে, প্রমাণ করতে হবে, শত বাধা ও ষড়যন্ত্র ছাড়িয়ে জাতি হিসেবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সূত্র অনুযায়ী তোমাদের পরিচিতিকে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে তোমরা সক্ষম। বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঠিক ৯ দিনের মাথায় খন্দকার মোশতাক তার সহযোগী ষড়যন্ত্রকারী জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান পদে আনুষ্ঠানিকভাবে অধিষ্ঠিত করে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকাকালীন ২৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪০ দিনের মাথায় বিশ্বাসঘাতক মোশতাক দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে এই হত্যার জন্য দায়ী সামরিক ও বেসামরিক খুনীদের বিচার করার পথ রুদ্ধ করে দেয়। এরপর ৬ নবেম্বর জিয়াউর রহমান মোশতাককে হটিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে। পরে সে এক ফরমান বলে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর খুনের আসামিদের কৃত অপরাধকে আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে নিয়ে সামরিক আইনের আওতায় জারি করা সকল কার্য, ফরমান ও নির্দেশসমূহকে বৈধতা দিয়ে দায়মুক্তি অধ্যাদেশকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর অবয়বে অধিকতর কালিমালেপন করে প্রসারিত করে। শোনা যায়, এই ৫ম সংশোধনীর খসড়া তৈরি করেছিলেন তৎকালীন আইন সচিব কুদ্দুস চৌধুরী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন সংশ্লিষ্ট কাগজপত্তর ঘেঁটে আমি নিশ্চিত হয়েছি যেÑ ৫ম সংশোধনী প্রস্তুত করার বিষয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোন প্রস্তাব যায়নি। সামরিক আইনের আওতায় নির্বাচিত তখনকার বশংবদ জাতীয় সংসদ এই দায়মুক্তিবিষয়ক সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বিনা বিতর্কে অনুমোদন ও গ্রহণ করে। পরে এরশাদ এই দায়মুক্তির পরিধি তার ক্ষমতা দখলকরণের প্রক্রিয়ায় সংবিধান ও আইন বহির্ভূত কৃত কার্যাদি অন্তর্ভুক্ত করে বিস্তৃত করে। তারপর প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খালেদা জিয়া (১৯৯১-১৯৯৬) পৃথিবীব্যাপী অনুসৃত আইনের শাসনের সূত্র অবজ্ঞা করে এই দায়মুক্তির ৫ম সংশোধনী বহাল রাখেন। পরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা ১৯৯৬-এর ১২ নবেম্বর এই কুখ্যাত দায়মুক্তির আইন অবাধে নির্বাচিত সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনের ভিত্তিতে আইনসঙ্গতভাবে বাতিল করেন এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ১৫ আসামির বিচার সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। ১৯৯৮ এর ৮ নবেম্বর যথা আইনে বিচার সম্পন্ন করার পর আসামিদের মধ্যে ১২ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী ক্ষমতায় এসে এই বিচারের শেষ পর্যায় রুদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালায়। পরে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করার পর ২০০৯ সালে এদের মৃত্যুদ- চূড়ান্তভাবে বহাল হয়। ২০১০ এর ২৭ জানুয়ারি ঐ ১২ জনের মধ্যে দেশে আটককৃত ৫ জনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় প্রত্যাশী আরেক আসামি মেজর মহীউদ্দীনকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। বাকি ৬ জনের মৃত্যুদ- তারা তখন বিদেশে পালিয়ে থাকার কারণে কার্যকর করা যায়নি। এদের মধ্যে একজনের ইতোমধ্যে জীবনাবসান হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় দৃষ্ট কতিপয় ঘটনা উল্লেখ করা সমীচীন। ১৯৭৫-৭৬ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যখনই আমি ও সহযোগী ড. আব্দুস সামাদ আলোচনার সুযোগ পেয়েছি তখনই এ বাংলাদেশের দায়মুক্তি বিষয়ক আইন ও সংবিধানে জোর করে ঢুকানো ৫ম সংশোধনীর অযৌক্তিকতা ও অগ্রহণযোগ্যতা, আইনের শাসনবিরুদ্ধ তৎপরতা এবং সর্বোপরি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছি। মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের বেশ কয়েকজন সদস্য ডেমোক্র্যাট দলের নামত, এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ও বিল রিচার্ডসন এবং রিপাবলিকান দলের জন ম্যাককেইন এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান গ্রহণ করেছেন। সুশীল সমাজের সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক গুস্তাভ পাপানেক, জন হ্যারিস (বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়), পল স্যামুয়েলসন (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়) আমাদের অকৃত্রিম সহানুভূতি জানিয়েছেন। তখনকার পররাষ্ট্র দফতরের বেশ কয়েকজন নির্বাহী যুক্তরাষ্ট্রে গৃহীত মানবাধিকার বিষয়ক আইনের আওতায় যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে খুনীদের আইনী বিচার সম্পন্ন করার ওপর জোর দিয়েছেন। একই সময়ে দেশে কর্মরত সুশীল প্রশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৫ম সংশোধনী প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সচেতনতা প্রসারে আমরা চেষ্টা করি। ১৯৭৬ সালে উচ্চশিক্ষা সমাপনান্তে দেশে ফিরে এসে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আমি যশোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেই। সেই বছরই যশোরে সফরকালীন তৎকালীন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক মেঃ জেঃ সামসুজ্জামান, শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আলী আহসান ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল হকসহ অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান এই দায়মুক্তি আইন নিয়ে সুশীল প্রশাসক হিসেবে আমার মত জানতে চান। আমি নিঃসঙ্কোচে তাকে ও তাদেরকে বলি যে, একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও আইনানুগ রাষ্ট্রে এই ধরনের দায়মুক্তি অসাংবিধানিক ও আইনের শাসন স্থাপনের পথে প্রতিবন্ধক এবং প্রত্যাহার না হলে অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারের সামরিক ও বেসামরিক নির্বাহীদের আইনবহির্ভূত, একপেশে কর্মের সংশোধনে কিংবা প্রতিরোধকরণে কোন অবস্থান নেয়া কিংবা তার প্রতিকার পাওয়া মুশকিল হবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল হক আমার কথা শুনে অবাক হয়েছেন, কিছু বলেননি। শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আলী আহসান বলেছেন, এই ধরনের হত্যাকা-ের উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসে বেশ আছে যা কতিপয় ক্ষেত্রে সময় বিশেষে জনগণের অমঙ্গলকে পরিহারকরণে ফলপ্রসূ হয়েছে। তার এরূপ অবস্থানের বিপরীতে আমি কোন মন্তব্য করিনি। জিয়াউর রহমান তার স্বভাবসুলভ ভুল ইংরেজীতে বলেছেন। তিনি আশা করেন যে, কাজের ক্রমে যথাসময়ে আমার মতো সুশীল প্রশাসকরা ৫ম সংশোধনীর সত্যিকারের তাৎপর্য এবং ভাল দিকটা বুঝতে পারবেন। তিনি এই সংশোধনীর অনুকূলে সুশীল প্রশাসকদের সমর্থন আদায়ের জন্য আমাকে অনুশাসন দেন। এই অনুশাসন অনুযায়ী কাজ করা থেকে দূরে থাকার জন্য আমি বলি, এ বিষয়ে তিনি সুশীল প্রশাসনে কর্মরত উপরের স্তরের নির্বাহীদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। উত্তরটি তার পছন্দ হয়নি বুঝতে পেরেছি। তিনি মুখাবয়ব গম্ভীর করে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে সচিবালয়ে কাজ করার সময় আমি বিষয়টি পরিচিত রাজনীতিবিদ ও সহযোগী সুশীল সেবকদের সঙ্গে আলোচনা করে তা প্রত্যাহারের কথা বলেছি। মনে-পড়ে এককালের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি তখন জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী এস এ বারী এটির সঙ্গে দায়মুক্তি আইনটি প্রত্যাহার করণের যৌক্তিকতা তুলে ধরার পর তিনি চুপ করেছিলেন বেশ কতক্ষণ। তারপর চোখ মুছে স্মিত হেসে বললেনÑ একদিন না একদিন এই দাবি সরকারকে মানতে হবে। এরশাদের সময়কার মন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। তার সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা মনে করে চোখ মুছেছিলেন কয়েকবার এবং তারপরে বলেছিলেন তিনি তার তখনকার রাজনৈতিক প্রভু এরশাদের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করবেন। করেছিলেন কিনা জানতে পারিনি। এরশাদ অবশ্য আমার চাকরির মই ধরে এগিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে সবসময়ই চেষ্টা করেছিলেন। এ বিষয়ে প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম ও এ্যাডভোকেট এ কে বদরুল হকের সঙ্গে আমি নির্দ্বিধায় কথা বলেছি। তারা দু’জনই এই সংশোধনীতে মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে এর প্রত্যাহারের অনুকূলে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছিলেন। ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এরশাদের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে প্রশংসনীয়ভাবে সক্রিয় ছিলেন। তার সঙ্গে আলোচনাক্রমে আমি প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন করার বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত সাংবিধানিক অনুজ্ঞার (অনুচ্ছেদ-১৭) কথা তুলে জাতির পিতার মর্মান্তিক হত্যার ঈপ্সিত বিচারের জাতীয় প্রয়োজনের কথা বলেছি। তিনি বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছেন, আপনাদের অনুভূতি বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকাশ করতে থাকুন। আমি আপনাদের এই অবস্থান সমর্থন করে যাব। (বাকি অংশ আগামীকাল) লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×