ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

২ আগস্ট, ১৯৭১;###;শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

একই ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে পাকিস্তানও

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ২ আগস্ট ২০১৯

একই ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে পাকিস্তানও

১৯৭১ সালের ২ আগস্ট দিনটি ছিল সোমবার। লে. হারুনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কুমিল্লার উত্তরে পাকবাহিনীর কালামছড়ি চা বাগান ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর গ্রেনেড বিস্ফোরণে পাকবাহিনীর ১০টি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং ৫০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকবাহিনীর ভূরুঙ্গামারী কলেজ অবস্থানের ওপর প্রচ- আঘাত হানে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধা আনসার আলী শহীদ হন এবং কয়েকজন আহত হয়। কুমিল্লা জেলার হরিশ্বরদার হাটের কাছে মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশ দল পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা মর্টার ও কামানের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। সারা দিনের যুদ্ধে ২৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এদিন সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেক্টরে মুক্তিফৌজের আক্রমণে আমপারা চা বাগানে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। তারা ২৮টি সামরিকযানে তেলিয়াপারা থেকে মাধবপুরে যাচ্ছিল। কুমিল্লার উত্তর সাব সেক্টরে মুক্তিসেনাদের ঝটিকা আক্রমণে প্রায় ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। আনন্দপুর, শ্রীমন্তপুর, আজানপুর, চারনাল ও হরিমঙ্গলে সফল এ্যামবুশ করে মুক্তিবাহিনী। আজানপুরে এলাকাবাসীর সহায়তায় একটি সেতু ধ্বংস করা হয়। মুক্তিফৌজের গেরিলারা কুখ্যাত রাজাকার চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল আবুল খায়েরকে হত্যা করে। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এ্যালেক ডগলাস হিউম বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা পাকিস্তান সরকারকেই নিতে হবে। আমরা যত শীঘ্রই সম্ভব একটি সমাধান দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তেহরানের দৈনিক কায়হান ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে জানান, সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় পরিষদ কর্তৃক গঠিত বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার আগে কোন ব্যক্তি বা দল বিশেষের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। টনি ক্লিফটন ‘নিউজ ইউক’ পত্রিকায় লেখেন, একজন মাত্র লোকই আছেন পৃথিবীতে যিনি পাকিস্তানকে এখনও রক্ষা করতে পারেন। তিনি হচ্ছেন মুজিব। ইয়াহিয়া বলেছেন, মুজিবকে মরতেই হবে। কিন্তু যেদিন তার ফাঁসি হবে, সেই একই ফাঁসির দাঁড়িতে ঝুলবে পাকিস্তান। টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নদী পেরিয়ে, মহাসড়ক ধরে, অসংখ্য বনবাদাড় মাড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অসংখ্য লোক ভারতে এসে ঢুকেছে। সে এক বিপুল জনস্রোত। ম্যাগাজিনটি ‘বাংলাঃ একটি জাতির হত্যা’ শিরোনামে কভার পেইজ স্টোরিও প্রকাশ করে। টাইম ম্যাগাজিন কভার স্টোরিতে লিখেছিল, ‘নির্বাচনের বিজয় বুঝায় যে, মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। এটা এমন একটা বিষয় যা ইয়াহিয়া আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি। ‘টাইম-এর আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মুক্তিবাহিনীর অর্ধেক, প্রায় ৫০,০০০ সৈনিক, এসেছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বাঙালী পুলিশদের ভেতর থেকে। এছাড়া রয়েছে যুবক গেরিলা যোদ্ধারা যাদের অধিকাংশই ছাত্র। গেরিলারা ঢাকায় দুর্বার আক্রমণ পরিচালনা করেছে। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ‘কুমিল্লা বাংলাদেশের থেকে বিচ্ছিন্ন’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, কুমিল্লা ভারতের পূর্ব সীমান্তের এলাকা। এর সঙ্গে কার্যত বাংলাদেশের বাকি অংশ সুকাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনী পাওয়ার ট্রান্সমিশন পাইলন এবং একটি প্রধান সেতু ধ্বংস করে। সংবাদ সপ্তাহ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের হালুরঘাট গ্রামের কতগুলো যুবককে একত্র করা হয়েছে। একজন পাকসেনা কমান্ডার তাদের অবহিত করে যে আহত সৈন্যদের জন্য জরুরীভাবে রক্তের প্রয়োজন। গত সপ্তাহে, সংবাদ সপ্তাহের লরেন জেনকিন্স পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার ওপর পাঠানো তারবার্তা যে কিনা জেনারেল টিক্কা খানের সেনাবাহিনীর হত্যাকা- আরম্ভ করার রাতে ঢাকা ছিলেন। রক্তক্ষরণের চার মাস পরেও পূর্ব পাকিস্তান এখনও ভয়ের মাঝে বাস করে। টাইম ম্যাগাজিন সোনার বাংলা ধ্বংস অভিযান শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভারতের প্রেস ট্রাস্ট রিপোর্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি একদল শরণার্থী পাকিস্তানী আর্মি পেট্রোলের ধাওয়া খেয়ে ভারত সীমান্তের কাছেই একটি পাটক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন। পিটিআই প্রতিবেদনে বলছে-‘এ সময় হঠাৎ একটি ছয় মাস বয়সী শিশু মায়ের কোলে কেঁদে ওঠে, মা অনেক চেষ্টা করেও শিশুটিকে থামাতে ব্যর্থ হয়। পাকসেনারা কান্না শুনে ফেললে বাকি শরণার্থীরাও আক্রান্ত হতে পারে সেই আশঙ্কায় মা নিজেই শিশুটিকে গলা টিপে মেরে ফেলে। গোটা পূর্ব পাকিস্তান যেন আজ রক্তস্নাত, আর তার চিহ্ন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। শহরগুলোর সর্বত্র শেল আর বিমান হামলার ধ্বংসযজ্ঞ। লাখ লাখ একর জমি পতিত হয়ে পড়ে আছে। বাঙালীদের সবার মধ্যেই এখন ভয় এবং প্রচ- ঘৃণা বিরাজ করছে। সামনাসামনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবে, এমন লোক খুব কমই আছে, কিন্তু ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এর মেইল বক্সে রোজই অসংখ্য চিঠি আসে অরাজকতা ও নতুন নতুন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার খবর নিয়ে। একজন বাঙালী আমলা, তার গৃহে দেয়া এক গোপন সাক্ষাতকারে বলেন, অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে, দীর্ঘ সময় ধরে এ সংগ্রাম চলবে, হয়ত ভিয়েতনামের চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয় আমাদেরই হবে। আর্মিদের এই হামলায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে নানান রকম ধারণা আছে, দুই লাখ থেকে শুরু করে দশ লাখ পর্যন্ত। কম সংখ্যক ধারণাটাই আমাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য, কিন্তু সঠিক সংখ্যাটি জানা সম্ভব নয়। এর কারণ, অসংখ্য লাশ নদীতে, কুয়ায় অথবা গণকবরে ফেলে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা গত সপ্তাহে মন্তব্য করেন-পোল্যান্ডে নাজিদের হত্যাযজ্ঞের পর এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সুনিপুণ পরিকল্পিত হত্যাকা-। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরোধ ও গড়ে তোলা হচ্ছে ধীরে ধীরে। আর্মি ও তাদের সহযোগীদের হামলার জবাবে প্রথমে গেরিলা হিট এ্যান্ড রান পদ্ধতি, নাশকতা এবং গুপ্তহত্যার মতন আক্রমণ চালানো শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন বাঙালী মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা শত শত ব্রিজ ও কালভার্ট উড়িয়ে দিচ্ছে, রেললাইন ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই গেরিলাদের মূল অংশ ভারতীয় সীমান্তের ওপার থেকেই আসছে, যেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার একটি বৃহদাকার যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ এর কার্যক্রম চালাচ্ছে। তরুণ যোদ্ধারা, যাদের অনেকেই ছাত্র এখনও, তাদেরকেও ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে যেন তারা সাধারণ জনগনের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। সাধারণ জনগণই তাদের খাবার দাবারের ভার নিচ্ছে, তাদের জন্য খবরাখবর আনা নেয়া, রাস্তা চেনানো বা নাশকতায় হিট এ্যান্ড রান হামলা করতে সাহায্য করছে, গেরিলারা ঢাকার বিদ্যুত সংযোগ দুবার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং সপ্তাহখানেক ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েটিকেও অকেজো করে রেখেছে। গর্বিত বাঙালী জাতি সহজে হাল ছাড়ে না। একটি আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ কিন্তু পরিবর্তনশীল জাতি, যাদের দুটি প্রধান আগ্রহের জায়গা হচ্ছে রাজনীতি ও কবিতা, যার একটি নিজস্ব সংস্কৃতি তারা তৈরি করে নিয়েছে। আড্ডা হচ্ছে তাদের অবসর কাটানোর সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্রামের বটতলায় বা ঢাকার কফিহাউসগুলোতে বাঙালীদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। স্বভাবতই বাঙালী তার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কোন বিপ্লবী সঙ্গীত না বরং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার বাংলা’ কবিতাকে বেছে নিয়েছে। যে ভয়াবহ পরিণতি এদেশের মানুষকে মেনে নিতে হয়েছে, তা সত্ত্বেও এই দেশ বিস্ময়কর সৌন্দর্যম-িত, যত দূর চোখ যায় শুধু ধান আর পাট খেত দিগন্তজুড়ে, গঙ্গার মোহনাতে মিশে গিয়েছে। মাটি এতই উর্বর যে বীজ ফেললেই যেকোন শস্য ফলে, যদিও তা বাঙালীকে দারিদ্র্যের আঘাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। প্রকৃতি যেমন দিয়েছে, তেমনি ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় সব ভাসিয়েও নেয়। বন্যায় গঙ্গা বা ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে ভেসে আসা পলিমাটিতেই বাংলার মাটি এত উর্বর। লাখ লাখ বাঙালী গ্রামগুলোতে খাবারের সন্ধানে ঘুরছে। কিছু আক্রান্ত এলাকায় স্থানীয় লোকজনদের খাদ্যের অভাবে গাছের শিকড় বা কুকুরের মাংস খেতে দেখা গেছে। এই অনাহারের হুমকি আরও অনেক মানুষকেই ভারতে যেতে বাধ্য করবে। আগামী কয়েক মাসে অসংখ্য ও লাখ লাখ লোক অনাহারেই মৃত্যুবরণ করবে, যদি একটি বিশালাকার ত্রাণ কর্মসূচী অবিলম্বে চালু না হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×