ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরগঞ্জ জেলার নাজিরপুর গ্রামে ক্ষুদ্র ঋণ পরিস্থিতি

ঋণের জালে বন্দী হচ্ছে দরিদ্র পরিবার

প্রকাশিত: ১১:৫৩, ৯ আগস্ট ২০১৯

ঋণের জালে বন্দী হচ্ছে দরিদ্র পরিবার

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কিশোরগঞ্জ জেলায় অষ্টগ্রাম উপজেলার অন্তর্গত নাজিরপুর গ্রাম। এ গ্রামের ৩৫ পরিবার ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা থেকে একাধিক ঋণ নিয়েছে। ৩৫ পরিবারের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১,৮১২,০০০ টাকা, যা পরিবার প্রতি গড়ে ৫১,৭৭১ টাকা। সর্বাধিক ২২টি ঋণ প্রদান করেছে আশা, তারপর ব্র্যাক ১১টি, অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান ৭টি, একটি বাড়ি একটি খামার ৫টি, একটি গ্রাম সমবায় সমিতি ৪টি, পদক্ষেপ ১টি এবং সিভিও ১টি। ৩৫ পরিবারের মধ্যে পাঁচ পরিবারে একসঙ্গে ৩টি ঋণ এবং নয় পবিরারে একসঙ্গে ২টি ঋণ চলমান আছে। পরিবারগুলোর মধ্যে তাহুজা (স্বামীর নাম পান্ডু) ঋণ নিয়েছেন তিনটি। তার মোট টাকার পরিমাণ এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। তিনি দুটি ঋণ নিয়েছেন আশা থেকে এবং একটি ব্র্যাক থেকে। একটি ঋণ হচ্ছে একটি গরু কেনার জন্য এবং বাকি দুটি হচ্ছে কৃষি ঋণ। কিন্তু এ তিনটি ঋণই অন্য ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। তিনটি ঋণের জন্য সাপ্তাহিক কিস্তির পরিমাণ ১৪ হাজার টাকা। তাহুজার এক প্রতিবেশী রফিকুল ইসলামের স্ত্রী তানজিনাও নিয়েছেন তিনটি ঋণ। তার মোট ঋণের পরিমাণ হচ্ছে এক লাখ টাকা, যার সাপ্তাহিক কিস্তির পরিমাণ ১৩ হাজার টাকা। তিনি দুটি ঋণ নিয়েছেন আশা থেকে এবং একটি ব্র্যাক থেকে। ঋণ গ্রহণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ফল বিক্রয়, গরু ক্রয় এবং ঝালমুড়ি বিক্রয়। কিন্তু বড় ঋণের অর্থ অর্থাৎ ৭০ হাজার টাকা ব্যবহার করা হয়েছে ঋণের কিস্তি পরিশোধে এবং অপর দুটি ঋণ যার প্রত্যেকটি ৩০,০০০ টাকা করে ব্যবহার করা হয়েছে সিজার অপারেশনের জন্য। তাদের মতো জমসরের স্ত্রী আয়েশাও নিয়েছেন তিনটি ঋণ। তার মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা। এর সবকটি ঋণই নেয়া হয়েছে কৃষি কাজের জন্য। একটি ঋণ নিয়েছেন ব্র্যাক থেকে, একটি আশা থেকে এবং তৃতীয়টি মাহাজনের কাছ থেকে। আয়শাকে কিস্তি হিসেবে প্রতি সাপ্তাহে ৩,০০০ টাকা প্রদান করতে হয় এবং বছর শেষে মাহাজনকে ২০ হাজার টাকা ঋণের জন্য ২৮ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে। দুটি ঋণের টাকা ব্যয় হয় ডাক্তারী চিকিৎসার কাজে এবং অন্যটি দিয়ে ঋণ ফেরত দেয়া হয়। আছুন আলীর স্ত্রী গোলাপীও নিয়েছেন তিনটি ঋণ, যার মোট ঋণের পরিমাণ ৭০ হাজার টাকা। এর সবকটিই নেয়া হয়েছে কৃষি কাজের জন্য। একটি ঋণ নিয়েছেন ব্র্যাক থেকে, একটি আশা থেকে এবং তৃতীয়টি মাহাজনের কাছ থেকে। তারা কিস্তি হিসেবে প্রতিমাসে মাহাজনকে প্রদান করেন ২ হাজার ২০০ টাকা এবং প্রতি সাপ্তাহে ব্র্যাক এবং আশাকে প্রদান করে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। যদিও ঋণগুলো কৃষি কাজের জন্য, ক্ষুদ্র ব্যবসা, গরু ক্রয়, নৌকা জাল ক্রয় ইত্যাদির কথা বলে নেয়া হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঋণগুলো ব্যবহার করা হয়েছে পূর্বের ঋণ সমন্বয় করার জন্য, ঘর মেরামত, চিকিৎসা এবং বাচ্চাদের শিক্ষা ও খাবার ক্রয় করার জন্য। যে ৩৫ দরিদ্র্য পরিবার মোট ৫৪টি ঋণ নিয়েছেন তার মধ্যে মাত্র ১০টি ঋণ তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে (২টি ঋণের টাকা দিয়ে তাদের ছেলেদের বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য পাঠানো হয়েছে, কৃষি জমি লিজ নেয়া এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে)। কিন্তু অন্য সব ক্ষেত্রে ঋণগুলো ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে অর্থনৈতিকভাবে কোন উপকার পাওয়া যাচ্ছে না বরং অর্থনৈতিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবের গ্রামের দারিদ্র্য পরিবারগুলোকে উচ্চ সুদের ঋণের জালে বন্দী করে ফেলেছে। একাধিক ঋণদানকারী সংস্থা একই এলাকায় কাজ করার কারণে সুবিধাভোগীরা আর্থিক উন্নয়নের পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে ঋণের জালে বন্দী হয়ে পড়ছে। এতে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসার প্রসার ঘটছে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারগুলোর দারিদ্র্য নিরসনের পরিবর্তে একাধিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অপব্যবহারের কারণে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রামের (পিইপি) প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম ক্রিস্টেনসেন বলেন, সম্প্রতি আমি পিইপির তিন সামজ কর্মী নিয়ে নাজিরপুর গ্রাম পরিদর্শন করেছি। আমাদের নিয়ম অনুযায়ী, আমরা কেবল আমাদের লক্ষিত গরিব পরিবারগুলোই পরিদর্শন করে থাকি। নাজিরপুর গ্রামে এ রকম ৩৫ পরিবার আছে। তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘মাইক্রো-ক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে দরিদ্র পরিবারগুলোকে অধিক পরিমাণে এবং উচ্চ সুদে ঋণ দিয়ে এক প্রকার বন্দী করে রেখেছে, এটা অবগত হওয়ার পর আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি। সরকার যদি দারিদ্র্য নিরসনের ব্যাপারে আন্তরিক হয়, তাহলে এ বিষয়ে একটি তদন্ত হোক। আমাদের মাঠকর্মীদের মতে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত মাইক্রো-ফাইন্যান্স বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত।’ তিনি বলেন, গরিবদের ঋণ দিয়ে তাদের পরিবার, অর্থনীতি ও সম্পদ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করতে হবে, যাতে তারা দারিদ্র্য থেকে আত্ম-নির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে পারে। নাজিরপুর গ্রামে ৩৫ পরিবারের ঋণ সংক্রান্ত যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম (পিইপি) ঠিক তার বিপরীত কাজ অর্জনের জন্য চেষ্টা করে আসছে। আমাদের প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির মাধ্যমে ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৯৪১ পািরবারকে (২,৭৯,৭০৫ জন) দারিদ্র্যমুক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক উইলিয়াম ক্রিস্টেনসেন গত ৩৩ বছর ধরে দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করে আসছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম (পিইপি)। এই এনজিওর মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্যবিমোচনের একটি মডেল প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মাইক্র-ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) কী এসব বিষয় দেখভাল করার দয়িত্বপ্রাপ্ত নয়, যদি তাই হয়, তাহলে অতি দ্রুত প্রতিষ্ঠানটিকে এ বিষয়ে আশু সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে এবং মাইক্র-ফাইন্যান্স প্রাতিষ্ঠানগুলো দ্বারা দরিদ্র পরিবারগুলোকে নিয়ে ব্যবসা করা থেকে বিরত রাখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দরিদ্র মানুষদের যে ঋণগুলো দেয়া হয় তা যেন অবশ্যই তাদের পরিবারের উন্নয়নে ব্যবহার হয় এবং তাদের দারিদ্র্য অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে সহায়ক হয়।’
×