ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

রশীদ জুজুতে কাঁপছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 রশীদ জুজুতে কাঁপছে বাংলাদেশ

মিথুন আশরাফ ॥ আফগানিস্তানের জন্য যে কুয়া খোঁড়া হয়েছিল সেই কুয়ায় বাংলাদেশই পড়ল। স্পিন দিয়ে আফগানদের ইনিংস ধসের ভাবনা ছিল। উল্টো সেই স্পিনে বাংলাদেশ ইনিংসেই ধস নামল। ৪ উইকেট শিকার করা রশীদ খানের স্পিন জুজু এমনভাবেই জেঁকে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের, তাতে তছনছ হয়ে গেল ইনিংস। কাঁপছেন সাকিবরা। দ্বিতীয়দিন শেষ হওয়ার আগে প্রথম ইনিংসে ৮ উইকেট হারিয়ে ১৯৪ রান করে ১৪৮ রানে পিছিয়েও আছে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের প্রথম ইনিংস ৩৪২ রানে শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের দুই ওপেনার সাদমান ইসলাম ও সৌম্য সরকার ব্যাটিংয়ে নামেন। যেভাবে রহমত শাহ ও আসগর আফগান ব্যাটিং করেছেন তাতে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদেরও ভাল কিছু করারই কথা। কিন্তু রানের খাতা খোলার আগে প্রথম ওভারের চতুর্থ বলেই সাদমান আউট হয়ে যান। উইকেটটি নেন আবার আফগান পেসার ইয়ামিন আহমেদজাই। বাংলাদেশ দলে কোন স্পেশালিস্ট পেসার খেলানো হয়নি। তবে আফগানরা সেই কাজ করেননি। ইয়ামিনকে ঠিকই খেলান। তাতে শুরুতেই সাফল্যও মিলে। সাদমানের উইকেট পড়ার পর তো আফগান স্পিনাররা এমনভাবে জেঁকে ধরেন, টপাটপ উইকেট পড়তে থাকে। দেখতে দেখতে এক শ’ রানের আগেই ৮৮ রানে নেই ৫ উইকেট। ১০৪ রানেই ৬ উইকেট খতম হয়ে যায়। দলের ৩৮ রানের সময় মোহাম্মদ নবীর বলে সৌম্য সরকার এলবিডব্লিউ হন। এরপর রশীদ খান যে ঘূর্ণি ছোবল দিতে শুরু করেন তাতে লিটন কুমার দাস, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীমের পর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও কুলকিনারা খুঁজে পান না। লিটন কিছুটা টিকে থাকেন। ৩৩ রান করেন। কিন্তু সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ তো উইকেটে আসা আর সাজঘরে ফেরার মিছিলে যোগ দেন। তাদের নিয়ে কত ভরসা। এমন একটি ম্যাচে তো তাদেরই হাল ধরার কথা। অথচ তারা এমনই ব্যর্থ হয়েছেন দল মহাবিপদে পড়ে গেছে। রশীদ যে কতটা ভয়ঙ্কর স্পিনার তা আবারও বুঝিয়ে দিলেন। মুহূর্তেই চার উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের ইনিংসের মেরুদন্ডই ভেঙ্গে দেন। একটা সময় তো মনে হয় ফলোঅনেই না আবার পড়ে যায় বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে ১৪২ রানের ওপরে করতে না পারলেই তো ফলোঅনে পড়বে। মুমিনুল হক উইকেট আঁকড়ে থাকেন। সঙ্গে ব্যাটিংয়ে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও মেহেদী হাসান মিরাজ থাকাতে অন্তত ফলোঅন এড়াতে পারবে বাংলাদেশ, সেই ভরসা থাকে। কিন্তু যখন দলের ১৩০ রান হয়, নবীর ঘূর্ণি বলের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশের ইনিংসের একমাত্র হাফ সেঞ্চুরিয়ান মুমিনুলও (৫২) সাজঘরে ফেরেন; তখন কিছুটা কম্পন অনুভূত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত মোসাদ্দেক ও মিরাজ মিলে সেই লজ্জা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেন। কিন্তু রক্ষা করলে কি হবে, মিরাজও খুব বেশিক্ষণ টিকে থাকতে না পেরে কাইস আহমেদের স্পিনে ধোঁকা খেয়ে বোল্ড হয়ে যান। এরপর বাকি থাকেন মোসাদ্দেক। সঙ্গে তাইজুল ইসলাম আর নাঈম হাসান। তাইজুল আর নাঈমকে নিয়ে তো আর এতটা ভরসা করা যায় না। কিন্তু তাইজুলই দেখিয়ে দিলেন ব্যাটিং। টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং করে ৫৫ বল খেলে ১৪ রান করে এখনও ব্যাট হাতে আছেন। মোসাদ্দেক হোসেন শেষ মুহূর্তে হাল ধরেছেন। তিনি ৭৪ বলে ১ চার ও ২ ছক্কায় ৪৪ রান করে ব্যাটিংয়ে আছেন। মোসাদ্দেক একদিক আগলে রেখেছেন। আরেকদিক আগলেছেন তাইজুল। তাতে নবম উইকেটে গিয়ে ৪৮ রানের মহাগুরুত্বপূর্ণ জুটিও গড়েছেন এ দুই ব্যাটসম্যান। চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে সবচেয়ে বড় জুটিও এটি। এ জুটিটি না হলে বাংলাদেশ দুই শ রানের কাছে যেতে পারতো না। একটা সময় যেখানে ফলোঅনে পড়ার সম্ভাবনা জাগে, সেখান থেকে ১৯৪ রান করে ২ উইকেট হাতে রেখে দ্বিতীয়দিন শেষ করাও স্বস্তিরই। তবে অস্বস্তি এখনও কাটেনি। এ জুটি কিংবা অলআউট হওয়ার আগে বাংলাদেশ যদি আড়াই শ’ রানে যেতে পারে এরপর আফগানদের দ্রুতই অলআউট করে দিতে পারে তাহলে মিলবে স্বস্তি। কম টার্গেট যদি মিলে। সেই টার্গেট নিয়ে প্রথম ইনিংসে ব্যর্থতার বৃত্তে আটকে থাকা অভিজ্ঞ, ভরসাবান ব্যাটসম্যানরা যদি দ্বিতীয় ইনিংসে টার্গেট অতিক্রম করতে পারে তাহলে জয় আসবে। আর না হলে প্রথম ইনিংসের মতো হাবুডুবু খেলে হারের সম্ভাবনাই থাকছে। আজ তৃতীয়দিনটি কেমন হয়, সেটির ওপরেই আসলে টেস্ট কোনদিকে মোড় নেবে তা বোঝা যাবে। মোসাদ্দেক ও তাইজুল ব্যাট হাতে সেই দিনটি শুরু করবেন। স্পেশালিস্ট পেস বোলার না নিয়ে শুধু স্পিন শক্তি ভরপুর করে নামে বাংলাদেশ। আফগানিস্তান আগে ব্যাটিং করে। তাতে মনে হয়েছিল, স্পিনারদের জন্য বধ্যভূমিতে সাকিব, তাইজুল, মিরাজ, নাঈমের সঙ্গে মাহমুদুল্লাহ, মোসাদ্দেক, মুমিনুলরা ছন্নছাড়া করে দেবেন আফগান ব্যাটিং লাইনআপ। কিন্তু রহমত শাহ’র ইতিহাস গড়া ১০২ রানের ইনিংসের পর আসগর এতটাই দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন, প্রথমদিনেই ৫ উইকেট হারিয়ে ২৭১ রান করে ফেলে আফগানরা। তখনই আসলে বিপদ সঙ্কেত মিলে। ২০১৭ সালের জুনে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর মাত্র দুই টেস্ট খেলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলতে নামা আফগানিস্তানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রশীদ। সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়কের রেকর্ড গড়েছেন তিনি। তার এমন টেস্টে বাংলাদেশ এমন বিপদে পড়বে তা কেউই ভাবতে পারেনি। প্রথমদিন যে দাপট দেখায় আফগান ব্যাটসম্যানরা, দ্বিতীয়দিন তা বজায় রাখতে পারেনি। আসগর প্রথমদিনের ৮৮ রানের সঙ্গে আর ৪ রান যোগ করেই আউট হয়ে যান। সেঞ্চুরি হাতছাড়া হয় আসগর আফগানের। আফসার জাজাইও প্রথমদিনের ৩৫ রানের সঙ্গে আর ৬ রান যোগ করতে পারেন। তবে রশীদ ব্যাট হাতে এমন ধুন্ধুমার ব্যাটিং করতে থাকেন যেন টি২০ বা ওয়ানডে খেলছেন। আর সামনে টার্গেট আছে। যে টার্গেট অতিক্রম করার তাড়াও আছে। একের পর এক ছক্কা-চার হাঁকাতে থাকেন রশীদ। তার আর কোন পথও খোলা ছিল না। কারণ বাকি যারা ব্যাটিংয়ে ছিলেন তাদের নিয়ে কোন ভরসা ছিল না। যা করার রশীদকেই করতে হতো। সেই সুযোগটি কাজেও লেগে যায়। দলকে ৩০০ রানের ওপরে নিয়ে যান রশীদ। এরপর এক এক করে উইকেট পড়তে থাকে। তবে হাল ছাড়েন না। মারমুখী ব্যাটিং করতে থেকে ৬১ বলে ২ চার ও ৩ ছক্কায় ৫১ রান করেন তিনি। দলের ৩৪২ রানে যখন রশীদ আউট হন তখন আফগানিস্তানও অলআউট হয়ে যায়। দ্বিতীয়দিন হাতে থাকা ৫ উইকেটে ৭১ রানের বেশি স্কোরবোর্ডে জমা করতে পারেনি আফগানিস্তান। ২১ ওভারের বেশি খেলতেও পারেনি। তাইজুল দ্বিতীয়দিনেও শুরুতে উইকেট নিতে থাকেন। প্রথমদিন ২ উইকেট শিকার করেন। দ্বিতীয়দিনেও সমান সংখ্যক উইকেট নেন। তাইজুলের সঙ্গে এদিন অসময়ে ভেল্কি দেখিয়ে ২ উইকেট নেন সাকিবও। আফগানিস্তান সাড়ে তিন শ’ রান করতে পারেনি। তবে যে রান করেছে তাতেই তো বাংলাদেশের কাঁপন ধরে গেছে। সেই কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছেন রশীদ। তাকে নিয়ে আগে থেকেই ভয় কাজ করছিল। তিনি যে হুমকি তা ক্রিকেটারদের মনের ভেতর আগে থেকেই ছিল। সেই ভয়, জুজুই শেষ পর্যন্ত ডুবিয়ে দিচ্ছে। ব্যাটসম্যানরা শুধু রশীদ ভয়েই নয়, স্পিন ভয়ে কেঁপেছে। আর টপাটপ উইকেট পড়েছে। তাতে কাঁপছে বাংলাদেশ ক্রিকেট।
×