ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উড়ন্ত পায়রা

প্রকাশিত: ০৭:১০, ১০ আগস্ট ২০১৯

উড়ন্ত পায়রা

প্রথমবারের মতো ঈদ করতে দেশে আসবে রাতুল। রাতুলের জন্ম কানাডায়। বাবা-মার সঙ্গে ওখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে সে। এর আগে কখনও দেশেও আসা হয়নি তার। দেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানারও সুযোগ হয়নি। কিন্তু এখন ভালভাবে বুঝতে শিখেছে সে। স্কুলের বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের বইও পড়তে শিখেছে টুকটাক। ইন্টারনেট আর ইউটিউব ঘেটে দেশ সম্পর্কে জেনেছে কিছুটা। এভাবেই নিজের দেশের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে জেগেছে রাতুলের মনে। বিশেষ করে ঈদের সময়টা নিয়ে বেশ আগ্রহী সে। কানাডা আর বাংলাদেশের ঈদ পালনে অনেক রকমের তফাত। সেটা জেনেই বাংলাদেশে গিয়ে ঈদ করার জন্য বাবার কাছে বায়না শুরু করে রাতুল। মা- বাবাও খুব সহজেই রাজি হয়ে গেলেন ছেলের কথায়। সত্যিই তো, দেশে এত বড় পরিবার তাদের। সবাই মিলে এখনও একই বাড়িতে বসবাস করেন তারা। ঈদের দিন সকালে বাড়ির ছোটরা সালাম করে সালামি আদায় করে বড়দের কাছ থেকে। এরপর গোসল করে ফিরনি, শেমাই, পায়েস খেয়ে নামাজে যায় সব ছেলেরা। ঈদ-উল-আজহার আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে কোরবানি দেয়া। নামাজ থেকে ফিরেই কোরবানির কাজ শুরু করা হয়। কোরবানির কাজ শেষ হলে রান্না-বান্নার কাজ শুরু করেন বাড়ির মা-বোনরা। এই সময় কে সবার আগে কোরবানির মাংস মুখে দিতে পারবে, তা নিয়ে ছোটদের মাঝে এক রকমের প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে যায়। এই জিনসগুলো তো রাতুল কখনই উপভোগ করার সুযোগ পায়নি। বিদেশের মাটিতে মা- বাবার ছোট্ট সংসারে বড় হচ্ছে সে। এখানকার ঈদের দিনের নামাজ পড়া, খাওয়া-দাওয়া বা কোরবানির সঙ্গেও পরিচিত রাতুল। তবে বাংলাদেশের মতো এতটা জমকালোভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ তো হয়নি তার। কাজেই এবারের ঈদটা দেশে গিয়ে করাই যেতে পারে। নিজের পরিবারের লোকজনদের সঙ্গেও দেখা হবে অনেকদিন পর। ঠিক সময়ে মা-বাবার সঙ্গে দেশে পৌঁছালো রাতুল। প্রথমবারের মতো দাদাবাড়ি দেখতে পেরে ভীষণ খুশি সে। বড় একটা বাড়িজুড়ে দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, কাজিনরা সবাই একই সঙ্গে থাকে। ঈদ উপলক্ষে তাদের মতো ফুফু-ফুফা আর ফুফাতো ভাই-বোনরাও এসেছে এ বাড়িতে। বেশ অবাকই হলো রাতুল। বিদেশে কখনই এতগুলো লোককে একসঙ্গে একই বাড়িতে থাকতে দেখা যায় না। তাদের ওখানকার বাড়িটাও তো বেশ বড়ই। অথচ মানুষ মাত্র তিনজন। যে যার কাজে ব্যস্ত। মা-বাবা অফিস থেকে ফেরেন রাতের বেলা। আর সে নিজেও তো সারাদিন স্কুল, বাস্কেটবল প্র্যাকটিস, সুইমিং এসব নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকে। একসঙ্গে রাতের খাবারটাও খাওয়ার সুযোগ হয় না তাদের। অথচ এখানে একইসঙ্গে বসে কি সুন্দর গল্প গুজব করতে করতে খাবার খায় সবাই। প্রথমদিন জার্নি করে বেশ ক্লান্ত ছিল রাতুল। রাতের খাবার খেয়ে বেশ জলদি জলদিই ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই। বাড়িটাও পুরোপুরি ঘুরে দেখবার সুযোগ হয়নি তার। পরদিন সকালে একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙল রাতুলের। নাস্তা করে এবার ছোট ছোট পায়ে বাড়িটা ঘুরে দেখতে লাগল সে। ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির বাম পাশে ছাদে ওঠার সিঁড়ি চোখে পড়ল তার। সেই সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে আসল রাতুল। ছাদে গিয়ে ছোট চাচ্চুকে একটা পাখি হাতে নিয়ে খেলতে দেখল সে। মনে মনে বলল, ছোট চাচ্চু কত বড় হয়ে গিয়েও ছোটদের মতো পাখি নিয়ে খেলছে! এদিকে রাতুলকে খেয়াল করা মাত্রই কাছে ডাকলেন ছোট চাচ্চু। জিজ্ঞেস করলেন, নাস্তা করেছ বাবা? -জ্বি চাচ্চু। পাখি হাতে নিয়ে কি করছেন আপনি? -এটাকে আমরা পায়রা বলি রাতুল। অনেকে কবুতরও বলে থাকে। আসলে ঈদের এই সময়টায় আমাদের এলাকায় পায়রা ওড়ানোর খেলা হয়। এটা এক ধরনের প্রতিযোগিতাও বলা যেতে পারে। আগামীকাল আমি আর তোমার রায়ান ভাইয়া সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেব। তার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা। কিছুই বুঝতে পারল না রাতুল। পাখি ওড়ানোর আবার প্রতিযোগিতা হয় কিভাবে! রাতুলের মুখ দেখে বুঝতে পারলেন ছোট চাচ্চু। বললেন, এমন খেলার কথা আগে কখনও শোননি বা দেখওনি তাই তো? -জ্বি। -এটা আমাদের দেশের অনেক পুরনো এবং বেশ জনপ্রিয় একটা খেলা। আগের তুলনায় এখন আর এই খেলা খুব বেশি দেখা যায় না। তবে প্রতিবছর ঈদের এই সময়ে আমাদের এলাকায় এখনও এর আয়োজন করা হয়। অনেকগুলো প্রতিযোগী নিজেদের পায়রা একসঙ্গে আকাশে উড়িয়ে দেয়। এরপর যার পায়রা সবার আগে গিয়ে ঠিক করে দেয়া সীমানায় পৌঁছায়, সেই বিজয়ী হয়। -পায়রাগুলো সীমানা বোঝে কিভাবে? বরং ওরা তো যে যার মতো করে যে কোনদিক চলে যেতে পারে। তখন প্রতিযোগিতার কি হবে? রাতুলের কৌতূহলী প্রশ্নে হাসলেন ছোট চাচ্চু। এবার আরেকটু খুলে বলতে শুরু“করলেন তিনি। বললেন, আমার হাতের পায়রাটির নাম হোমার। সাধারণত পায়রা ওড়ানোর খেলায় এই পায়রাগুলোই আকাশে ওড়ানো হয়। তবে প্রতিযোগিতার আগে খুব ভাল মতো পোষ মানিয়ে নিতে হয় এদের। প্রথমে খাঁচার ভেতরে রেখেই পোষ মানানো শুরু করা হয়। এরপর প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য এদের প্র্যাকটিস শুরু হয়। যেমন, ধর ছাদের এপাশ-ওপাশ করে আমি আর রায়ান দাঁড়িয়ে থাকি। আর আমাদের দুজনের পাশে পায়রার জন্য খাবার রেখে দেই। পোষা পায়রা হওয়ায় দুজনকেই চেনেও। কাজেই একজন একপাশ থেকে পায়রা উড়িয়ে দিলে অপরজনের কাছে এসেই থেমে যায়। পুনরায় ওকে উড়িয়ে দিলে প্রথমজনের কাছে উড়ে যায় পায়রা। বিনিময়ে ওকে সাধারণত যে খাবার দেয়া হয়, তার চাইতে ভাল কোন খাবার দেয়া হয়। তখন ও এটাকে ওর উড়ে যাওয়া আসার পুরস্কার বলে মনে করে। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার মতো উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠে পায়রাগুলো। আর প্রতিযোগিতার দিনও ঠিক একইভাবে সীমানার দুইপাশে দুইজন করে দাঁড়াবো আমরা সব পায়রার মালিকরা। এভাবে যে পায়রাটি বেঁধে দেয়া সময়ের মাঝে সবচেয়ে বেশিবার উড়ে যেতে ও আসতে পারবে, সেই হবে বিজয়ী। পুরস্কার জিতে নেবে বিজয়ী পায়রার মালিক। গতবার আমরাই বিজয়ী হয়েছিলাম। সবকিছু শুনে খেলার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে গেল রাতুলের। পরেরদিন বাড়ির সবার সঙ্গে সেও মাঠে খেলা দেখতে গেল। ছোট চাচ্চু আর রায়ান ভাইয়া দুইজন মাঠের দুইপাশে গিয়ে দাঁড়াল। রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আকাশে উড়িয়ে দিল নিজেদের পায়রাগুলো। কি সুন্দর দৃশ্য! পায়রাগুলো মাঠের এপাশ-ওপাশ করে উড়ে আসছে আর যাচ্ছে বারবার। আর প্রতিযোগিতা দেখতে আসা মানুষগুলো খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠছে প্রতিবার।
×